করোনাভাইরাস: আসন্ন মন্দা থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বাঁচান

মুহাম্মাদ সাইমুম হোসেন ও মেহেদী হাসান সাগর
Published : 4 April 2020, 02:43 PM
Updated : 4 April 2020, 02:43 PM

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা আসন্ন। এ মন্দায় ধনী-গরীব সব দেশই কম-বেশি আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বিশ্বের এই পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটা সব থেকে বড় সংকট বলে জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় সাড়ে তিন কোটি লোক বেকার হয়ে পড়েছে বলে ফেডারেল রিজার্ভের গবেষণায় উঠে এসেছে, যা দেশটির মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ত্রিশ শতাংশেরও বেশি। বিশ্বব্যাংকের পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়েছে যে এই রোগ মোকাবেলায় চলা লকডাউনের কারণে মুখে চীনের প্রবৃদ্ধি থেমে যেতে পারে আর এতে দারিদ্র্যের শিকার হতে পারে পূর্ব এশিয়ার এক কোটিরও বেশি মানুষ।

বাংলাদেশের সরকার ইতোমধ্যে বিশেষ কিছু ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু মন্দা যেদিক থেকেই আসুক বা যতদিনই দীর্ঘস্থায়ী হোক না কেন, এর ভয়ানক পরিণতি পোহাতে হবে আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা এসএমই (SME) সেক্টরকে। বাংলাদেশের শিল্পনীতি–২০১৬ অনুযায়ী ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান এই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালের জরিপ মতে দেশের মোট শিল্প-প্রতিষ্ঠানের ৯৩ ভাগই এসএমই সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। এই জরিপেই উঠে এসেছে এই খাতে কর্মসংস্থান হয় ৩১ দশমিক ৫ শতাংশের। আর জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় ৫ শতাংশের মত। 

বাংলাদেশের এসএমই-গুলো সাধারণত দেশীয় বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করে। স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ ও ঈদকে সামনে রেখে তারা অনেক পণ্য উৎপাদনের কাজে হাত দিয়েছেন কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের বিক্রি থমকে যাওয়ায় তাদের অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছে তা আপনারা বুঝতেই পারছেন। 

তাই এই সেক্টরকে বাঁচানোর জন্য এখনই বিশেষ উদ্যোগ না নিলে পুরো দেশ এক ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে চলে যাবে কোন সন্দেহ নেই, যা মাত্র অল্প কয়েকদিনের লকডাউনেই অনেকে টের পাচ্ছেন। এই সেক্টরে এমন অনেক শ্রমিক ও কর্মী কাজ করেন যাদের পারিশ্রমিক দৈনিক বা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে হয়। বিশ্বে যেভাবে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে তাতে খুব শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সার্বিকভাবে এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকার কী করবে জানি না, তবে আমরা সবাই যার যার জায়গা থেকে কিছু ভূমিকা রাখতে পারি।

১. ক্রেতা হিসেবে এসএমই-কে অগ্রাধিকার দিন

যেই যেই পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে সম্ভব, কিছু দিন বড় ব্র্যান্ড বা বড় কোম্পানি থেকে না কিনে কোন এক এসএমইর বানানো বা বিক্রিত পণ্য কিনুন। বড় কোম্পানির জন্য ৩-৬ মাস সারভাইভ করা যত সহজ, এসএমইদের জন্য কিন্তু ততটাই কঠিন। কমবেশি এক মাসের ভাড়া/বেতন না দিতে পারলেই ঐ এসএমই বন্ধ হয়ে যাবে।

২. বিল পরিশোধ করে দিন 

স্থানীয় ছোট কোম্পানিগুলোর যা বিল আপনার হাতে আছে সাধ্যমত বিল শোধ করে দেবার চেষ্টা করুন, আপনার ১/২ মাসের বিলম্ব হয়তো তার ব্যবসায় বন্ধের কারণ হতে পারে। যা কিনা তার সাথে সম্পর্কিত আরও ২/৪ টি ছোট কোম্পানি বন্ধের কারণ হতে পারে।

৩. ভাড়া কমিয়ে দিন

প্রিয় বাড়িওয়ালা ভাইরা, বিশ্বাস করুন শহরের ৭০-৮০ শতাংশ লোক বেকার হয়ে গেলে আপনার বাসা ভাড়া নেবার কেউ থাকবে না, তাই আপাতত ভাড়া কিছুটা কমিয়ে সবাইকে এ যাত্রায় বেঁচে থাকার সুযোগ দিন, সবাই টিকে গেলে ২০২১ এ ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েন।

৪. সহজ শর্তে ঋণ দিন

ব্যাংকাররা এটা ভালোই বুঝবে, এসএমই ধসে গেলে অনেক ব্যাংকও বেশিদিন টিকবে না।

৫. বেতন সংক্রান্ত পদক্ষেপ বা ফার্লোয়িং

প্রয়োজনে নিজের (কর্মরত মালিক এবং টিম মেম্বার এমপ্লয়ী উভয়েই) বেতন কিছুটা কমিয়ে আপনার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে সহায়তা করুন। বেতন কিছুটা কম পেলেও থেকে যান, একবার চাকরি ছেড়ে দিলে পরে আরও লম্বা সময় বেকার থাকতে হবে, নিশ্চিত থাকুন।

৬. অনলাইনে বেচা-কেনায় সহযোগিতা 

এই সেক্টরের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের তেমন ভালো অনলাইন/ইকমার্স সিস্টেম নেই। এজন্য প্রযুক্তি, মোবাইল ফাইনেন্সিয়াল (বিকাশ, নগদ) ও কুরিয়ার/ডেলিভারি খাতের উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে যেন এসএমই সেক্টরের ব্যবসায়ীরা অনলাইনে বেচা-কেনায় পারদর্শী হয়ে উঠতে পারে।   

একটু উল্টো দিক থেকে ভাবেন, ধরেন যেকোনওভাবে এই ৭০ লাখ এসএমই-কে টিকিয়ে রাখবো, তাহলে এদের আন্ডারে কর্মরত প্রায় আড়াই কোটি লোকের চাকরি থাকবে, এরা নিয়মিত বাজার করবে, রিক্সায় উঠবে, মোবাইলে কথা বলবে, কাপড়-চোপড় কিনবে, কিছু টাকা ব্যাংকে রাখবে, ব্যাংক সেই টাকা আবার বড় কাউকে লোন দিতে পারবে অর্থাৎ অর্থনীতির চাকাটা সচল থাকবে। আর এই এসএমই-র চাকা বন্ধ হয়ে গেলে কিন্তু বাকি সব কিছুর চাকা বন্ধ/শ্লথ হতে বেশি সময় লাগবে না। 

সরকার সরকারের জায়গা থেকে প্রণোদনা, সাহায্য, সহযোগিতা করবে। তবে জনগণ যদি এই পরিস্থতিতে কার্যকর ভূমিকা না পালন করে অর্থাৎ দেশের এসএমই সেক্টরের পাশে এসে না দাঁড়ায় তাহলে যে সংকট দাঁড়াবে তা সরকার, ব্যাংক ব্যবস্থা, বা দেশি-বিদেশি সাহায্য সংস্থার কারোরই নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থায় থাকবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এই সংকট মোকাবেলায় একে অন্যের পাশে দাঁড়ানোকে সব থেকে কার্যকর উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছে। আমরা যদি সেই পথে হাঁটতে না পারি, তাহলে আর ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় থাকবে না।