করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আরটি-পিসিআর টেস্ট ল্যাবের দ্রুত সম্প্রসারণ প্রয়োজন

রুবায়েত হাসান
Published : 1 April 2020, 07:09 AM
Updated : 1 April 2020, 07:09 AM

সার্স-কোভিড-২ বা কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের ভয়াবহ মহামারীর মুখে, ট্রাভেল রেস্ট্রিকশন ও লকডাউনে সারা বিশ্ব যখন প্রায় বিপর্যস্ত, নতুন প্রজাতির এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকরী কোনো প্রতিষেধক বা টিকা যখন সুদূর প্রত্যাশী, রোগের বিস্তার রোধে অসহায় বিশ্ব তখন প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে আছে কোয়ারেন্টিন পদ্ধতি এবং সোশ্যাল আইসোলেশন পদ্ধতির উপর। আর কোয়ারেন্টিন পদ্ধতির মূলনীতি হলো- ল্যাব টেস্টের ভিত্তিতে সম্ভাব্য করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে চিহ্নিত করা এবং সে অনুযায়ী অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করার মূল পদ্ধতি হলো- আরটি-পিসিআর এর  মাধ্যমে রোগীর শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনা যেমন ন্যাসোফেরিঞ্জিয়াল সোয়াবে ভাইরাসের আরএনএ শনাক্ত করা। বর্তমান সময়ে যদিও আরটি-পিসিআর এর বিকল্প হিসেবে করোনাভাইরাসের এন্টিজেন বা এন্টিবডি ভিত্তিক অনেক রকমের টেস্ট বাজারজাত করা হচ্ছে বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, এসব টেস্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এন্টিজেন বা এন্টিজেন ভিত্তিক টেস্ট তুলনামূলক ভাবে সহজে করা গেলেও, যথেষ্ট পরিমাণ পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিত্তিতে এসব টেস্ট ডেভেলপ করা না হলে এবং এসব টেস্টের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভ্যালিডেশন না করা হলে, রোগের ভুল ডায়াগনোসিস হবার অনেক সম্ভাবনা থাকে। একারণে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে আরটি-পিসিআরকেই গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়।

করোনাভাইরাসের মহামারী রোধে ল্যাব টেস্টের গুরুত্ব বুঝতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোগের প্রাদুর্ভাবের হার দেখলেই বোধগম্য হয়। যেমন ইতালি, স্পেন এবং আমেরিকার মতো যেসব দেশ ব্যাপকহারে টেস্ট-এর ভূমিকাকে অবজ্ঞা করেছে, সেসব দেশ এখন চরম বিপর্যয়ের মুখে আছে। আবার জাপান, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ মারাত্মক ঝুঁকির মুখেও ব্যাপক হারে ল্যাব টেস্ট করার মাধ্যমেই রোগের প্রাদুর্ভাব এপর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। আইইডিসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আরটি-পিসিআর কিটের ভীষণ রকম স্বল্পতার মাঝে প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্যই টেস্ট করা হয়েছে বা হচ্ছে। তাই এসব টেস্টের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রকৃত অবস্থা রহস্যজনকভাবে আশঙ্কাজনকই থেকে যাচ্ছে। ধারণা করা যাচ্ছে, এতদিন ধরে আইইডিসিআর সীমিত সংখক ও ব্যয়বহুল কমার্শিয়াল টেস্ট কিটের উপরই নির্ভর করে আছে। অথচ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায়, ব্যয়বহুল কমার্শিয়াল টেস্টের কোনো প্রয়োজনই নেই।

যারা মাইক্রোবায়োলজি বা মলিকুলার বায়োলজি ল্যাবে কাজ করেন তারা জানেন, সুলভে আরটি-পিসিআর এর প্রয়োজনীয় উপাদান কিনে খুব সহজেই এসব টেস্ট ল্যাবে ডেভেলপ করা যায়। আর এসবের জন্য আইইডিসিআর-এ যথেষ্ট পরিমান আরটি-পিসিআর মেশিন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকলে, বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাহায্য চাওয়া যায়। উন্নত দেশের মতো, বাংলাদেশে হয়তো ক্লিনিকাল টেস্ট হিসেবে আরটি-পিসিআর খুব একটা প্রচলিত নেই, কিন্তু এমন অনেক রিসার্চ ল্যাব রয়েছে যেখানে প্রতিনিয়ত আরটি-পিসিআর করা হয়। কাজেই বাংলাদেশে ব্যাপক হারে এবং সুলভে আরটি-পিসিআর করার অবকাঠামো এবং দক্ষতা নেই তা নয়। আর কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের আরটি-পিসিআর করার জন্য বিস্তারিত পদ্ধতি তো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েই রেখেছে তাদের ওয়েবসাইটে সেই জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহেই।

আশার কথা হলো, সম্প্রতি আরটি-পিসিআর ল্যাবের সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআরবি ও শিশু হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। আরটি-পিসিআর করার জন্য ভলান্টিয়ার আহবান করা হচ্ছে। এই ভয়াবহ দুর্যোগকালীন সময়ে শুধু ক্লিনিকাল ল্যাব টেকনোলজিস্ট নয়, বিজ্ঞানী, গবেষণা কর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক – ল্যাবে কাজ করার যাদের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা রয়েছে, বিশেষ করে পাইপেটিং এর অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখা প্রয়োজন যে রিসার্চ ল্যাবে আরটি-পিসিআর করা আর ক্লিনিকাল টেস্ট হিসেবে আরটি-পিসিআর করার সাইন্সটা একই হলেও প্র্যাকটিসটা ভিন্ন। কারণ ক্লিনিকাল টেস্টের রেজাল্টের ওপর রোগীর ভালো-মন্দ, এমনকি জীবন-মৃত্যুও নির্ভর করে। তাই এ দুর্যোগকালীন সময়ে, ক্লিনিকাল টেস্ট করার প্র্যাকটিসটা শিখে নিতে হবে খুব দ্রুত। শিখে নিতে হবে এসব টেস্ট করার সময় নিজের নিরাপত্তার জন্য এবং টেস্টের নির্ভরযোগ্য ফলাফল নিশ্চিত করতে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

আরটি-পিসিআর টেস্ট মেথড নির্বাচন করার ক্ষেত্রে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া যেকোনো একটি পদ্ধতি বেছে নেওয়া উচিত, কারণ এসব টেস্ট যথেষ্ট পরীক্ষিত এবং পৃথিবীর অনেক লাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব টেস্ট নিয়ে তথ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্হার এই ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে: https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/technical-guidance/laboratory-guidance

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেসব টেস্ট সুপারিশ করছে সেসব নিজের ল্যাবে ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলো কিনা সেটা ঠিক ভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। রোগীর পরীক্ষা করার আগে টেস্ট ভ্যালিডেট করার জন্য আইইডিসিআর থেকে টেস্ট পজিটিভ এবং টেস্ট নেগেটিভ রোগীর স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে টেস্ট ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা।

কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস বায়োসেফটি-২ লেভেলের জীবাণু। এর মানে হলো ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় না করে খোলা ল্যাবরেটরি বেঞ্চে এ ভাইরাস নিয়ে কাজ করা নিরাপদ নয়। রোগীর স্যাম্পল নিয়ে হ্যান্ডলিং করার সময় তাই সব স্যাম্পলকেই সম্ভাব্য সংক্রামক বলে ধরে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তার খাতিরে বিশেষ ভাবে তৈরি বায়োসেফটি হুড যার ভিতরে ও বাইরে ভাইরাস আনাগোনা করতে পারবে না, কেবল তার ভেতরেই স্যাম্পল ভায়াল খুলতে হবে এবং ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা করতে হবে। স্যাম্পল কালেকশনের পর নিশ্চিত করতে হবে যে স্যাম্পল ভায়াল এর গায়ে রোগীর নাম ও জন্ম তারিখ বা আইডেন্টিফিকেশন নম্বর ঠিক ভাবে লেবেল করা হয়েছে। স্যাম্পল হ্যান্ডলিং করার সময় যথাযথ পিপিই ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে গ্লাভস এবং গাউন বা ল্যাব কোট। ল্যাবের কাজে অ্যারোসল তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকলে সেফটি গ্লাস, মাস্ক ও ফেস শিল্ড ব্যবহার করতে হবে।

পিসিআর বা আরটি-পিসিআর ভিত্তিক ক্লিনিকাল টেস্টের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো কন্টামিনেশন রোধ করা। কেননা পিসিআর বা আরটি-পিসিআর খুবই সেনসিটিভ পরীক্ষা পদ্ধতি। স্যাম্পলের মধ্যে দু-চারটা ভাইরাসের আরএনএ থাকলেই আরটি-পিসিআর পজিটিভ রেজাল্ট দিতে পারে। কাজেই স্ট্রং পজিটিভ স্যাম্পল যেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন কপি ভাইরাসের আরএনএ থাকতে পারে, সেখান থেকে দু-এক কণা অন্যান্য স্যাম্পলে চলে গেলে সেসব স্যাম্পলে ফলস পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে। আবার কন্টামিনেশনের মাধ্যমে স্যাম্পলে কোনো ভাবে 'আরেনেজ' এনজাইম, যা কিনা আরএনএ'কে ধ্বংস করে, তা মিশে গেলে আরটি-পিসিআর রেজাল্ট ফলস নেগেটিভ আসতে পারে। এসবের ফলাফল হলো রোগের ভুল ডায়াগনোসিস হওয়া, যা প্রতিরোধ করতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। প্রতিদিন কাজের আগে ও পরে সদ্য বানানো ১০% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইড ও ৭০% ইথানল দিয়ে বায়োসেফটি হুড, কাজের বেঞ্চটপ ও অন্যান্য সারফেস ডিকন্টামিনেট করতে হবে।

টেস্টের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিটি পিসিআর রান করার সময় নিশ্চিত করতে হবে যে, সঠিক কন্ট্রোল স্যাম্পল ব্যবহার করা হয়েছে এবং পিসিআর শেষ হবার পর নিশ্চিত করতে হবে যে পজিটিভ কন্ট্রোল, নেগেটিভ কন্ট্রোল, আরএনএ এক্সট্রাকশন (সম্ভব হলে) এবং পিসিআর ইনহিবিশন কন্ট্রোল সব প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করেছে। কোনো পিসিআর রানে হঠাৎ করে অনেক বেশি স্যাম্পল পজিটিভ রেজাল্ট দিলে কন্টামিনেশনের সম্ভাবনা আছে, সেক্ষেত্রে পুনরায় পরীক্ষা করে যাচাই করে দেখতে হবে রেজাল্ট ঠিক আছে কিনা। সাধারণত পিসিআর রানে একটা খুব স্ট্রং পজিটিভ স্যাম্পল থাকলে আসেপাশে দু-চারটা এলোমেলো পজিটিভ রেজাল্ট পেলে এরকমের সন্দেহ করা যেতে পারে। পিসিআর মেশিনের ক্যালিব্রেশন ঠিক আছে কিনা নিয়মিত চেক করতে হবে। কারণ মেশিন ঘন ঘন ব্যবহার করলে তাতে বিকারও দেখা দেয় অনেক বেশি। প্রতি সপ্তাহে মেশিনের ব্যাকগ্রাউন্ড ক্যালিব্রেশন করতে হবে। প্রতি ৬ মাসে একবার মেশিনের প্রিভেন্টিভ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। প্রতি মাসে এক ল্যাবের টেস্ট করা কিছু স্যাম্পল অন্য ল্যাবে পাঠিয়ে যাচাই করে দেখতে হবে টেস্ট ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা।

বাংলাদেশে রোগের প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করার আগেই, ব্যাপক হারে আরটি-পিসিআর করে প্রকৃত অবস্থাটা জানা একান্ত প্রয়োজন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। জরুরি ভিত্তিতে যথেষ্ট পরিমাণ টেস্ট করতে না পারলে সবচেয়ে বিপদে পড়বে হাসপাতালগুলো। একমাত্র টেস্ট রেজাল্টের ভিত্তিতেই সম্ভব হাসপাতালে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের আলাদা করা বা অন্যান্য মুমূর্ষু রোগীদের করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা। যেসব ব্যাক্তি, ল্যাব এবং প্রতিষ্ঠান এ মহাদুর্যোগে মানুষের সেবায় আরটি-পিসিআর করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগিয়ে আসছেন তাদের সাধুবাদ জানাই। এখন প্রয়োজন সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ ও সাহায্য। প্রয়োজন কোঅর্ডিনেশন এবং মনিটরিংয়ের, প্রয়োজন ট্রেনিংয়ের। আইইডিসিআর-এর নিয়ন্ত্রণের আওতায়ই এ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে টেস্টের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়, চাই টেস্টের মান নিয়ন্ত্রণ। আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবীদের ট্রেনিং দেবার জন্য এগিয়ে আসা প্রয়োজন ক্লিনিকাল ল্যাব টেকনোলজিস্টদের। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন গাইড হিসেবে। প্রয়োজন টেস্টের উপাদানের শুল্কমুক্ত আমদানি। প্রয়োজন টেস্ট রিএজেন্টের যেসব লোকাল ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে তাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। সবার উপরে প্রয়োজন পেশাজীবীদের একতা। এই মহাসংকটকালে সবাই যদি নিজেদের পেশাগত ইগো ভুলে এক না হতে পারে, এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনস্টারের শক্তির জোরে পালাতে হবে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে অচিরেই।

এখন যৌবন যার করোনা যুদ্ধে নামার তাই শ্রেষ্ঠ সময় তার! যার কাছে যাই আছে তাই নিয়ে, হাতুড়ি কোদাল নয়, মগজে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা, বুকে সাহস, হাতে পাইপেট, গায়ে ল্যাব কোট, চোখে আত্মবিশ্বাস আর করোনাবিহীন এক নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।