করোনাভাইরাস: জার্মানির প্রস্তুতি বনাম বাংলাদেশের প্রস্তুতি

Published : 2 April 2020, 05:18 PM
Updated : 2 April 2020, 05:18 PM

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে জার্মানিতে এপ্রিলের দুই তারিখ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৯৭ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ৮২ হাজারের কাছাকাছি। নতুন বলে করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষ আতংকিত। আর সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এটা খুব দ্রুত এবং সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে। দু'সপ্তাহ আগে জার্মান এনটিভিতে একটা চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিলেন যে, "বিশ্বে যখনই কোন নতুন ভাইরাস আসে তখন জন জীবনে আতংকের সৃষ্টি হয়। কারণ আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে জানি না কেমনে এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে হবে। আমাদেরকে এখন দ্রুত শিখতে হবে কিভাবে এই ভাইরাসকে দমন করা যায়।" তিনি আরও বলেন, "এখনও আমরা ইনফ্লুয়েঞ্জার সুনির্দিষ্ট কোন ওষুধ আবিষ্কার করতে পারিনি। কিন্তু দীর্ঘদিন ফ্লু ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে করতে আমারা এটাকে দমিয়ে রাখতে পারছি।"

ফ্লুর টিকা আছে তারপরও সেটা শতভাগ কাউকে নিরাপদ রাখতে পারে না। তবে যারা টিকা নিয়েছেন তাদেরকে ফ্লু গুরুতরভাবে আঘাত করতে পারে না। আক্রান্ত হলেও তাদের ক্ষেত্রে লক্ষণ থাকে সীমিত। জার্মানির মত দেশেও প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে ফ্লুতে। বিগত বছরগুলোতে জার্মানির ফ্লু আক্রান্তদের মৃত্যুর একটা তালিকা নিম্নে দেওয়া হল:

সাল

ফ্লুতে জার্মানির মৃত্যুর সংখ্যা

২০০৯

২১,০২৯

২০১০

১৮,৩৯১

২০১১

১৮,০১৪

২০১২

১৭,৭৬১

২০১৩

১৮,৭৯৭

২০১৪

১৫,৯৯২

২০১৫

১৯,৩৬৮

২০১৬

১৮,০০২

২০১৭

১৯,১১৩

২০১৮

২৫,১০০

২০১৭/১৮ সালের অসাধারণ শক্তিশালী ফ্লু স্রোত জার্মানির প্রায় ২৫ হাজার ১০০ মানুষের জীবন নিয়েছে। রবের্ট কোখ ইনস্টিটিউটের (আর কে আই) সভাপতি লোথার ভিলার জানিয়েছেন, গত ৩০ বছরের পরিসংখ্যানের পরিপ্রেক্ষিতে এটিই সর্বোচ্চ ফ্লুতে মৃত্যুর ঘটনা।

রবের্ট কোখ ইনস্টিটিউটের মতানুসারে ফ্লুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হলো টিকা দেওয়া, যদিও এটা বিভিন্ন ঋতুতে আচরণ পরিবর্তন করে। লোথার ভিলার বলেছেন, "জার্মানিতে অধিক জীবন রক্ষার জন্য টিকার বিকল্প নেই।" আরকেআই এর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে টিকার পাশাপাশি সাবান দিয়ে হাত ভাল করে ধুয়ে ফেলা এবং ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা প্রথম করণীয়।

২০১৮ সালের ভয়ঙ্কর ফ্লুর প্রকোপের পর কেন্দ্রিয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী ইয়েন্স স্পান সতর্ক করেছেন যারা টিকা নেবার বিরুদ্ধে তাদের মনে রাখা উচিৎ, "টিকা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।" তিনি আরও সতর্ক করেন, "ফ্লু মারাত্মকও হতে পারে।" তিনি বিশেষত বয়স্ক ব্যক্তিদের, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থ, গর্ভবতী মহিলা ও চিকিৎসা কর্মীদের সঠিক সময়ে টিকা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।

করোনাভাইরাস আচরণে অনেকটা সাধারণ ফ্লুর মত হলেও এটা মারাত্মক বিধ্বংসী এবং এর গতি-প্রকৃতি ও আচরণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের মতে এর ওষুধ বের হতে নূন্যতম ৫/৬মাসের প্রয়োজন বা তার বেশি। আর টিকা এখনও অনেক দূরের ব্যাপার, অন্তত এক-দেড় বছর লেগে যাবে। অতএব এক্ষেত্রে আমাদের বর্তমানে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য হলুদ, আদা, ভিটামিন-সি, ডি, ভিটামিন-বি১২, মিনারেল(খনিজ), দস্তা, সেলেনিয়াম, আয়রন, স্পিরুলিনা গ্রহণ করা যেতে পারে চিকিৎসকের পরামর্শনুযায়ী।(অনুগ্রহ করে কেউ না বুঝে অতিমাত্রায় এসব গ্রহণ করে অতিরিক্ত সমস্যা তৈরি করবেন না।) দুশ্চিন্তা না করে সাহসিকতার সাথে সবকিছু মোকাবেলা করা।

এই ভাইরাস বিধ্বংসী হলেও চীন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একে মোকাবেলা করেছে। চীনে ১০ জানুয়ারি প্রথম কোরোনা আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে তারা যে সাফল্য দেখিয়েছে কোন টিকা ও নির্দিষ্ট ওষুধ ছাড়া তা কল্পনাতীত। মোটকথা চীনের জাতীয়তাবোধ, একতাবদ্ধতা বিশ্বের যে কোন জাতির চেয়ে বেশি, তা তারা আরেকবার প্রমাণ করে দিল। যে উহানে এই ভাইরাসের জন্ম তাকে বিশ্ব থেকে তো বটেই বাকি চীন থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। আর তাই তারা সাফল্যও পেয়েছে। আমি মনে করি তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় এটা আদৌ সম্ভব ছিল না। মানব কল্যাণের জন্য চীন যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা পশ্চিমা সরকারদের পছন্দ না হলেও বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে এবং হবে। ২৭ মার্চ থেকে উহানের মানুষজন আবার কাজ শুরু করেছে তারা অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত।

কিন্তু হাতে যথেষ্ঠ সময় পেয়েও ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং তারা চীনকে প্রথমদিকে ব্যঙ্গ করেছে। বলেছে ওরা সাপ, ব্যাঙ, পোকা-মাকড়, চামচিকা বাদুর কোন কিছু বাদ দেয় না, সব খায় তো ওদের কোরোনায় ধরবে না! আমি একজনকে বলেছিলাম, চীনারা তো এগুলো হাজার হাজার বছর ধরে খাচ্ছে তো এতদিন হল না কেন? তখন  তিনি চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। চীনের এই ঘটনার পর ইউরোপে চীনা রেস্টুরেন্টগুলোর ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে কোনো ক্রেতা যাচ্ছিল না। এমনকি ফ্রান্সে মেট্রো থেকে চীনা নাগরিকদের জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলে একজন চীনা সদৃশ ইসরায়েলি নাগরিককে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে।  যদিও সে প্রহারকারীদের বারবার জানিয়েছে সে চায়নিজ না, একজন ইসরায়েলি নাগরিক!

ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন এই সকল ধনতান্ত্রিক দেশগুলো বিলাসবহুল সামগ্রী উৎপাদন এবং ধনিক শ্রেণির মনোরঞ্জনে আগাগোড়াই মনোনিবেশ করেছে। বিশেষ করে ইতালি বিলাসবহুল গাড়ি বানিয়েছে ধনিক শ্রেণির জন্য। কিন্তু সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি নেই তা প্রমাণিত হয়েছে। চীন এক সপ্তাহের মধ্যে একটা বিশেষ হাসপাতাল বানাতে পেরেছে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্যে, যা ইউরোপ বা আমেরিকা পারেনি। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড আছে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও একই পথের পথিক। এমনকি ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও পাকিস্তানও এই দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছে। এই পারমাণবিক অস্ত্রগুলো করোনাভাইরাস নামক অদৃশ্য শত্রুকে ধ্বংস করতে অপারগ। কিন্তু সারাবিশ্ব যে পরিমাণ অর্থ পারমাণবিক অস্ত্রের পিছনে ব্যয় করছে, তার সিকি ভাগ মানবকল্যাণে ব্যয় করলে আমরা খুব সহজেই অনেক ভাইরাসকে জয় করতে পারতাম।

ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেনসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করেছে। যার ফল এখন তাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে। বিশেষ করে জার্মানির নির্লিপ্ততা ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন। জার্মানি তার সীমান্ত বন্ধ করতে দ্বিধান্বিত ছিল। আমাকে একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেছিলেন, "সীমান্ত বন্ধ করে কি লাভ হবে এটা তো আসবেই। আমাদেরকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।" আমি তাকে বলেছিলাম- 'চীনের অভিজ্ঞতায় আমি মনে করি সীমান্ত বন্ধের বিকল্প নেই।' আমি সেই স্বাস্থ্যকর্মীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "এখন কেন জার্মান সরকার সীমান্ত বন্ধ করল এতে লাভ কী হবে?" তিনি নিশ্চুপ ছিলেন।

সীমান্ত বন্ধ করে এবং কড়াকড়ি করে স্লোভাকিয়া অভাবনীয় ভালো ফল পেয়েছে। সেখানে আজ পর্যন্ত একজন মানুষ মারা যায়নি এবং সংক্রমণের হার খুবই কম। স্লোভাকিয়াই প্রথম দেশ যারা আইন অমান্য করবে তাদের জন্য বড় ধরনের জরিমানার ব্যবস্থা রেখেছে। আমি যতদূর জানি এই জরিমানার হার দেড় হাজার ইউরো থেকে দশ হাজার ইউরো পর্যন্ত এবং ১০ বছর পর্যন্ত জেল এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রয়োজনে আক্রান্তদের মোবাইল ফোনে আড়ি পাততে পারবে সরকার। স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে খুবই কড়া পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তারা রাস্তায় নিরাপত্তা কর্মীদের নজরদারী বাড়িয়েছে।  দ্রুত রেস্টুরেন্ট- বার বন্ধ করে দিয়েছে এবং এই আইন করার সাথে সাথে তা কঠিনভাবে কার্যকর করেছে।

জার্মানিসহ যে সকল দেশ গড়িমসি করেছে তারা এখন কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রেড জোনে পরিণত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিবছর ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ধারে কাছেও না। ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুতে মানুষ এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যার কারণে এনিয়ে এত বেশি আলোচনা হয় না। আর ২০১৮ সালের হিসেব দেখলে সেখানে শুধু জার্মানিতে ২৫,১০০ মানুষ মারা গেছে এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই হয়নি। সেই আলোকে দেখলে করোনাভাইরাসকে এত ভয় পাবার কিছু নেই, কিন্তু এটাকে খুব হালকাভাবে দেখারও সুযোগ নেই- কারণ এর বিধ্বংসী আচরণ।

সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি সরকারি নির্দেশনাকে উপেক্ষা করেছেন।  আমাদের দেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। বিশেষ করে ঢাকা শহরের জনবসতির ঘনত্ব খুবই বেশি রাস্তায় নামলে একজনের সঙ্গে আরেকজনের ধাক্কা লাগে। সেক্ষেত্রে এই দেশে দেড়/দুই মিটার নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলা মুশকিল না অসম্ভবও। অধিকাংশ মানুষ কোয়ারেন্টিন কী সেটাই ঠিকমতো বোঝেন না। আর বস্তি এলাকায় সেখানে কি এই কোয়ারেন্টিনের প্রয়োগ করা সম্ভব? মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে থাকে, যেখানে চটের বেড়া বা পাতার বেড়া। সেখানে কেউ হাঁচি-কাশি দিলে এক ঘরে থেকে আরেক ঘরে দ্রুত রোগ জীবাণু চলে যায়। এই ভাইরাস এতটাই বিধ্বংসী যে সাধারণ যে মাস্ক চিকিৎসা কর্মীরা ব্যবহার করেন সেটা দিয়ে এটাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব না। আর আমাদের বিস্ফোরিত জনসংখ্যার জন্য যানবাহন অপ্রতুল সেখানে ভিড় স্বাভাবিক, আর সংক্রমণের ঝুঁকি মারাত্মক। কিন্তু কোন সরকারের পক্ষে এটা রাতারাতি সমাধান সম্ভব না। এটা সরকারের ত্রুটি নয়, সামর্থহীনতা। তবে সিলেটের বাণিজ্য মেলা এই অবস্থায় চলতে দেওয়া ছিল সরকারের ব্যর্থতা।

জার্মানিতে হাসপাতালে যথেষ্ঠ পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট নেই।  স্বাস্থ্যকর্মীদের একই পোশাক ২/৩ দিন ব্যবহার করতে হচ্ছে। যা একবারের বেশি ব্যবহার করা কোনওভাবেই উচিত না। এখানে জীবাণুমুক্তকারী তরলের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। কোন দোকানেই এগুলো কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে হাসপাতালসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা দেয় সেখান থেকে এগুলো চুরি হয়েছে। মাস্ক এবং হাতমোজাও  চুরি হয়েছে। আমার সঙ্গিনী একটা স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের একটা শাখার ব্যবস্থাপক। তার শাখা থেকেও জীবাণুমুক্তকারী তরল চুরি হয়েছে। এমনকি একটা বিদ্যালয় থেকে টয়লেট পেপার পর্যন্ত চুরি হয়েছে বিপুল পরিমাণ, এ নিয়ে পুলিশ কেস পর্যন্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যদি যথেষ্ঠ পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট না থাকে তারপরও রোগীদের সেবা দিতে হবে। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাস বহন করছেন কিন্তু আক্রান্ত না তাদেরকেও কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে তারা শুধু সেই সব রোগীদের চিকিৎসা দেবে যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত।

সমস্ত বিশ্ববাসীকে এখন মনে রাখতে হবে আমরা অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছি। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এখানে আমাদেরকে একটা অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে এবং এই শত্রু ভয়ানক শক্তিশালী। যথেষ্ঠ পিপিআই না থাকার কারণে ইতালিতে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী জীবন দিয়েছেন কিন্তু তারা কর্মে বিরতি দেননি। এই অজুহাতে তারা অপারগতাও প্রকাশ করেননি। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধারা বলেননি, সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা সাধারণ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে পারবো না। বরং তারা আমাদের নেতার কথা শুনেছেন যার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শত্রু নিধনে।

ইতিমধ্যে অনেক সংবাদপত্রে খবর এসেছে বাংলাদেশে পিপিআই এর অজুহাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা কাজ করতে পারবেন না বলে অপারগতা জানিয়েছেন। আমাদেরকে বুঝতে হবে বিশ্বে পিপিআই যে পরিমাণ উৎপাদন করা হয় সারা বছরের জন্য তা এক মাসেই শেষ হয়ে গেছে। আমাদের দেশ নিঃসন্দেহে ইউরোপের দেশগুলোর মতো সামর্থ্যও না। অনেক হাসপাতালে নাকি চিকিৎসা কর্মীরা নেই, সেখানে এমনও রোগী আছে যাদের কিডনি সমস্যার কারণে রক্ত পরিশোধন জরুরী। কিন্তু সেইসব রোগীদের ফেলেই স্বাস্থ্যকর্মীরা পালিয়েছেন। ডাক্তার এবং এইসব স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রতি আমার প্রশ্ন – আপনারা যখন বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ নিয়েছিলেন তখন কেন দেখে নেননি হাসপাতালে যথেষ্ঠ পিপিআই আছে কিনা? যারা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ডাক্তারি পড়ার জন্য সেই সব শিক্ষার্থীরা কি দেখেননি যে, সেখানে যথেষ্ঠ আধুনিক সুবিধা নেই? এখন যদি আপনারা অপারগতা প্রকাশ করেন সেক্ষেত্রে তো আপনাদের সেখানে এমবিবিএস পড়া উচিৎ হয়নি। আপনারা ডাক্তার হয়েছেন বা হতে চান  এই কারণে যে এ পেশায় উপার্জন ভালো, সম্মান বেশি কিন্তু ঝুঁকিটা নিতে চাচ্ছেন না। এটা কোন চিকিৎসা নীতি শাস্ত্রের মধ্যে পড়ে? বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে তো আপনারা পিপিআই ছাড়াই কাজ করছেন। অনেকে হাসপাতালে কাজ করতে অপারগতা জানালেও প্রাইভেট চেম্বারে সেবা দিচ্ছেন পিপিআই ছাড়া।

জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন সুপার মার্কেটের সেলসম্যানরা। তারা ক্যাশে বসে একেক জন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। এদের কারোর মুখে মুখোশ নেই, এমনকি অনেকে হাতমোজা ছাড়াই কাজ করছেন মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু কেউ বলছেন না আমরা কাজে যেতে পারবো না।

স্প্যানিশ ফ্লু ছিল একটি অস্বাভাবিক মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এটি ৫০০ মিলিয়ন মানুষকে সংক্রামিত করেছিল। সেই সময়কার বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ। ধারণা করা হয় মৃত্যু হয়েছিল ১৭ মিলিয়ন থেকে ৫০ মিলিয়নের বেশি মানুষের। অনেকে মনে করেন সম্ভবত সেই মহামারী ১০০ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। এটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারীগুলির মধ্যে একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সময়েও স্বাস্থ্য কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। অতএব আমরা আশা করবো আমাদের দেশের চিকিৎসকরা নিজ দায়িত্বে হলেও পিপিআই জোগাড় করে দেশ জাতির সেবায় এগিয়ে আসবেন। সরকারকে সহায়তা করবেন। আর ডাক্তাররা তো ১০০টাকার ফিস এতদিন ৫০০টাকা অবৈধভাবে আদায় করেছেন এখন বিপদে একটু ঝুঁকি নিয়ে সেবা দেবেন না কেন? আরা সেবা না দিলে গণরোষে পড়তে পারেন সেটাও মনে রাখবেন।

আমাদের সরকার প্রধান সময়মত সাড়া দিয়েছেন এবং ব্যবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী আবারো দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি জেলে থাকা অবস্থায় পত্রিকা পান এবং নিশ্চয়ই পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও পত্রিকায় পেয়েছেন। করোনাভাইরাসের ছোবল তার অজানা থাকার কথা না। এই অবস্থায় কোন রকম জনসমাবেশ, সামাজিক যোগাযোগ কোনটাই আইনসিদ্ধ নয়। এবং জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ। কিন্তু তিনি তার উৎশৃংখল কর্মীদের রহিত করতে পারেননি। সেখানে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন তার ডেপুটি ফকরুল সাহেবও। তিনিও বিএনপি'র উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের সমাবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখান থেকে বোঝা যায় জনগণ তাদের কাছে মুখ্য না।