দুর্যোগ দুর্বিপাকে বিভেদ নয়, গড়ে উঠুক স্বেচ্ছাব্রতী দায়বদ্ধতা!

মো. মোজাহিদুল ইসলাম নয়ন
Published : 2 April 2020, 02:45 PM
Updated : 2 April 2020, 02:45 PM

ইংরেজি A Friend in Need is a Friend Indeed প্রবাদটির বাংলা আমরা করি "বিপদের দিনে যে পাশে থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু"। আর এমন একটি পরম সত্যের মুখোমুখি আমরা মানুষ প্রায়শই হয়ে থাকি। বিপদে যখন সাহায্যের জন্য কেউ ব্যাকুল হয় তখন সে বোঝে বন্ধু'র প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আমাদের অভিজ্ঞতা কেমন হয়? এর স্ট্রেইটকাট উত্তর দেয়া কঠিন। কারণ প্রয়োজনীয়তা, প্রেক্ষিত ও ব্যক্তি বিশেষের আচরণে যে অভিজ্ঞতা হয় সেটাও ব্যক্তি নির্বিশেষ নয়। যাহোক, বিপদের দিনে অন্যের সাহায্য প্রাপ্তি ব্যক্তিক প্রেক্ষিতে যেমনই হোক সামষ্টিক ক্ষেত্রে কিন্তু একেবারেই আলাদা। ব্যক্তির সংকট এবং তজ্জনিত ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হলে একটি পরিবারকে নাজুক করতে পারে কিন্তু জাতীয় সংকট পুরো জাতিকে অনেক যুগ পিছিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে বিশ্বায়নের এই যুগে কোনও সংকটই দেশ সীমাবদ্ধ নয়। এই যেমন করোনাভাইরাস জনিত বৈশ্বিক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা থেকে রেহাই পেতে মানুষের পাশে মানুষ আর এক দেশের পাশে অন্য দেশের দাঁড়ানোর কোনও বিকল্প হতে পারে না। আর এহেন ভয়াবহতা বাস্তবতায় ব্যক্তি মানুষ ও সমষ্টির সামাজিক দায়বদ্ধতা একটি অন্যতম নিদান হিসেবে আলোচনার দাবি রাখে।

২. করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ, গৃহীত কার্যক্রম বাস্তবায়নে অবহেলা-ধীরগতি, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতা-অনুপস্থিতি, তথ্যবিভ্রান্তি এবং ভুক্তভোগীদের অসন্তুষ্টি নিয়ে ইতোমধ্যে মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব। প্রায় প্রতি মুহূর্তেই এ নিয়ে পক্ষসমূহের মধ্যে চলছে বাতচিৎ। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন তাদের কথা আবার সেটি মেলাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ভিন্ন। করোনা চিকিৎসা, সেবা ও পরামর্শ বিষয়ে সরকারের দেয়া তথ্যের গড়মিল, বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা মানুষকে রীতিমতো গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান তথ্যে ক্ষণে ক্ষণে মানুষের মধ্যে বাড়ছে আতংক আর সংশয়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ আর শুধু সরকারি সেবা ব্যবস্থাপনার উপর আস্থা রাখতে পারছে না। ফলে খুব বোধগম্য কারণেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হয়ে উঠছে।

৩. চাওয়া যতই অনিবার্য হোক, অসহায়ত্বের এই অভূতপূর্ব সময়ে ট্র্যডিশনাল সংগঠনসমূহকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে এখনও সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মানুষের স্বেচ্ছাব্রতী মানসিকতা অনেকটাই ফিঁকে হয়ে পড়েছে। হাতেগোনা দু'একটি সংগঠন ছাড়া তেমন কেউ এখন পর্যন্ত মাঠে নেই। আমি এর আগেও লিখেছি-বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন এবং উদীচী (জনপ্রিয়তার তথাকথিত বিচারে যারা আজকাল নিতান্তই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে) ইতোমধ্যে বিনামূল্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মাস্ক তৈরি করে স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ শুরু করেছে। বুয়েট, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নওগাঁ একুশে পরিষদ নামে একটি সামাজিক সংগঠন হাতে তৈরি মাস্ক, স্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণ করছে। কিন্তু দেশের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন যারা নানাভাবে সক্রিয় তারাও এই সংকটময় মুহূর্তে সেভাবে এগিয়ে আসেনি।

হতে পারে করোনাভাইরাস বিষয়টির স্পর্ষকাতরতা একটি কারণ। এছাড়া সায়েন্টিফিক জ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা না থাকাটাও আশানুরূপ সংখ্যায় সংগঠনের এগিয়ে না আসার কারণ হতে পারে। তা সত্বেও বিশেষ করে যারা বিশেষায়িত সংগঠন যেমন- সন্ধানী, রেডক্রস, স্বেচ্ছায় রক্তদান ক্যাম্পেইন, চিকিৎসা শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থীদের সংগঠন, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ তাদেরও তো তেমন সক্রিয় দেখা যাচ্ছে না। এর বাইরে জাতীয়-আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন যেমন সাইট সেভারস, অরবিস ইন্টারন্যাশনাল, ইসলামিয়া আই হসপিটাল, লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল তারাও এখনও সবটুকু সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে আসেনি। যে সকল বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে যেমন- সিটি করপোরেশনের আওতায় পরিচালিত হাসপাতালসমূহ, মিশনারি হাসপাতাল তারাও কিন্তু এই বিশেষ সময়ে প্রোঅ্যাকাটিভ অ্যাকশন নিতে পারে যার ইতিবাচক প্রভাব সমাজের পড়তে বাধ্য।

৪. বাংলাদেশে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন যাদের সংখ্যা একসময় অনেক বেশি ছিল। ক্লাব, নাট্যগোষ্ঠী/থিয়েটার, সংগীত বিদ্যালয়, বিতর্ক চর্চা সংগঠন, কবিতা পাঠের সংগঠন, কবিদের সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, সাংস্কৃতিক জোট ইত্যাদি সংগঠনের সামাজিক দায়বদ্ধতা অনেক বেশি বিশেষ করে এই রকম দুর্যোগের সময়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রাম থিয়েটার, ঢাকার নাটক পাড়ার স্বনামধন্য সংগঠনসমূহ (ঢাকা, নাগরিক, আরণ্যক ইত্যাদি), সুরের ধারা, বুলবুল ললিতকলা একাডেডি, ব্যান্ড সংগীত দলসমূহ কেউই এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। ক্রীড়া সংগঠনসমূহ (যারা অর্থের লোভে ক্যাসিনো চালায়) যারা আর্থিকভাবে অনেক স্বচ্ছল তারা এবং ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি তারাও এ অবস্থায় প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে। কিন্তু এই সংগঠনগুলো নানারকম দেন-দরবার, পুরস্কার প্রাপ্তি, বিদেশী মিশনে সহযোগী হওয়া, বিজ্ঞাপন, দলীয় পদ প্রাপ্তির খেলায় যথেষ্ট চৌকষ। অন্যদিকে জার্মান বুন্দেসলিগার দুজন ফুটবলার ইতিমধ্যে করোনা ফান্ড গঠনে কাজ শুরু করেছে। তাদের সাথে যোগ দিয়ে পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লোভেনডোভোস্কিও। ইতালিতে ২০০৬ সালের বিশ্বকাপজয়ী ফুটবল দল অধিনায়ক ফ্যাবিও ক্যানাভারোর নেতৃত্বে করোনা প্রতিরোধে মাঠে নেমে পড়েছে।

ব্যবসায়ীদের সংগঠনসমূহ বিশেষ করে এফবিসিসিআই, তৈরি পোষাক শিল্প মালিক সমিতি (বিজিএমইএ, বিকিএমইএ) তারা করোনার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বা চলমান সংকটে কারখানা চালু রাখার নানান কায়দা-কৌশল খুঁজতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ী হিসেবে তারা ব্যবসায় করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের সংকট বিবেচনায় শিল্প মালিক সমিতিসমূহ মাস্ক তৈরি, চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে যেখানে বড় বড় হাসপাতালগুলো এ বিষয়ে তীব্র সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তখন তাদের জন্য এগিয়ে আসা জরুরি নয় কি? যতদূর জানি, সরকারে এবং জাতীয় সংসদে একটি বড় অংশ ব্যবসায়ী তারা এ সময়ে কী ভূমিকায় আছেন সেটা দেশবাসী দেখতে চায়। এখন পর্যন্ত আইন প্রণেতা হিসেবে তারা যে সকল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে বলছেন তা শুনতে তো ভালোই। কিন্তু তার যথাযথ কার্যকারিতা দেখিয়ে দেশবাসীকে আস্থায় নিতেও তাদের বড় দায় রয়েছে। একজন ব্যবসায়ী নেতা এমপি হওয়ার স্বপ্নে এরকম হুলুস্থুল পরিস্থিতিতেও নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানোর উদারতাও দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

৫. একসময় আমার এলাকায় ছয়-সাতটি ছাত্র সংগঠন, চারটি নাট্য সংগঠন, অন্তত আধা ডজন সাংস্কৃতিক সংগঠন সক্রিয় ছিল। এসকল সংগঠন স্ব-স্ব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার পাশাপাশি যেকোনো জাতীয় প্রয়োজনে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়ে যেত। যেমন- স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন, জামাত-শিবিরবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় দিবস সমূহের (স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, একুশে ফ্রেব্রুয়ারি ইত্যাদি) অনুষ্ঠান আয়োজনে দলীয় পরিচয়ের রেখা প্রায়ই মিলিয়ে যেত। প্রসঙ্গত উল্লেখ, একটা সময় ছিল যখন একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র শাখার সকল রকম প্রকাশ্য কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তাদের একজন জাতীয় নেতা (যে এখন যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত হয়ে যাবজ্জীবন জেল খাটছে) অনেক চেষ্টা করেও ঐ জেলায় সাংগঠনিক সফর করতে পারেনি। হালে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সেই ঐতিহ্য কী অবস্থায় আছে সে বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তেমন কোনও তথ্য আমার কাছে নেই। নানা বাস্তবিক কারণে আমি সেই সংযোগ হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সাদাচোখে যা দেখি তাতে মৌলিক অনেক পরিবর্তন তো স্পষ্ট। তার মধ্যে একটি হলো- ছাত্র সমস্যাভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের জায়গা নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি। এখন যে দু'একটি সংগঠন সক্রিয় আছে তার মধ্যে একটি বিশিষ্ট অংশ (অন্তত সংখ্যার দিক থেকে) ক্ষমতাসীন দলের সাথে আছে যুক্ত। তার কারণও বোঝা কঠিন কিছু নয়। মূলত আদর্শহীন আর্থিক লাভালাভ আর শর্টকার্টে পয়সা কামানোর একটি অন্যতম উপায় হওয়ায় লেজুড়বৃত্তির এ ছাত্র সংগঠনগুলোতে তরুণদের ভীড় দেখা যায়। এ সকল সংগঠনের পক্ষে শেখানো দলীয় বুলি আর বিগবসদের হাতকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে সামাজিক স্বেচ্ছাব্রতী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া কতটুকু সম্ভব সেটা আর কারও অজানা নয়।

৬. কিন্তু নিকট অতীতে যদি দেখা যায় তাহলে পাওয়া যাবে স্বেচ্ছাব্রতী মানসিকতার অনেক হিরন্ময় ইতিবৃত্ত! মহান মুক্তিযুদ্ধে সর্বসাধারণের অকুতোভয় অংশগ্রহণ, লড়াই-সংগ্রাম আর ত্যাগ তো কিংবদন্তীতুল্য (যদিও তারা এখন আর মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব তেমন পায় না!)। এছাড়া নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, আইলা, সিডর), মানবসৃষ্ট দুর্যোগ (যেমন, অগ্নিকান্ড), যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে তোলা এবং সর্বসাম্প্রতিক নিরাপদ সড়কের দাবিতে তরুণ প্রজন্মের এগিয়ে আসা, সবকটিই তো স্বেচ্ছাসেবার উজ্জ্বলতম উদাহরণ। কিন্তু প্রায় তিনমাস বয়সী করোনা'র মতো একটি সর্বব্যাপী দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবার সুমহান উপস্থিতি কেন এত কম? তাৎক্ষণিক কিছু কারণ হয়তো আছে যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সেটা মেনে নিয়েও বলা যায়, এ সংকটময় মুহূর্তে অনেক কিছু করতে পারে বিশেষ করে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, জনদূরত্ব মেনে চলা, হোম কোয়ারেন্টিনকালীন সময়ে করণীয় ইত্যাদি। কারণ রোগটি মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত চীন, কোরিয়া, রাশিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশের সফলতার জন্য জনশৃঙ্খলা সঠিকভাবে মেনে চলতে পারাকে স্বীকার করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের জনঘনত্ব, শিক্ষার নিম্নহার, সচেতনতার নিম্নমাত্রা, সরকারি সেবা আর শাসনতান্ত্রিক দুর্বলতা বিবেচনায় নিলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং স্বেচ্ছাব্রতী মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসার তেমন কোনও বিকল্প এ মুহূর্তে যে নেই। তাই আসুন দলীয় রাজনীতির চিরাচরিত বিভেদ, শ্রেণীবৈষম্য, ছিদ্রান্বেষণী মানসিকতা ভুলে সামাজিক দায়বদ্ধতাভিত্তিক একটি মানবিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা হোক। তৈরি হোক স্বেচ্ছাব্রতী মানবিক সামষ্টিক শক্তির নব উদ্বোধন।