উইকিলিকস ও বাকস্বাধীনতা

অলিভার স্টোন
Published : 6 August 2014, 06:16 AM
Updated : 26 August 2012, 03:31 PM

আমাদের যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কুৎসিত দিকগুলো দেশের নাগরিকদের জানাতে প্রায়ই ব্যর্থ হয় আমাদের সংবাদ মাধ্যম। এই ঘটনাটি তুলে ধরতে চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবে আমরা আমাদের পুরোটা সময় ব্যয় করেছি। এ বিষয়ে উইকিলিকসের সাফল্যে আমরা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত। লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় নেয়া উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ইকুয়েডরের কূটনৈতিক ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলোর প্রতি সম্মান দেখিয়েছে ইকুয়েডর। আরও যা গুরুত্বপূর্ণ, কূটনৈতিক সম্পর্কের অলঙ্ঘনীয় নীতিগুলো অমান্য করে ব্রিটিশ সরকার ইকুয়েডরের দূতাবাসে অভিযান চালিয়ে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। তা সত্ত্বেও ইকুয়েডর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি, যা তুলনারহিত।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে উইকিলিকস বাগদাদে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপাচি হেলিকপ্টারের হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের ফুটেজ জনসম্মুখে ফাঁস করে দেয়; ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রকৃত চেহারার বিস্তারিত তুলে ধরে; ইয়েমেনে বোমাবর্ষণের দায়দায়িত্ব আড়াল করার উদ্দেশ্যে সে দেশের একনায়কদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন আঁতাতের তথ্য প্রকাশ করে দেয়, নির্যাতনের অভিযোগে বুশ আমলের কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি না করার জন্য ইয়েমেনের ওপর ওবামা প্রশাসনের চাপ দেওয়াসহ আরও অনেক গোপন তথ্য প্রকাশ করে।

প্রত্যাশিতভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের এ সব বিষয়ে যারা অন্ধকারে রাখতে চায় তারা এতে প্রতিক্রিয়া দেখায়। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট উভয় দলের নির্বাচিত শীর্ষ নেতারা অ্যাসাঞ্জকে "হাইটেক সন্ত্রাসী" হিসেবে আখ্যায়িত করে। সিনেটের গোয়েন্দা বিষয়ক বাছাই কমিটির প্রধান ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেট নেতা সিনেটর ড্যানি ফেইনস্টাইন অ্যাসাঞ্জকে গুপ্তচরবৃত্তি আইনের অধীনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি তুলেন।

অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে সুইডেন কোনও সুনির্দিষ্ট অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনেনি, এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা সুইডেনের অনেক মানুষই জানে না। ২০১০ সালের একটি যৌন-অসদাচরণের অভিযোগে সুইডেন অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে মাত্র।

সুইডেনের বিচারব্যবস্থার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ার মতো কোনও দেশে গমনের আগে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে আনা এ সব অভিযোগ অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। কিন্তু অ্যাসাঞ্জ নয়, তদন্তের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্বয়ং ব্রিটিশ ও সুইডিশ সরকার।

যে কোনও সময় প্রয়োজন মনে করলে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ অন্য দেশে গিয়ে অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারত, লন্ডনে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য অ্যাসাঞ্জ তার প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছিলেন। তার ওপর, লন্ডনের ইকুয়েডরের দূতাবাসে অ্যাসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ইকুয়েডর সরাসরি সুইডেনের কাছে প্রস্তাব রাখে। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই সুইডেন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হবে না সুইডেন সরকার এমন প্রতিশ্রুতি দিলে তাৎক্ষণিকভাবে সুইডেনে যাওয়ার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। এ প্রস্তাবে সুইডিশ কর্মকর্তারা কোনও আগ্রহই দেখায়নি। আর সম্প্রতি সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল বিল্ডট্ অ্যাসাঞ্জ ও উইকিলিকসের একজন আইনজীবীকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছেন এ ধরনের কোনও প্রতিশ্রুতি সুইডেন দেবে না। সুইডেনের সঙ্গে আইনি চুক্তি অনুযায়ী অ্যাসাঞ্জকে সুইডেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারও বাধা দিতে পারত। কিন্তু এ ক্ষমতা ব্যবহার করে কোনও আবেদন জানাতে অস্বীকৃতি জানায় ব্রিটিশ সরকার। এ বিষয়ে ইকুয়েডরের মধ্যস্থতার প্রস্তাবও প্রত্যখ্যান করে ব্রিটেন ও সুইডেন।

সামগ্রিকভাবে, ব্রিটিশ ও সুইডিশ সরকারের কার্যকলাপ আমাদের ধারণা দিয়েছে যে, তাদের মূল উদ্দেশ্য অ্যাসাঞ্জকে সুইডেনে নিয়ে যাওয়া। চুক্তি ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় সুইডেন থেকে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হয়তো অনেক সহজ হবে। এ ধরনের পরিণতি বিবেচনায় অ্যাসাঞ্জের ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। উইকিলিকস নিয়ে তদন্ত অব্যাহত রাখার কথা যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সম্প্রতি নিশ্চিত করেছে।

আর সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সরকারের গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে উন্মুক্ত করা নথিপত্রে দেখা যায়, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যাসাঞ্জের সম্ভাব্য অপরাধের খোঁজে যুক্তরাষ্ট্র তদন্ত চালিয়ে আসছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন গোয়েন্দা কর্পোরেশন স্ট্রাটফর-এর একটি ইমেইল প্রকাশ করে উইকিলিকস, এটি সাক্ষ্য দেয় অ্যাসাঞ্জের বিষয়ে একটি সিল করা অভিযোগপত্র ইতিমধ্যে একজন গ্রান্ড জুরির হাত ঘুরে এসেছে।

আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অ্যাসাঞ্জকে হস্তান্তরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনও চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে সুইডেন। ২০০১ সালে দুইজন মিশরীয় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীকে সিআইএ'র কাছে হস্তান্তর করে সুইডেন। সিআইএ ওই দুইজনকে মিশরের মুবারক সরকারের হাতে তুলে দিলে তারা নির্যাতনের শিকার হয়।

অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হলে এর ফলাফল বছরের পর বছর বিশ্বকে ভোগাবে। অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, যুক্তরাষ্ট্রের মাটি থেকেও তিনি কোনও তৎপরতা চালাননি। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যদি একজন সাংবাদিককে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে তবে একই যুক্তিতে রাশিয়া ও চীন সরকারও তা করতে পারবে। বিশ্বের যে কোনও জায়গায় বিদেশি কোনও সাংবাদিক রাশিয়া বা চীনের নিজস্ব আইন ভাঙলে তারা ওই সাংবাদিকের হস্তান্তর দাবি করতে পারবে। এ ধরনের উদাহরণ সবার জন্যই গভীর উদ্বেগের বিষয়, তিনি উইকিলিকসের গুণমুগ্ধ হন বা না হন।
আমরা ব্রিটেন ও সুইডেনের নাগরিকদের আহবান জানাব তাদের সরকারের কাছে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দাবি করার জন্য: অ্যাসাঞ্জকে লন্ডনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে কেন সুইডিশ কর্তৃপক্ষ অস্বীকৃতি জানাল? অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হবে না- কোনও সরকার এ প্রতিশ্রুতি দিতে পারল না কেন ?

পুরো বিশ্বের পক্ষ হয়ে বাকস্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোর এক বিরল সুযোগ পেয়েছে ব্রিটেন ও সুইডেনের নাগরিকরা।

ইংরেজি থেকে বাংলা তর্জমা: আফসার বিপুল।