করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও এবারের ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’

সাজিদা রহমান ড্যানি
Published : 10 Jan 2012, 06:56 PM
Updated : 2 April 2020, 08:17 AM

স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত প্রতিটি মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ ২ এপ্রিলকে 'বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস' হিসেবে ঘোষণা দেয়। এ বছর করোনা ভাইরাস মহামারী আকার না নিলে হয়তো বছরের এই একটি দিন সামান্য সময়ের জন্য হলেও সবার মনযোগ পেত অটিজমে ভুগতে থাকা মানুষেরা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হতো না। কিন্তু এবারের চিত্রটি ভিন্ন। আমরা সকলে ঘরের ভেতর আটকে আছি, অপেক্ষা করছি কবে এই মহামারী থেকে সবাই মুক্তি পাব। তারপরও পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্ট যেহেতু সারাবছরই অটিজম সচেতনতা নিয়ে কাজ করে, তাই এই দিনটিতেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আমরা আমাদের মতো করে দিবসটি পালন করছি।

তাছাড়া জাতিসংঘের এবারের 'বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস'-এর মূল মনোযোগের বিষয়টি ছিলো 'transition to adulthood', অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কে রুপান্তর। মানে অটিজমে ভোগা একজন মানুষের জন্য কৈশোর পার করে প্রাপ্তবয়স্কে পরিণত হবার পথটাকে সুগম করা। তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে, তার দক্ষতা উন্নয়ন করে এবং তার উপযোগী চাকরি দেয়ার মাধ্যমে তাকে আয় করতে দেয়ার এবং স্বাধীনভাবে চলতে পারার ক্ষমতাটুকু দেয়া।

এ বিষয়টি আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাথে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্ট এমন একটি অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে অটিজম ও স্নায়ুবিক প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এ ধরনের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের নিজস্ব প্রতিভা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ও চাকরি দিয়ে স্বাবলম্বী করতে আমরা দিনরাত কাজ করে চলেছি। এ মানুষগুলো যাতে পরিবার ও সমাজের আর দশজন মানুষের মতোই স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচতে পারে আমরা সেভাবে গড়ে উঠতে সহযোগিতা করি। সহজে বলে ফেলা গেলেও কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষদের নিয়ে কাজ করছি তাদেরকে নিয়ে আমাদের পথচলা মোটেই সহজ ছিল না।

এজন্য আমরা একটি অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করি যা অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে মডেল বলে বিবেচিত হয়। যেমন আমরা প্রি-ভোকেশনাল সেকশনের মাধ্যমে তাদেরকে নিজের দৈনন্দিন কাজ নিজে নিজে করতে শেখাই। এতে করে তার এবং তার পরিবারের জন্য প্রতিদিনকার জীবন খানিকটা হলেও সহজ হয়ে ওঠে। এসব কাজ রপ্ত করে ফেলার পর আমরা তাদেরকে তাদের সামর্থ্য এবং যোগ্যতা অনুযায়ী ভোকেশনাল সেকশনের মাধ্যমে একটি বিশেষ কাজে দক্ষ করে তুলি। যাতে এই মানুষটি তাকে শেখানো কাজটিকে জীবিকা হিসেবে নিয়ে সেটি থেকেই অর্থ উপার্জন করে স্বাধীনভাবে চলতে পারে।

এখন দেশে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এর ভয়াল থাবা থেকে বাঁচার জন্য সরকারি ভাবে সকল স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরাও এই ঘোষণার সাথে সাথে আমাদের স্কুলে প্রশিক্ষণ বন্ধ ঘোষণা করি। কিন্তু স্কুল বন্ধ হলেও শেখা বন্ধ হয়নি। আমরা অনলাইনে পাঠদান চালু রেখেছি। আমাদের সকল শিক্ষক নিজের বাসায় থেকে 'অনলাইনের' মাধ্যমে তার নিজের গ্রুপের ছাত্র ও প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়মিত ক্লাস করাচ্ছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অনলাইনে তাদের ক্লাস হচ্ছে। 'কুমো' নামে আমাদের প্রতিষ্ঠানের একটি নিজস্ব সফটওয়্যার আছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কাজের মূল্যায়ণ, 'ইনডিভিজ্যুয়াল টার্গেট প্ল্যান (আইটিপি) তৈরি, কেয়ার গিভারদের কাজের দক্ষতার মূল্যায়ণ, অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ ও তাদের সন্তানদের নিয়মিত অগ্রগতির মূল্যায়ণ, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথে রেফারাল সম্পর্ক তৈরি, বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে কার্যক্রম তৈরি ইত্যাদি করা যায়।

চারদিকে এত এত শঙ্কার মধ্যে থেকেও আমরা আমাদের কার্যক্রম অনলাইনে অব্যাহত রেখেছি, তার কারণ আমরা তাদের শিক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিই। আমরা চাই অবিরাম প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তারা যেন একটি সহজ স্বাভাবিক জীবন পায়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সমাজের আর দশজন মানুষের মতন সবাইকে সাথে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরু দায়িত্বটি পালন করতে পারে।

এক্ষেত্রে একটা বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে আমাদের 'অ্যাঞ্জেল শেফ' বেকারি। এই বেকারি শপটি পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্ট-এর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বেকারিটি মূলত পিএফডিএ'র ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। তারা যাতে নিজেদের কর্মসংস্থান নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারে সেজন্যই অ্যাঞ্জেল শেফ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আনন্দের ব্যাপার হলো শত বাধা-বিপত্তি আর প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও অ্যাঞ্জেল শেফ বাংলাদেশের যেকোনো পেশাদার বেকারির সাথে তুলনা করার মতন পণ্য তৈরি করে। আমাদের শিক্ষার্থীরা ২০১৫ সালে বেকারি ও ফুড সার্ভিসের উপর প্রশিক্ষণ নেয়ার পর এখানে কাজ করছে এবং ২০১৯ সালে 'অ্যাঞ্জেল শেফ' একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত 'অ্যাঞ্জেল শেফ' ১টি প্রোডাকশন সেন্টার, ১টি 'হট কিচেন' ও ৯টি আউটলেট পরিচালনা করছে যেখানে ১৭ জন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষ কাজ করছেন।

আমাদের শিক্ষার্থীরা যে শুধু পেশাদার তাই নয়, তারা মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে নিজেদের বারবার প্রমাণ করেছে। করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগের সময়ে সমাজের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতে না খেয়ে কষ্ট করতে না হয় সেজন্য 'অ্যাঞ্জেল শেফ' এর কর্মীরা তাদের স্কুলের সাথে যৌথ উদ্যোগে কাজ করছে। পিএফডিএ-ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার ট্রাস্ট ও অ্যাঞ্জেল শেফ, রাজধানীর মোহাম্মাদপুর, মিরপুর, বাড্ডা ও পুরাতন ঢাকা এলাকার ৫০০ দুঃস্থ-প্রতিবন্ধী মানুষ ও তাদের পরিবারের প্রত্যেককে ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি ডাল, ৫ কেজি আলু, ১ লিটার তেল, আদা, মসলা দিয়েছে যাতে করে এই দুর্যোগের সময়ে তারা না খেয়ে কষ্ট না পায়।

আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি, অটিজমের শিকার একজন মানুষ আর দশজন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে কোনোদিক দিয়ে কম নয়। তাদের দরকার শুধু একটি সহমর্মিতায় ভরা পরিবেশ, শেখার সুযোগ আর তাদের প্রতি সমতাপূর্ণ দৃষ্টি। এটুকু দিতে পারলেই এই মানুষগুলো সমাজের সবাইকে সাথে নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে, এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। এই বিশ্বাস নিয়েই পিএফডিএ ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার প্রতিদিন তার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য শিক্ষার দরজা খুলে দেয়।