আসুন, একটু পিণ্ডি চটকাই

গৌতম রায়
Published : 31 March 2020, 01:59 PM
Updated : 31 March 2020, 01:59 PM
(লেখাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে)
ভারতে সেভাবে মুসলিমদের দিকে আমরা ফিরেও তাকাইনি কখনো। কৌতুকে, করুণায় তাদের নিয়ে দলের আখের গুছিয়েছি। আর এই অপরাজনীতিকেই রাজনীতি বলে চালিয়ে রাজনীতি সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছি। একটা দশ ফুট বাই দশ ফিটেরও থেকে ছোট ঘরে একটি পরিবার কিভাবে প্রাণধারণ করে তার সুলুক সন্ধান করিনি। কেবল বলে গেছি, মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে। হ্যাঁ, এই কথা আমরা প্রগতির ধ্বজাধারীরা চায়ের ঠেকে, পাড়ার মোড়ে নিরন্তর চর্চা করেছি, এখনও করছি।
আবার মাইক ফুঁকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মায়াকান্নাও কেঁদেছি। পাস্ট টেন্স কেন? এখনও নাটক নামাচ্ছি।ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা যে ভালো কমুডিটি। তাঁদের নিয়ে একটু মায়াকান্না কাঁদলে যে আমার বক্স অফিস হিট করবে! 'প্রগতিশীলে'-র তকমা জুটবে!
অথচ, এই লক ডাউনের দিনে একটা কুঠুরির ভিতর আটকে থেকে তারা স্বাস্থ্যবিধি কেন মানছেন না- এই শীবাকীর্তনে বেশ প্রগতিশীলতা আছে, তাই না? রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, খিদিরপুর নিয়ে চিল চিৎকার জুড়ে দিলেই তো আমি প্রগতিশীল, তাই না? কোমরের ঘুনসিতে শ্বেত অপরাজিতার শেকড় এঁটে, চাপ দাড়ি আর শান্তিনিকেতনী ঝোলা কিংবা সাদা খোলের লাল পেড়ে শাড়িতে ধ্যাবড়ানো টিপে কপাল ল্যাপটানো- বড্ড বেজায় রকমের প্রগতিশীল ঠাওড়াবে আমাকে সমাজ, তাই না?
আসুন, এই সুযোগে 'মোছলমান'দের একটু ষষ্ঠী পুজো করে আমরা এখন প্রগতিশীল সাজি। এখন তো রাজনীতি করবার সময় না, তাই না? এখন তো নিরপেক্ষ থাকবার কাল। আমরা নিরপেক্ষতাবাদীরা আসুন এখন একটু মুসলিমরা কতো পরিমাণে লক ডাউন মানছেন না, তাই নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে 'চায়ে পে চর্চা' করি।চা ছাড়া তো এখন আর কোনও উপায় নেই। মাল যা স্টক করেছিলাম, এই লক ডাউনের কালে, সব ট্যাবু ভেঙে ছেলে-মেয়েদের সাথে ভাগ করে খেতে খেতেই ফুরুত। তাই অগত্যা 'মোছলমান'দের পিণ্ডি চটকাই।বেশ খই ভাজার মত কাজ হবে তাই না? আংড়াটা গরম করে দিলে, বিন্নি ধানের খই বেশ কুর্চি ফুলের মতই ফুটে উঠবে। কী বলেন?
আংড়া যদি গরম হয়, লাভ কার বা কাদের হবে? লাভের গুঁড় কি পিঁপড়ে তে খেতে পারবে? রাজাবাজার, পার্ক সার্কাস, মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ, খিদিরপুর- বড্ড বেশি সফ্ট টারগেট, তাই না? আচ্ছা, যখন মুসলিমদের টাকাতেই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের একটা অংশকে ঢোল দিয়ে মুসলিমদের আরো বেশি রকমের নরম আক্রমণের লক্ষ্যস্থল করে তুলতে বেছে নেওয়া হয়েছিল, তখন যাঁরা আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম, তাদের পেটে ভাত কোথায়? চাকরি কোথায়? স্বাস্থ্য কোথায়? শিক্ষা কোথায়? তখন কিন্তু একদল আরো বেশি করে হিজাবের আর মোনাজাতের ফটো শ্যুটে ব্যস্ত থেকেছেন। আর একদল ব্যস্ত থেকেছেন, তোষণ তত্ত্ব নিয়ে।
কেউ একটিবারের জন্যও বলেননি, ইমাম-মোয়াজ্জিনের ভাতার থেকেও অনেক বেশি জরুরি ইমাম, মোয়াজ্জিনের ঘরের ছেলে-মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার পরিমণ্ডলে আনাটাই মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ধ্যানধারণাকে অস্বীকার না করেও  আধুনিকতার যাপনচিত্রে অভ্যস্ত করে তোলবার একমাত্র সোপান। আর সেই আধুনিকতার চর্চা যদি রাজনীতি ব্যতিরেকে আমরা করতাম, আজ এই করোনাভাইরাস সংক্রমণের কালে- গোটা মানবসভ্যতার এই চরম বিপর্যয়কালে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশকে এইভাবে মনুষ্যেতর জীবনকে বেছে নিতে হতো না।
হাইজিন রক্ষা সব থেকে বড়ো ক্রাইটেরিয়া যে ভরপেট খাবার, একটু মানুষের মতো মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের উপরে সবথেকে বেশি নির্ভর করে, এটা আমাদের দেশের রাজনীতিকরা, দল নির্বিশেষে, রাজনীতির কারবারীরা আজও বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকেন। তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের তাদেরই টাকাতে দুই-চারটে টাকা দিয়ে তাঁদের 'কৃপা ' করবার যতোই আত্মম্ভরিতা দেখানো হোক না কেন, তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার এতোটুকু অদলবদলে একটি ন্যূনতম পদক্ষেপও দেখানো হয় নি। তা যদি হতো, তাহলে আজ সচেতনতা বুঝেও একটা দশ বাই দশের থেকেও ছোট ঘরে বাবা-মা- ভাই-বোন-বৌ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে মেটিয়াবুরুজ বা পার্ক সার্কাস কিংবা রাজাবাজারে 'তোষিত' সম্প্রদায়ের মানুষকে মৃত্যুর হাতছানি বুঝেও বিজ্ঞানকে বেপরোয়াভাবে এড়িয়ে চলতে বাধ্য হতে হত না।
আজ কি একটিবারের জন্যেও আমার মনের কোণে এই বাস্তব ভাবনাটা জেগে উঠছে যে,  এই 'তোষিত' সম্প্রদায়কে খুশি করতে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নিগড়ে জড়িয়ে থাকা মানুষদেরকেই তাদের পিতৃপুরুষদের হকের টাকা থেকে দুই-চারটে পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির তুরীয় অবস্থায় পৌঁছবার থেকে অনেক বেশি জরুরি ছিল? তাদের আধুনিক শিক্ষা, বিশেষ করে প্রযুক্তিমুখী শিক্ষায় গড়েপিটে নেওয়ার প্রয়াস দরকার ছিল? একজন মুসলিমকে তার জন্ম থেকে কবরে যাওয়া ইস্তক বেশ কিছু ধর্মীয় বিধিবিধান মানতে হয়। এই বিধিবিধান মানবার ক্ষেত্রে স্ব সম্প্রদায়ের সমবেত অংশগ্রহণটাও জরুরি।
পবিত্র ইসলাম মানব সভ্যতাকে ভ্রাতৃত্ববোধের এই যে অমোঘ , করুণাঘন শিক্ষা দিয়েছে, তা বিশ্বের অপর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে মেলে না। একক সাধনার ভিতর দিয়ে একক তৃপ্তি, মোক্ষ নয়, সন্মিলিত সাধনার ভিতর দিয়ে সন্মিলিত উন্মীলন- পবিত্র ইসলামের এই শিক্ষা যদি আমাদের কর্তাব্যক্তিরা প্রকৃতপক্ষে হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন, তাহলে আজ মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকে, তাদের হকের ওয়াকফের টাকা থেকে ঢোল হিসেবে দুই-চারটে পয়সা করুণার দান দিয়ে 'মসীহা' সাজবার স্পর্ধা দেখাবার সাহস করতেন না।
আজ যদি মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশ অর্থনৈতিকভাবে একটু কোমর সোজা করতে পারতেন, তাহলে কি এইভাবে দশফিট বাই দশ ফিটের থেকেও ছোট, ঘর নামক একটা ঘুপচিতে গোটা পরিবার পরিজন দিয়ে বাস করতে বাধ্য হতেন? যারা আজ রাজাবাজার, মেটিয়াবুরুজের নাম করে অন্য জায়গার ভিডিও সামাজিক গণমাধ্যমে আপলোড করে নিজেদের প্রগতিশীলতা, উন্নত মানসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে ব্যস্ত, তারা কি জানেন, মুসলিম সমাজে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বিধবা, অনাথ , স্বামী পরিত্যক্তা, ভাগ্য বিড়ম্বিত নারীর হিন্দু সমাজের মতো অবহেলিত অবস্থা হয় না বললেই চলে।
আজও প্রগতিশীল ধ্বজা বেঁচা হিন্দু সমাজের একটি বড় অংশ নিজেদের পরিবারে যদি বিধবা, দুস্থ কোনো নারী থাকেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সচেষ্ট থাকেন, সেই নারীটির দায় এড়াতে। আগের দিনে কাশী বা বৃন্দাবনে পাঠানো হতো এইসব নারীদের পুণ্যের লোভ দেখিয়ে দায় ঝেরে ফেলতে।
এই ছবিটা মুসলিম সমাজে নেই বললেই চলে। যারা তাৎক্ষণিক তিন তালাক ঘিরে জল ঘুলিয়ে মুসলিম সমাজে নারীর দুরবস্থা নিয়ে সোচ্চার, তারা মুসলিম সমাজের এই অনুপম সামাজিক বৈশিষ্ট্যের খবরই রাখেন না।প্রগতিশীল সমাজ, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার ভেক ধরলেও যাঁদের একটা অংশ দাগী মুসলিম বিদ্বেষী, তাঁরা মুসলমান সমাজের এই সামাজিক বৈশিষ্ট্য জানবার, বুঝবার চেষ্টাই কোনোদিন করেননি। তারা হিন্দুর মরাতে মুসলমান কাঁধ দিচ্ছেন- এখানেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সবটুকু ধরে নিতে অভ্যস্ত। মুসলিম সমাজকে অনুভব করবার মতো অনুভূতিশূন্য এই প্রগতিশীল সমাজের সুগারকোটিং উঠে যাওয়া কদর্য চেহারাটা আমরা দেখতে পাই দাঙ্গা, গণহত্যা, মহামারীর মতো বড় রকমের সামাজিক সঙ্কটের কালে। যেমনটা দেখতে এই করোনাভাইরাসজনিত সঙ্কটের কালে আমরা পাচ্ছি।
সঙ্কটকাল যেমন ব্যক্তির জীবনে বন্ধু চেনার একটা সুবর্ণকাল, তেমনি মুখোশধারীদেরও সমাজের চেনবার কাল। প্রগতির মুখোশ পরে কতো যে লোক নকল নবিশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে , সঙ্কট না এলে মানুষ যেমন বোঝে না। সমাজ ]ও তেমন বোঝে না। এক ' বাউন্ডুলে'কে দেখে এইসব ভাবনা মাথায় চিড়বিড় করে উঠেছিল। সেই ' বাউন্ডুলে' স্কুল শিক্ষক। প্রগতির খই ফোটান । এক বামপন্থী সর্বভারতীয় ছাত্র নেতার ছোটবেলাকার মাস্টারমশাই। ফলে প্রগতির আউটরাইট বেশ খানিকটা তার জন্মগত অধিকার, এটা তিনি ধরেই নিয়েছেন।
সেই 'বাউন্ডুলে' আবার 'থ্যেটার' (থিয়েটার) করেন। সুতরাং প্রগতি আর আঁটে না। চাপ দাঁড়ি, ঝোলা ব্যাগ, বিড়ি ফোঁকা, পরের ঘাড় ভাঙতে পারলেই মালের ফোয়ারায় বকুনির ফুলঝুড়ি। এইসবের ভিতরেই ওদের উচ্চারণে 'স'-র উচ্চারণটা একটু বেশি প্রমিনেন্ট করে। ওদের মানে কাদের? অবশ্যই , 'নেড়ে'-দের। দুপাত্তর পেটে পড়লেই এঁদের 'মোছলমান' হয়ে যায়, 'নেড়ে'। যেমনটা- বাংলাদেশের ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে , 'হেঁদু' হয়ে যায়, 'মালাউন'। আসলে এই আরবি শব্দের অর্থ যে, অভিশপ্ত, এটা এরা জানেই না। সত্যিই তো, এই সমাজে সংখ্যালঘু- তা তিনি ধর্ম, ভাষা,লিঙ্গ যে ভিত্তিকই হোন না কেন, তিনি যে অভিশপ্ত, এই চরম সত্যটা বুঝে হোক, না বুঝে হোক, এই সামাজিক আবর্জনারা উচ্চারণ করেই ফেলে।
কেন আজও কলকাতা শহরে মুসলিমরা এমন জায়গাতে থাকতে বাধ্য হন যেখানে মুসলিম জনঘনত্ব বেশি? হ্যাঁ, চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনকাল আর প্রায় দশ বছরের মমতার শাসনকালের পরেও কেন উচ্চবিত্ত থেকে 'হা অন্ন' মুসলিমরা অমুসলিম জনঘনত্বপূর্ণ পাড়াতে জমি কেনা, ফ্ল্যাট কেনা, যদি তাদের সামর্থের ভিতরে থাকে, তাও দূরস্থান, ভাড়া পর্যন্ত কেন পান না- এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? এই নিবন্ধকারের জন্ম এমন এক পাড়াতে যে বায়ু থেকেই  তখন নিঃশ্বাস নিতেন মণীষী কাজী আবদুল ওদুদ।
সেই পাড়াটি এখন কতোখানি তার পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে, তা ঘিরে রীতিমত সংশয় আছে। এই পাড়াটিতে যেসব হিন্দু পরিবার ছিলেন, এককালে হিন্দু-মুসলিম পরষ্পর পরষ্পরের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে বেঁচেছিলেন, সেই পরিবেশ কি এখন আর বজায় আছে? কেন বজায় নেই সে জবাব কে দেবে? সামাজিক পর্যায়গুলি দেখবার ক্ষেত্রে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলির উপর কেউ কখনো খুব একটা আশাভরসা করেন না। কিন্তু ভরসা তো গোটা সমাজ করে বামপন্থিদের কাছে।
ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময় পার্ক সার্কাস লাগোয়া পাম প্লেসে সুভাষচন্দ্র বসুর বন্ধু ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি পাহাড়া দিয়েছিলেন কলিম শরাফি এবং তার সহযোদ্ধা আইপিটিএ- এর সাংস্কৃতিক কর্মীরা। আর এখন সাংস্কৃতিক কর্মীর ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির বন্ধুরা প্রশ্ন তুলছেন, কেন রাজাবাজার, পার্ক সার্কাসের মতো বিশেষ জায়গার মানুষ সরকারি বিধি নিষেধ না মেনে লক ডাউন অমান্য করবার স্পর্ধা দেখায়! আসলে এই প্রশ্ন তোলার পিছনে যে বড় এবং লকলকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িয়ে থাকে, সেইসব ঘিরে প্রশ্ন তুললেই আপৎকালকে অমান্য করা হবে?