করোনাভাইরাস সংক্রমণে কেন ঝুঁকিতে দক্ষিণ এশিয়া ও উচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ?

মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম
Published : 31 March 2020, 10:46 AM
Updated : 31 March 2020, 10:46 AM

এ লেখাটি যখন লিখছি তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ২০৩টি দেশ, এলাকা বা ভুখন্ডে ৩০ মার্চ ২০২০ তারিখ (২২.২৩ জিএমটি+৬) পর্যন্ত ৬,৯৩,২২৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যেই ৩৩,১০৬ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। আর জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যসূত্রে (৩১ মার্চ ২০২০-৩:৩০:১৮এএম) ৭,৭৭,২৮৬ জন সংক্রমিত হয়ে ৩৭,১৪০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে প্রতিদিনই এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়াতেও এ সংক্রমণ প্রতিনিয়তই ক্রমবর্ধমান। গত ২৮ মার্চ ২০২০ তারিখ পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ও জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যসূত্রে পাকিস্তানে ১৬২৫, ভারতে ১০৭১, শ্রীলংকায় ১২০, আফগানিস্তানে ১১৪ জন, বাংলাদেশে ৪৯, মালদ্বীপে ১৭, নেপালে ৫ ও ভুটানে ৪ জন সংক্রমিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতে ২৯ জন, পাকিস্তানে ১৮ জন, বাংলাদেশে ৫ জন, আফগানিস্তানে ৪ জন, শ্রীলংকায় ১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণে চীন, ইতালি, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর পরবর্তী 'হট স্পট' হতে পারে দক্ষিণ এশিয়া যেখানে বাংলাদেশ রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। ফলে এর কারণ অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা জরুরি।

উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব
পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হলো দক্ষিণ এশিয়া যেখানে প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ (১.৮৪১ বিলিয়ন (বিশ্বব্যাংক, ২০১৮) বসবাস করে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ২০১৮-এর তথ্যানুযায়ী, একক ভাবে ভারতে রয়েছে বিশ্বের ১৭.৯% (১.৩৫২ বিলিয়ন), পাকিস্তানে ২.৬% (২১২.২১৫ মিলিয়ন) এবং বাংলাদেশ ২.২% (১৬১.৩৫৬ মিলিয়ন) মানুষ। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)–এর 'স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিপোর্ট ২০১৯' এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬৮.১ মিলিয়ন। তবে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সংক্রান্ত জনসংখ্যা বিভাগের তথ্যানুযায়ী (২০১৭) প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাংলাদেশে ১২৬৫ জন, ভারতে ৪৫০, পাকিস্তানে ২৫৫.৬, নেপালে ২০৪, শ্রীলংকায় ৩৩২.৯ জন বসাবাস করে। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে রয়েছে ১৫০ আর যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫.৫ জন। উল্লেখ্য যে, সমগ্র দেশের প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম হলেও প্রদেশ/এলাকা/শহর ভিত্তিক বেশি জনঘনত্ব হওয়ার কারণে যেমন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার অনেক বেশি। যে সকল রাষ্ট্রে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি থেকে যায় যদি না সতর্কতামূলক প্রতিরোধ ও শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিরাজমান থাকে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে বাংলাদেশ- যেখানে করোনাভাইরাস খুবই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং যেকোনো মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এর মূল কারণ- দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটি সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে ঘনবসতিপূর্ণ হবার কারণে এবং মানুষের ব্যক্তিগত ও আচরণগত সুস্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা অনেক দুর্বল থাকায় পর্যাপ্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতে সহজেই এ ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে।

সীমিত শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও মানসম্মত পরীক্ষাগারের অপ্রতুলতা
করোনাভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত কৌশল বা পর্যায় প্রথমতঃ সনাক্তকরণ, দ্বিতীয়তঃ পরীক্ষা করা, তৃতীয়তঃ চিকিৎসা করা, চতুর্থতঃ আইসোলেট করা এবং পঞ্চমতঃ সংস্পর্শে যাওয়াদের চিহ্নিত করা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। একই সাথে- 'টেস্ট, টেস্ট এন্ড টেস্ট' বা পরীক্ষার উপর গুরুত্বদান করতে বলা হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারত আশানুরূপ ভাবে তা করতে পারছে না। অপর্যাপ্ত পরীক্ষাগার ছাড়াও এ অঞ্চলে রয়েছে পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত টেস্ট কিটের স্বল্পতা। ভারতে মার্চ ২০, ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সমগ্র দেশব্যাপী ১০০টি স্থানে আর বাংলাদেশে কেবল শুধু আইইডিসিআর থেকে টেস্ট করানোর সুযোগ রাখা হয়েছিল বিশেষায়িত মানসম্পন্ন পরীক্ষাগার ছাড়া করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা সম্ভব নয় বলে। শুরু থেকেই আরও বিশেষায়িত হাসপাতালে বা ল্যাবে এ পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা না রাখায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত (৩০ মার্চ ২০২০) টেস্ট করা হয়েছে– মাত্র ১৩৩৮ জনের যাদের মধ্যে নিশ্চিত ৪৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন। বর্তমানে পরীক্ষার পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরীক্ষার জন্য যান্ত্রিক উপকরণের পাশাপাশি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের প্রয়োজন সঠিক ফলাফল নিশ্চিতকরণের জন্য। বর্তমানে এ পরীক্ষা হার কম থাকায় ধারণা করা হচ্ছে, এ অঞ্চলে- বিশেষ করে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমিত প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। অধিকন্তু করোনা শনাক্তকরণে আমদানিকৃত ও ব্যবহৃত কীট কতোটা নির্ভরযোগ্য ফল দিচ্ছে সেটিও ভাবনার বিষয়। পর্যাপ্ত স্ক্রিনিংই হচ্ছে কী না সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আক্রান্ত কিংবা আক্রান্ত নয় তা জানাটা বেশ জরুরি। স্ক্রিনিং করতে না আসার কারণগুলোর মধ্যে ভয় যেন একটি। মানুষ এখানে রোগে ভুগলেও চিকিৎসকের কাছে সহজে যেতে যায় না, এমনকি ওষুধও খায় না। ফলে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারের স্বল্পতার পাশাপাশি চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ায়ও স্ক্রিনিং না হতে পারে। অধিকন্তু, বাংলাদেশে শনাক্তকরণের প্রথম দিকেই উপযুক্ত কিট ছিল না বা নেই বলে জানা যায়।

চিকিৎসাকর্মী ও হাসপাতাল শয্যার স্বল্পতা
দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেই জনসংখ্যা অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল। বিশ্বব্যাংক-এর তথ্যানুযায়ী (২০১৭), আফগানিস্তানে প্রতি হাজারে চিকিৎসক রয়েছে ০.৩ জনেরও কম। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক চিকিৎসক রয়েছে মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় প্রতি হাজারে ১ জন। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি ১০০০ মানুষের জন্য ডাক্তার রয়েছে ০.৮ যেখানে বাংলাদেশে ০.৫ জন। আর প্রতি ১০০০ মানুষের জন্য নার্স- মিডওয়াইফ রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় ১.৭ যেখানে বাংলাদেশে ০.৩ এবং ভারতে ২.১ জন। এ চিত্র স্পষ্টতই আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বল দিককে প্রতিফলিত করে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি ১০০০ মানুষের জন্য হাসপাতালে শয্যা রয়েছে মাত্র ০.৭ যেখানে বাংলাদেশে ০.৮, ভারতে ০.৭, পাকিস্তানে ০.৬ আর নেপালে ০.৩। এখানে লক্ষ্যনীয় যে, ইউরোপে ৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ জার্মানির আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২৮,০০০ আর ৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ইতালিতে এ মহামারীর পূর্বে ছিল মাত্র ৫০০০। ইউরোপের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহারকে হাসপাতালের সামর্থ্য ও সংক্রামিতদের বয়সের মানদণ্ডে ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে।

বিদেশ প্রত্যাগতদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে না রাখা কিংবা হোম কোয়ারেন্টাইলে যথার্থ মনিটরিং না করা
বিদেশ প্রত্যাগতদের স্ক্রিনিং, কাউন্সেলিং ও শতভাগ পরীক্ষা করা ছিল আবশ্যক। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণে দেশকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলেছে করোনাভাইরাস আক্রান্ত দেশ থেকে প্রবাসীরা দেশে ফেরায় এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে অব্যাহত না রাখায় এবং হোম কোয়ারেন্টিনে না থেকে সাধারণ মানুষদের সাথে মিশে যাওয়ায়। চীনের উহান থেকে ফেরাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হলেও ইতালি ফেরতদের ক্ষেত্রে তা না করে বলা হলো হোম কোয়ারেন্টাইলে থাকতে। কিন্তু 'হোম কোয়ারেন্টিন বলা যত সহজ বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায়' প্রয়োগ ততই কঠিন। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞার পরও বিদেশী এয়ারওয়েজ ইউরোপের এপিসেন্টার ইতালি ও অন্যান্য দেশ থেকে যাত্রী নিয়ে এসেছে ঢাকায় যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে সিদ্ধান্তহীনতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনায় আরও ঝুঁকিতে এখন বাংলাদেশ। তাছাড়া ছিল না সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর কিংবা বিমানবন্দরগুলোতে পর্যাপ্ত চেকিং কিংবা স্ক্রিনিং উপকরণ। গত ২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর জাতির উদ্দেশ্য প্রদানকৃত ভাষণ থেকে জানা যায়, ঐদিন পর্যন্ত ৬৫৮৯৮১ জনকে বিদেশ থেকে আগত বিভিন্ন পথে দিয়ে দেশে প্রবেশকৃত ব্যক্তিদের স্ক্রিনিং-এর আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- অপর্যাপ্ত থার্মাল স্ক্যানার ও ব্যবস্থাপনার ঘটতিতে তাদেরকে সঠিকভাবে স্ক্রিনিং করা হয়েছে কী? ফলে দেশে এন্ট্রিতে বাধা না দেওয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে না পাঠানোর ফলে দেশের সব নাগরিকরা এখন করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তবে ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, যেসব দেশ ও অঞ্চল সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পেরেছে সে সকল দেশ সফলকামও হয়েছে। চীনের উহানে আক্রান্তের হার বেশি হলেও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করায় দেশজুড়ে সংক্রমণের হার ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ফলে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে চলতে পারলে এ মহামারী নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। জানা যায় জানুয়ারি ২০২০ থেকে সাড়ে ছয় লাখ মানুষ দেশে এসেছেন। এর মধ্যে মার্চ মাসের ২০ দিনেই এসেছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার। এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই এসেছেন করোনাভাইরাস সংক্রমিত দেশগুলো থেকে যাদের মধ্যে মাত্র ১৮ হাজার বিদেশফেরত স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। দেশে আসার সময় সঠিক ঠিকানা না দেওয়া এবং পাসপোর্টের ঠিকানায় অবস্থান না করার কারণে বিদেশ থেকে ফিরে আসা এসব লোককে সহজে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ তবে তারা স্বাভাবিকভাবেই গ্রামে-গঞ্জে, হাটবাজারে ঘুরেছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এ বিদেশফেরতদের মধ্যে কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে তা কত মানুষের মধ্যে করোনা ছরিয়েছেন বা ছড়াচ্ছেন, সে বিষয়ে ধারণাই করাই দূরহ। ফলে দেশে ফিরে আসা এ মানুষগুলো যদি স্বেচ্ছায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন না করেন, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, তাহলে এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে বাংলাদেশের জন্য। এ অবস্থার বিপরীতে বাংলাদেশের প্রস্তুতিও পর্যাপ্ত নয় যা ইতোমধ্যেই পরিলক্ষিত হয়েছে।

আইসোলেশন, আইসিইউ-ও ভেন্টিলেশনের অপ্রতুলতা
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ঢাকায় ১০০৫০টি সহ সমগ্র দেশে ১৪৫৬৫ টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জানা যায়, ঢাকার বাইরে করোনা আক্রান্তদের জন্য কোনো হাসপাতালে আইসিইউ বেড নেই। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গুরুতর রোগীদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে। দেশে ক্রিটিক্যাল রোগীদের এই সাপোর্ট দেওয়ার জন্য পাঁচটি হাসপাতালে মাত্র ২৯টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত রয়েছে বলে জানা যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে। ঢাকার বাইরে করোনা আক্রান্তদের জন্য কোনো হাসপাতালে আইসিইউ বেড ও ভেন্টিলেশন সুবিধা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ রোগীর আইসোলেশন ও আইসিইউ প্রয়োজন। এর মধ্যে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন পড়ে। আমাদের দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখেরও ওপরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট আইসিইউ বেড রয়েছে ১২৮৫টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে রয়েছে ২১১টি। প্রয়োজনের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই কম। তবে দেশে যে আইসিইউ বেড রয়েছে সেগুলোতে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেওয়া যাবে না। কারণ করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে কোনো আইসিইউতে ঢোকানো হলে সেখানে থাকা অন্য রোগীরাও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। করোনাভাইরাস অত্যন্ত ছোঁয়াচে। আর যেসব মানুষের কোমরর্বিডিটি আছে বা ইমিনিউটি কম, তারা এ রোগে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যে হাসপাতালগুলোতে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হবে সেগুলো ডেজিগনেটেড হসপিটাল হতে হবে। সেখানে অন্য কোনো রোগীর চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। করোনাভাইরাস আক্রান্তদের আলাদা আইসিইউর ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমাদের দেশে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কমিউনিটিতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে যে পরিমাণ আইসিইউ বেড দরকার হয়েছে, যে পরিমাণ ভেন্টিলেটর দরকার সে তুলনায় আমাদের রয়েছে খুবই স্বল্প। জনসংখ্যা ও পারসেন্টজ অব সিনিয়র সিটিজেনের তুলনায় এ একেবারে কম। আইসিইউ বেডের সংখ্যা শিগগিরই আরও বাড়াতে হবে এবং প্রস্তুত রাখতে হবে। দেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠী ৮০ লাখ- যাদের সবচেয়ে বেশি আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে। জানা যায়, ঢাকার বাইরে কোনো হাসপাতালে করোনাভাইরাসের জন্য আইসিইউ বেড নেই।

ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) সুরক্ষা পোশাক-এর অপ্রতুলতা ও করোনা চিকিৎসায় ভীতি
ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) সুরক্ষা পোশাক-এর অপ্রতুলতা রয়েছে বাংলাদেশে। চিকিৎসক-নার্সদের ঠিকভাবে সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পিপিই সরবরাহ না হওয়ায় জ্বর-কাশি-গলাব্যথার রোগী হাসপাতালে এলেই দূরত্ব বজায় রাখছেন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকেরা। এক্ষেত্রে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট বা পিপিই হলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে মুক্ত থেকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত পোশাক নীতিমালা। এর আওতায় রয়েছে মেডিকেল মাস্ক, গাউন, গগলস, ফেস শিল্ড, হেভি ডিউটি গ্লাভস ও বুট। করোনাভাইরাসের উপসর্গ আছে—এমন রোগীকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) ছাড়াই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ জারি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ফলে ঐ নির্দেশ জারির পর চিকিৎসকদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দেয়। পরবর্তীতে তা প্রত্যাহারও হয়। আমাদের কী পরিমাণ পিপিই দরকার তার সঠিক প্রক্কলন না থাকা। জানা যায় যে, একটি পিপিই একবারের বেশি পরা যায় না। অথচ কোথাও কোথাও এক পিপিই ভাগ করে পরতেই নাকি বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সেসব সাহসী চিকিৎসক ও নার্সদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে তা না হলে তাদের নিজেদের জীবনের ঝুঁকি থেকে যাবে। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রস্তুতি হিসেবে তাদের পিপিই (সুরক্ষা পোশাক) পরিধান করতে হবে। এই পোশাক ছাড়া উপসর্গ আছে এমন রোগী যেন পরীক্ষা করা না হয়। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ জরুরি।

বিলম্বে লক ডাউন ঘোষণা করা কিংবা না করার সিদ্ধান্তহীনতা
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সমগ্র দেশব্যাপী লক-ডাঊনের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ ভেদে কিংবা নামভেদে পার্থক্য রয়েছে। ভারত যেভাবে লক-ডাউন নিশ্চিত করেছে তার বিপরীতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে লক-ডাউন বলেও তা ছিল ঢিলেঢালা। চীনে শুরুতেই লক ডাউন করেছিল প্রথমে শহর, তারপর হোবেই পুরো প্রদেশে। পরবর্তীতে প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও যাকে সন্দেহ হয়েছে তাকেই আইসোলেশন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। লক ডাঊনের পর আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী হাসপাতাল, প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য চলে স্যাটেলাইট নজরদারি সমন্বিত কার্যকরী ও দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণই চীনকে সাফল্য এনে দিয়েছে। আর জার্মানিও সামাজিক দূরত্ব প্রয়োগ (নাগরিকরা বাসায় অবস্থান করেছে), দুজনের বেশি মানুষের জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন দোকানপাট বন্ধ রেখেছিল সফল ভাবে যার ভালো ফলও পেয়েছে।

সচেতনার অভাব ও সংক্রমণকালে জনসমাগম এড়িয়ে না চলা
যেকোনো ধরনের জমায়েত করোনাভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ হলেও লক্ষ্য করা গেছে- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ধর্মীয় কিংবা কোনো উৎসব উপলক্ষে বড় ধরনের জমায়েতের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই যা করোনাভাইরাস সংক্রমণে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরান এবং মালয়েশিয়ার উদাহরণ উল্লেখযোগ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমণ এড়াতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে তখন ভারত, বাংলাদেশে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কাজে লোকসমাগম হয়েছে প্রচুর। বাংলাদেশে প্রতিটি মসজিদে জুমা ও প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ পড়া অব্যাহত রয়েছে। সচেতনতার অভাব ও রাজনৈতিক মিছিল-সমাবেশ, ওয়াজ মাহফিল-এ অংশগ্রহণ থেকে বিরত না থাকাও এখানে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতাদের দায়িত্ব হবে জনগণকে করোনা সম্পর্কে বোঝানো যেন জনসমাগম এড়িয়ে চলে, জনসমাবেশ এড়িয়ে চলে। হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন জীবাণুনাশক সঙ্গে রাখতে হবে। এসব করা না গেলে করোনাকে সংক্রমণের দ্বিতীয় স্তরে রাখা যাবে না। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর (কমিউনিটি) মধ্যে সংক্রমণে চলে যাবে- যা বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই সীমিত পরিসরে চলে এসেছে স্বীকারও করেছে আইইডিসিআর। মানুষকে কিভাবে সচেতন করা যায়, আর কি করা প্রয়োজন, সরকার কী পদক্ষেপ নিল তা আনুষ্ঠানিকভাবে জনগণকে জানানো প্রয়োজন।

অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর, নগরায়ণ, ভাসমান ও বস্তি জনগোষ্ঠী
জনমিতিক পরিমাপে দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার আকার ও ঘনত্ব ছাড়া এখানে মাইগ্রেশন বা স্থানান্তর পর্যালোচনা করা দরকার। এ অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে মূলতঃ গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর করে থাকে মানুষ। বাংলাদশেও তার ব্যতিক্রম নয়। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলটিতে বর্তমানে ৩৪% মানুষ নগরে বসবাস করা মানুষ। দিল্লি, মুম্বাই, ঢাকা পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি মেগাসিটির ৩টি। বাংলাদেশে ৩৭%, ভারতে ৩৪%, নেপালে ২০% এবং পাকিস্তানে ৩৭% মানুষ নগরে বসবাস করে। তবে উল্লেখ্য যে, এখানে নগর জনসংখ্যার ৩০.৫%-ই বস্তিবাসী যারা মূলত গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় জড়িত। বিশ্বব্যাংক- এর তথ্যানুযায়ী, বস্তিতে শহরে জনসংখ্যার মধ্যে বাংলাদেশে ৫৫%, ভারতে ২৪%, এবং পাকিস্তানে ৪৫.৫% বসবাস করে। এ সকল বস্তিবাসীর জীবনের গুণগত মান উন্নয়ন বিশেষ করে স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ। এখানে নগর জনসংখ্যার উচ্চ ঘনবসতি রয়েছে। তাছাড়া ভাসমান, বস্তিবাসী ও নিম্ন-আয় ও বেকার মানুষের অপূর্ণ চাহিদাও এখানে বেশি। বস্তির পরিবেশ, অপরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধ পানির অভাব লক্ষ্যনীয়। পরিষ্কার পানির অভাবে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মিডিয়ায় প্রচারিত বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়ার যে প্রচারণা তা বাস্তবায়ন বস্তিতে যেন বিশেষ এক চ্যালেঞ্জ। দেশজুড়ে যদি করোনাভাইরাসের গণসংক্রমণ হয় তাহলে অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা এ সকল বস্তির নিম্নবিত্তের মানুষ যারা শহরে রয়েছেন কিংবা লক-ডাউনের মতো কর্মসূচিতে স্থান পরিবর্তন করেছেন তারাই হতে পারেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

বাস্তুচ্যুত, শরণার্থী ও রোহিঙ্গা শিবিরে ঝুঁকি
দক্ষিণ এশিয়ায় কয়েকটি দেশেই রয়েছে বাস্তুচ্যুত ও শরণার্থী জনগোষ্ঠী। জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ক্যাম্পে গাদাগাদি করে বাস করছে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রিফিউজি ক্যাম্প হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিফিউজি ক্যাম্প যেখানে রয়েছে ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা যারা মাত্র ১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় অবস্থান। ফলে অধিক উচ্চ ঘনবসতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং মানুষের আনাগোনার কারণে এসব ক্যাম্পে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি তুলনামূলক অনেক বেশি। স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে স্যানিটাইজার, সাবান ও মাস্ক ব্যবহার সেখানে বেশ সীমিত। ফলশ্রুতিতে এ ক্যাম্পগুলো নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে রয়েছে আতঙ্ক যদিও এখনও সেখানে কোনো করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়নি। উল্লেখ্য যে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যেন এক বিশেষ চ্যালেঞ্জ। ফলে এখানে রয়েছে উচ্চ ঝুঁকি।

অপ্রতুল প্রস্তুতিতে ঝুঁকিতে কারাবন্দি জনসংখ্যা
দক্ষিণ এশিয়ার কারাগারগুলো ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি জনবহুল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দি (প্রায় নব্বই হাজার) রয়েছে। পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে অধিক বন্দির অবস্থান ও স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থার অপ্রতুলতায় সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে এ কারাবন্দিরা। জানা যায়, দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে নাকি স্থাপন রয়েছে থার্মাল স্ক্যানার। কারাগারগুলোতে নিম্নমানের ভেন্টিলেশন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ। এক্ষেত্রে কোনো কারাগারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলে তা হবে বেশ আশংকাজনক।

অপ্রতুল স্বাস্থ্য বরাদ্দ, স্বাস্থ্য ব্যয় ও দারিদ্য
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকার স্বাস্থ্য খাতে তুলনামূলক অনেক কম বরাদ্দ করে থাকে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকে অনুসরণ করা হয় না। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (২০১৪) -এর তথ্যানুযায়ী এ অঞ্চলে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় অপ্রতুল- বাংলাদেশে জিডিপির ২.৮%, ভারতে ৪.৭%, পাকিস্তান ২.৬%, নেপাল ৫.৮%, শ্রীলংকায় ৩.৫%, এবং ভুটানে ৩.৬%। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম ব্যয় করা হয়। ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবার খরচ অনেক বেশি যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। এ স্বাস্থ্য ব্যয়ের কারণে মানুষ দরিদ্রমুখে পতিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও ১৬.১% মানুষ আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা (১.৯ ডলার) নীচে দারিদ্র্য পীড়িত জনগোষ্ঠী (২৭৫.৪ মিলিয়ন, বিশ্বব্যাংক ২০১৩)। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী (২০১৬), আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাংলাদেশে রয়েছে ১৪.৮%, ভারতে ২১.২% ও নেপালে ১৫%। এখানে ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবার খরচ ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী ক্রনিক রোগ যেমন ডায়বেটিস, কিডনি, হার্ট সম্পর্কিত রোগও বেড়ে যাচ্ছে। সাথে যুক্ত হচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি। ফলে ব্যয় ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় করোনাভাইরাসের ন্যায় নতুন মহামারী মোকাবেলা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি।

জনসংখ্যার বয়স-লিঙ্গ কাঠামোতে ভিন্নতা
জনমিতিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বয়স ও লিঙ্গভেদে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। মুলতঃ প্রবীণ ও পুরুষ জনগোষ্ঠী এক্ষেত্রে অধিকতর সংক্রমিত হলেও অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- যারা ৫০ বয়সের নীচে রয়েছে তারাও বেশি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। তবে বেশি বয়স্করাই অধিকতর মৃত্যুঝুঁকিতে যা বৈশ্বিক উপাত্তে লক্ষ্যনীয়। ইতালিতে এখন পর্যন্ত (২৮ মার্চ ২০২০) সবচেয়ে বেশি (৯১৩৬ জন) মৃত্যুবরণ করেছে যাদের অধিকাংশই হচ্ছে বয়স্করা। স্পেন ও ইতালিতে বয়স্ক জনগোষ্ঠী (৬০ বছর ও বেশি) ২০-২৫% যা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল যেমন এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে ভিন্ন। বয়স্ক এ মানুষদের সাথে অন্যন্য রোগ থাকলে যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ফুসফুসে সমস্যা তাদের করোনাভাইরাসে অধিকতর মৃত্যু ঘটেছে। পক্ষান্তরে, বয়সের মানদণ্ডে বর্তমানে বাংলাদেশে ৮.১% মানুষ ৬০ বছর কিংবা উপরে (বিবিএস ২০১৭) আর জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের ওয়ার্ল্ড পপুলেশন এইজিং রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী ৬৫ বছর ও উপরে জনগোষ্ঠী রয়েছে ৫.২%। ভারতে ৬৫ বছর ও উপরে জনগোষ্ঠী ৬.৪%, পাকিস্তানে ৪.৩%, নেপালে ৫.৮%, শ্রীলংকায় ১০.৮% এবং ভুটানে ৬.১%। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এ বয়স্ক মানুষরা অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্তদের অধিকাংশই পুরুষ এবং মধ্যবয়সী। ফলে করোনা প্রতিরোধে এ অঞ্চলের সরকার প্রধানদের স্ব স্ব দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রান্তিক অঞ্চলের জনসংখ্যা ও জনমিতির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার এখনই সময়।

শেষ কথা, বিশ্বে প্রতিদিনই করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। পাকিস্তান ও ভারতে সংক্রমণ বাড়লেও বাংলাদেশে যেন তা স্থিতাবস্থায় রয়েছে। এ নিয়ে জনমনে ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে প্রশ্ন রয়েছে। কম পরীক্ষা করাকেই দায়ী করা হচ্ছে। সেটা বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অত্যন্ত ঘন জনবসতি, দুর্বল স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থা (রোগ নির্ণয়ের জন্য পর্যাপ্ত পরীক্ষা-উপকরণের অভাব, বিশ্বাসযোগ্যতায় ঘাটতি, প্রশিক্ষিত প্রয়োজনীয় লোকবলের স্বল্পতা, কোয়ারেন্টিনে রাখার স্থানের অভাব), স্বাস্থ্যখাতে অর্থাভাব, বাস্তুচ্যুত/শরণার্থী, দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় মানুষদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বিশ্বের অন্য অঞ্চলের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। এ বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কৌশল কী হওয়া উচিত, তা নির্ণয় অত্যন্ত জরুরি। সমন্বিত কর্মকৌশলে সুস্পষ্ট জাতীয় ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা থাকা দরকার। কৌশলগত পর্যায়- যেমন স্ক্রিনিং, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন ও চিকিৎসার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সুতরাং প্রতিটি স্তরেই সুনির্দিষ্ট কৌশলের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। আনুষঙ্গিক যে কাজগুলো এখনো সম্পন্ন করা যায়নি কিংবা বর্তমানে ঘটছে ও ভবিষ্যতে তা যেন বিস্তার না ঘটে যেমন, দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা চীনে দেখা দিয়েছে তা প্রতিরোধে আমাদের আগাম প্রস্তুত থাকতে হবে। করোনাভাইরাস মোকাবিলার প্রস্তুতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে ব্যবস্থাপনা কৌশল ঠিক করে দিয়েছিল, সতর্কও করেছিল তার জন্য বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো প্রায় তিন মাস সময় পেয়েছিল। সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রয়েছে বললেও এখন প্রস্তুতির ঘাটতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। ফলে তা স্বীকার করেই সংক্রমণ ও মৃত্যুরোধে সঠিক ও নির্ভরযোগ্য-বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে- স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। দেরী হয়ে গেলেও এ মহামারী ও তার বহুমুখী প্রভাব নিরসন কল্পে এখনই সময় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন। আর তা না হলে সামনে দক্ষিণ এশিয়া-বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে এক ভয়াবহ বার্তা।