তবু ভালো থাকুক মায়ের যাদুরা!

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 30 March 2020, 09:58 AM
Updated : 30 March 2020, 09:58 AM

করোনাভাইরাস মাত্র কয়েকদিনে অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। হয়তো ভবিষ্যতে আরো অনেক 'বদল' বা 'পরিবর্তন' দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। নিজ দেশে চোখে পড়ার মতো কয়েকটা 'বদল' উল্লেখ করা যায়-

এক. আগের কালে মানুষ হাজার বা লাখ টাকার মালিক হলে বাড়ির উঠোনে বা ছাদে হাজার বা লাখের 'বাত্তি' জ্বালাত। এখন বাসার আশেপাশে কোনো 'বিদেশ ফেরত' লোক থাকলে তাদের বাড়িতে যেয়ে লাল পতাকা টানিয়ে দিয়ে আসে! বগুড়ার নন্দীগ্রামে (২৬ মার্চ ২০২০, কয়েকটি জনপ্রিয় দৈনিকে এই খবর বেরিয়েছে) এমন ঘটনা ঘটেছে। যে বিদেশ ফেরতরা দেশের রেমিটেন্স বা বৈদেশিক মুদ্রা গড়ার আসল 'নবাবজাদা' তারা এখন লাল পতাকার নীচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। যেন তারা সবাই অপয়া, করোনাভাইরাসের বাহক! একটা জনপ্রিয় গানের কথা ছিল এমন- বিদেশ ঘুরে দেশে এলে/সাতগ্রামের সোনার ছেলে/ ভাইবন্ধু সবাই বলে জামা কাপড় আনছ নি/শুধু মায় বলে আমার যাদু ফিরা আইছ নি!

মায়ের যাদুদের আজ বড় দুঃখের দিন!

দুই. আগে কেউ মারা গেলে পরিচিতজন, আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ীরা মৃতের বাড়িতে যেত, চোখের জলে মৃতের সৎকার করত। মৃতের বাড়ির চুলো জ্বলতো না, খাবার-দাবারের দায়িত্ব নিত আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীরা। এখন কেউ মারা গেলে সবার মনে প্রথম প্রশ্ন জাগে- করোনায় মৃত্যু হয়নি তো? আর করোনায় মারা গেলে তার আশেপাশে ভাই-বোন, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কেউ তো যেতে চাইবেই না, উল্টো কেউ কেউ কবরস্থানে গিয়ে ব্যানার টানিয়ে দিয়ে আসবে, যে ব্যানারে লেখা থাকবে- এখানে যেন করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফন ও কবর দেয়া না হয়! ঢাকার খিলগাঁয়ের একটি কবরস্থানের গেটে টানানো ব্যানারের ছবি ভাইরাল হয়েছে।

বড় বেশি অমানবিক হয়ে গেছি আমরা?

তিন. আগে সিন্ডিকেট শব্দটাকে খারাপ চোখে দেখা হতো। মানুষ ভেবে নিত কোনো কোনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে দাম বাড়ায় এবং পরে বেশি দামে মানুষকে কিনতে বাধ্য করে। করোনাভাইরাস আসার পরে সারা পৃথিবীতেই মানুষের মধ্যে এই 'মজুদ' প্রবণতা বেড়েছে। যে যতটা পেরেছে কিনে রেখেছে যেন অন্তরীণ অবস্থায় খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়!

চার. হাসপাতালগুলোতেও এক ধরনের বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়েছে। কেউ সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি বা নিউমোনিয়া নিয়ে চিকিৎসার জন্য গেলেও নাকি তাদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে হাসপাতাল থেকে। বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস টেস্ট করার জন্য বিশেষায়িত বা নির্ধারিত হাসপাতালে যেতে। কোনো কোনো হাসপাতালের চিকিৎসকরা সংক্রমিত হবার পর এই ভীতি আরও বেড়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না! তবে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সাথে সবচেয়ে ঝুঁকি নিয়ে এই করোনাকালে যারা করোনাভাইরাসের রোগীদের সেবা করছেন এবং মানুষের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছেন তারা চিকিৎসক। তাদের জন্য হ্যাটস অব স্যালুট।

পাঁচ. অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা রীতিমতো সেলিব্রেটি এখন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে কতটা শাড়ি পরেছেন সেটাও মানুষ যেন ছবি তুলে রেখেছে। কিন্তু তিনি সংবাদ সম্মেলনে করোনাভাইরাস বিষয়ক আক্রান্ত ও মৃতের যে তথ্য দেন বেশিরভাগ মানুষ সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সহজাত বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে। কেউ কেউ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মসজিদে গিয়ে আজান দিচ্ছেন, কেউ গোমূত্র পান, কেউবা থানকুনি পাতা বা কালিজিরা খেতে বলছেন। কলেজে বিজ্ঞান পড়েন এমন একজন তো তার কাছে সমাধান আছে বলে কয়েক হাজার কোটি টাকা দাবি করেছেন! আর এন্টারকোটিক এবং করোনা সূত্রের আবিষ্কারক ইব্রাহিম সাহেবদের কার্যক্রম তো আছেই!

সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরও কিছু বিষয় সার্বিকভাবে বদলাবে। বদলে যাওয়াটাই বোধ করি বেঁচে থাকার ভবিষ্যৎ উপায়। যেমন-

এক. ভালোবাসার রীতি বদল। দেখা হলেই জড়িয়ে ধরা, ঠোট বা কপালে আলতো চুমু খাওয়া, হ্যান্ডশেক করার মতো প্রচলিত রীতিগুলো বদলে যেতে পারে!

দুই. সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা মহামারীর পর অর্থনীতির যে অবস্থা থাকে সম্ভবত সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে, শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে, এই ধস কোন তলানীতে গিয়ে ঠেকে সেটা দেখার অপেক্ষা এখন।

তিন. গান, নাটক, খেলাধুলা আর সিনেমার ভবিষ্যতটা কেমন? কনসার্ট বা গানের জলসায় হাজার হাজার মানুষের জমায়েত কবে হবে আবার? সিনেমা হল ভর্তি মানুষ কবে দেখা যাবে আবার? ফুটবল কিংবা ক্রিকেট দেখতে স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষ এখন থেকে আর সমবেত হবে না? বাঁচার জন্য মানুষ ক্রমশ 'একা অন্তরীন' অবস্থায় থেকে যেতে বাধ্য হবে?

চার. কোনো রাষ্ট্রের সীমান্তে গত এক মাসে (মার্চ ২০২০) কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেমে আছে। নেই উত্তেজনা ইরাক কিংবা আফগানিস্তানে। নেই মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কোনো দুর্ঘটনা। ভারতে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এখন নেই কোনো আন্দোলন কিংবা ঘটেনি কোনো মুসলিম নির্যাতন। ভাইরাসের কোনো পাসপোর্ট লাগে না, সীমান্তের কাঁটাতার থাকে না তাদের জন্য। মিসাইল বা কোনো মারণাস্ত্র দিয়ে হত্যা করা যায় না কোনো ভাইরাসকে। অনিরাপদ শুধু মানুষ। মিসাইল, বুলেট, পারমাণবিক বোমা কিংবা প্রাণঘাতী ভাইরাস সব অসহায় মানুষের জন্য। করোনাভাইরাস কী মানুষের মনও বদলে দেবে? বুলেট, বোমা কিংবা মিসাইল তৈরি বন্ধ রেখে স্বাস্থ্য গবেষণায় অধিক মনোযোগী হবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো?

পাঁচ. ফিদেল ক্যাস্ট্রোর রেখে যাওয়া কিউবার 'সহযোগী ও বন্ধু ডাক্তার' নীতি বদলে দেবে অনেক কিছু? মারণাস্ত্র বানানোর চেয়ে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কারে মনোযোগী হবে মানুষ? মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের হাতে জড়ো হওয়া সব সম্পদ ব্যবহৃত হবে মানব কল্যাণে? ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র হাত বাড়াবে আক্রান্ত মানুষের সেবা কিংবা খাদ্য সহযোগিতায়? করোনা জয়ে চীন, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর কিংবা কিউবার দৃষ্টান্তে মানুষ ক্রমশ কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকবে? দেশের সাথে দেশের শত্রুতা কমবে? বাড়বে মানবতা? রোগ-শোক-জ্বরা আর দুঃখ জয়ের জন্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে শিখবে সারা বিশ্ব?

কী আছে মানুষের ভাগ্যে? স্বেচ্ছা বা বাধ্যতামূলক অন্তরীণ ছাড়া যেহেতু আর কোনো উপায় নেই সুতরাং সময়টা হাসিখুশি থেকে কাটান। প্রচুর চা পান করুন, প্রিয়জনদের সাথে আনন্দের সময় কাটান। প্রত্যেক ক্রিয়ার যেমন একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে তেমনি সারা পৃথিবীর সিনিয়র সিটিজেনরা যেমন করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে আছেন বিপরীত দিকে তারা এখন পরিবার পরিজনদের পাশে পাচ্ছেন। আর তাই করোনা বাস্তবতার কালে চার-পাঁচটা মজার তথ্য শুনিয়ে বিদায় নেই।

এক. রুয়ান্ডায় কোনো করেনাভাইরাস আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। দারুণ ভাল খবর। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা গেলেন রুয়ান্ডায়, দেখা করলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংবাদ সম্মেলনে বললেন- এখন পর্যন্ত কোন করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর আপনাদের দিতে পারিনি। কারণ করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার মতো কোনো টেস্টকিট এখনও আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি!

দুই. উত্তর কোরিয়া কেন এই করোনা কালে ক্ষেপনাস্ত্রের সফল উৎক্ষেপণ করতে গেল? কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছে দক্ষিণ কোরিয়া করোনাভাইরাস দূরীকরণে সফলতা প্রচারের নামে এই ভাইরাস যেন উত্তর কোরিয়ায় না পাঠাতে পারে সেজন্য এই মিসাইল উৎক্ষেপণ!

তিন. ইউরোপের অনেক দেশে করোনার চিকিৎসা সংকটের মতো 'নিরোধক' সংকটও দেখা দিয়েছে। সুইডেন আর সুইজারল্যান্ডের মতো দেশের সরকার ভাবছে এই অন্তরীণকালে যদি দেশের জনসংখ্যা একটু বাড়ে! শুধু নাকি ভারত সরকার আছে টেনশনে। করোনার কালে যদি জনসংখ্যা আরো বাড়ে তাহলে 'নাগরিকপঞ্জি' নাকি উপচে পড়বে। এই ভয় যখন বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে তখন করোনাভাইরাস আক্রান্ত প্রথম দেশ চীনে প্রতিদিন আশংকাজনক ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বাড়ছে!

চার. পৃথিবীর বেশিরভাগ কৌতুক নাকি নারীবিদ্বেষী কৌতুক। নারীদের নাকি কৌতুকের মাধ্যমে পচানো হয় বা ছোট করা হয়। করোনার বেলাতেও তাই ঘটেছে। বলা হচ্ছে- করোনাভাইরাসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে নারীরা। কারণ- ১) বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মারা যাচ্ছে পুরুষরা। ২) ফুটবল, ক্রিকেট আর বাস্কেটবল খেলা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৩) সব ধরনের স্পোর্টস বন্ধ। ৪) মার্কেট বন্ধ, সব ধরনের সামাজিকতা বন্ধ। ৫) খোলা শুধু একটা পথই। বউয়ের সাথে চব্বিশ ঘন্টা সময় কাটানো!

পাঁচ. এক কর্মচারি ফোন করেছে তার বসকে। কর্মচারি- বস সালাম। আমার করোনা টেস্ট পজিটিভ। কাল থেকে অফিসে আসব না। বস বলছেন- তুমি ছাড়া অফিস চলবে না। তুমি কাল থেকে অফিস করবা। আমিসহ অন্যরা কেউ অফিসে থাকব না!

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বউয়ের বকবকের মতো কিছু কিছু মন্ত্রীর বকবক বন্ধ হোক। মানুষ অনেক আগেই মোবাইল ও খানিকটা অনলাইন নির্ভর ছিল। করোনার এই সময়ে সেটা নাকি আরো পঞ্চাশগুণ বেড়েছে।