লেখার শিরোনাম সিনেমা কিংবা নাটকের ডায়লগের মতো হলেও – এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনও সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। সরকার ছুটি দিয়েছে কেন? এটি সরকারের পক্ষ থেকেও সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়নি। ছুটির দিনগুলোতে দেশের জনগণ কে কোথায় থাকবে, ছুটির দিনগুলো কিভাবে কাটাবে কিংবা কী করে সময় পার করবে – এটির নির্দিষ্ট গাইড লাইন দেওয়ার গুরুত্ব এখনো বাংলাদেশ মনে করে। কারণ, এখনো আমরা মিনা কার্টুনের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার উপায় বা নিয়মগুলো শিখিয়ে থাকি। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ওই মিনা কার্টুনেরই সহায়তা নিতে হচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ও মহল; বিশেষ করে সংবাদকর্মীরা অনেকে স্থির-ভিডিও চিত্র ভাইরাল করেছে। সেই সাথে যে যেখানে দেখেছে, মোবাইলে ক্লিক বা ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে ভাইরাল করেছে। ট্রেনের ছাদে মানুষ, বাসের ছাদে মানুষ। নদী পারাপারের জন্য যে ফেরি, সেখানে তো তিল ধারণের ঠাঁই নাই! শুধু ঘরমুখো মানুষ আর মানুষ। অন্যদিকে পণ্যবাহী ট্রাকেও মানুষ, মানুষগুলো বাড়িতে যাচ্ছে। এ যেন ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে। যেটি বাংলাদেশের প্রতিটি ঈদের দুই/একদিন আগের দৃশ্যের মতন।
আমাদের জনসচেতনতার সূচকগুলো বিবেচনা করে ছুটি, ছুটির পরে বাড়িতে যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখা, ছুটিতে কী করতে হবে – সরকারের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের নির্দেশনা না দেওয়ার বিষয়গুলো মুলত সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। করোনাভাইরাস ঠেকাতে সরকারের পদ্ধক্ষেপগুলো সমালোচিত হচ্ছে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে।
অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বন্ধ নিয়েও সরকারের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের গবেষণা বা পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এটিও সঠিক মনে হয়নি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কী করণীয় – এটিও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে প্রতীয়মান নয়। আর তাই একশ্রেণির বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছে। কেউ কেউ কক্সবাজার গিয়েছে, গিয়েছে আত্মীয় স্বজনসহ বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে। আর শিক্ষামন্ত্রণালয় যে খুব বেশি গবেষণা করে না করে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছে – এটি স্পষ্ট হয়েছে তাদের পরবর্তী নির্দেশনার মাধ্যমে। সেই সাথে আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠদান কীভাবে হবে, বাসায় বসেও কিভাবে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে – অগ্রীম কোনও গবেষণা বা পরিকল্পনা গ্রহণ তাদের ছুটির নির্দেশনার সময়ে উল্লেখ করেনি। আবার কবে থেকে টেলিভিশন বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নেবে, এটিরও সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারেনি।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশ যথেষ্ট সময় পেয়েছে। আমরাও যে আক্রান্ত হতে পারি – এটি আমাদের কতিপয় দায়িত্ববান কর্তাব্যক্তি যেন বিশ্বাসই করেননি। তাই বিদেশ ফেরত প্রবাসী ভাই-বোন বন্ধুদের নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করতে দেখা যায়নি। তাই কোনও ধরনের ব্যবস্থা যে নিতে হবে, এটিও প্রতীয়মান হয়নি। 'হোম কোয়ারেন্টিন' নাকি 'প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন' সিস্টেমে করোনাভাইরাসকে রুখে দেওয়া সম্ভব এই নিয়ে যে খুব বেশি গবেষণা করা হয়েছে কিংবা অন্যান্য দেশের পদ্ধতিকে ফলো করেছে, এমনটি ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না। আবার এই 'কোয়ারেন্টিন' শব্দ আমাদের দেশের কতিপয় মানুষের মন মগজে কিভাবে উপলব্দি হবে, আইসোলেশন কী – এটিও বাস্তবতার নিরিখে গবেষণা করে সময়ের সাথে সাথে সহজভাবে বোঝানোর পথ ও পদ্ধতি না গণমাধ্যমে, না সরকারিভাবে ব্রিফ করে উপস্থাপন করা হয়েছে! সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, লকডাউন এই ধরণের শব্দগুলো বাংলাদেশের মানুষ আগে কখনো শুনেছে কিংবা এই ধরণের শব্দের সাথে তারা পরিচিত বলেও আমি মনে করি না। অনেক প্রবাসী রীতিমত ভয়ে, আতঙ্কে নিজের নাম-পরিচয় পর্যন্ত পরিবর্তন করেছে। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে, এই চিন্তায় অনেকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। নতুন রোগের আবির্ভাবে নতুন শব্দ আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ কিভাবে গ্রহণ করবে এটি কর্তব্যক্তিদের গবেষণা করা উচিত ছিল এবং কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে তার যথেষ্ট সময়ও হাতে ছিল। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও অনেক রিকশাচালক ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বহুল পরিচিত শব্দ ইউনিভার্সিটিকে অতি সহজে বুঝে যায়।
আরেকটা বিষয় অত্যন্ত ভীতিকর মনে হয়েছে, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে আমাদের জাতীয় কোনও গাইডলাইন বা নীতিমালা বা নির্দেশনা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাই আমাদের একমাত্র ভরসা হবেন কেন? আইইডিসিআর তো করোনাভাইরাস নিয়ে তাদের গবেষণার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরবে। কিন্তু দেশের বিশাল জনসংখ্যার সচেতনতার দায়িত্ব সরকারের, রাজনৈতিক দলগুলোর। কিন্তু এ জায়গায় ব্যক্তিগত উদ্যোগ, নানান জনের নানান কথা, করোনাভাইরাস নিয়ে নানা রকমের আদেশ-উপদেশ বিশেষ করে কতিপয় ওয়াজ মাহফিল করা আলেম-ওলামাদের ফতোয়া, আল্লাহ গজব দিয়েছে আবার আল্লাহই আমাদের সারিয়ে তুলবে – এই ধরণের সচেতনতা করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির উপায় কী..? আমি নিজেও বহু দোকানপাটে নানা রকমের দোয়া দরুদের লিফলেট ঝুলিয়ে রাখতে দেখেছি।
অন্যদিকে, সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের বার বার বলতে দেখা গেছে যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা বা যোগাযোগ করুন। কিন্তু এই মন্ত্রীদেরই আবার দেখা গিয়েছে জনসমাগম তৈরি করে, শত শত মানুষ নিয়ে রীতিমতো মিছিল করে করোনাভাইরাসের সচেতনতার লিফলেট বিতরণ করতে! খোদ স্বাস্থমন্ত্রীকে করোনাভাইরাস সর্বশেষ তথ্য জানাতে চারপাশে অজস্র মানুষের ভিড় সৃষ্টি করে, কোনও রকমের সামাজিক দূরত্ব ও শারীরিক সুরক্ষা নিশ্চিত না করে কোভিড-১৯ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে দেখলে দেশের জনগণ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করার সচেতনতা বা মন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী চলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
আমাদের একশ্রেণির মানুষ বিশ্বাস করে বসে আছে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস কিচ্ছু করতে পারবে না – এটা ইহুদি নাসারাদের জন্য গজব! আরেক শ্রেণির মানুষ বিশ্বাস করে আছে, এটা মুসলমানের জন্য ঈমানী পরিক্ষা! আরেক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাস, আল্লাহ আমাকে নিয়ে গেলে নিয়ে যাক, করোনা-টরোনা এগুলো মানুষকে বোকা বানানোর তন্ত্র, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র!
জানি, এই জায়গায় রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয় কিন্তু একটা মহাপরিকল্পনা, দক্ষ মনিটরিং সেল এবং নানা জনের নানা বক্তব্যের চেয়ে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর একজন মুখপত্রের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত ও দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য-বিবৃতি বিশ্বাসের চেয়ে সচেতনতার দিকে গুরুত্ব দিতে মনোযোগী করে তুলত।
আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষ এখনো বিদেশ যাওয়ার সময় তার প্রিয় মানুষের সাথে সেই গ্রাম থেকে এসে বিমানবন্দরে ভাল থেকো, তোমার শরীরের যত্ম নিও, ঠিক মতন খাওয়া-দাওয়া করো, আমাদের জন্য চিন্তা করো না – কথাগুলো বলে বিদায় জানানোর মাঝে ভালোবাসা-আনন্দ খুঁজে পায়, তৃপ্তিবোধ করে। আবার বিদেশ থেকে ফেরত আসবে শুনে একটা মাইক্রোবাস ভাড়া নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে সকালের বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যায় প্রিয় মানুষ ভাই-বোন, বন্ধু কিংবা দূরের আত্মীয়স্বজনকে দেখামাত্রই বুকে জড়িয়ে ধরে সুখ অনুভব করে। ভাল কোনও খাবারের হোটেলে নিয়ে ভাল কিছু আপ্যায়ণ করে।
এই ভালবাসা, এই আনন্দ-আপ্যায়ণ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবেও ছিল। তখন একটু বেশিই ছিল মনে হয়। দেশে এসেছে। বিদেশে মরণঘাতী ভাইরাস করোনা। বাঁচার জন্য দেশে এসেছে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরার সংস্কৃতি – সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। খাবারের দোকানের মেছিয়ার কিংবা ছোট্ট যে ছেলেটি টেবিল পরিস্কার করে পানি ও সালাদ পরিবেশন করেছে, যে হাতে টাকা গুণে দিয়েছেন, যে হাতে বকশিস দিয়েছেন – এখানেও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ। আবার ওই টেবিল, একই মেছিয়ার, একই ছোট্ট ছেলে এবং ওই টাকাগুলো থেকেও অন্যরা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি শতভাগ।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অনেকে হয়তো টেরই পাবেন না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে ওই কোভিড-১৯ এর অনুভূতি থেকে দূরে রাখবে। কিন্তু গ্রামের বাড়ির বৃদ্ধ বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশী সেই বৃদ্ধা চাচা যাকে আপনার বাড়িতে আসাকে কেন্দ্র করে ঘরোয়া আয়োজনে, আনন্দ-আপ্যায়নে আপনার সংস্পর্শে এসেছেন – তিনি কিন্তু ঠিকই টের পাবেন। খুব কষ্টকরভাবেই টের পাবেন। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছেন, যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং যাদের আগে থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যা আছে তারা করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে আছেন শতভাগ এবং তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক!
পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরেও জাতীয় গবেষণামূলক সিদ্ধান্তহীনতায় করোনাভাইরাসের মহামারীতেও আমাদের গতানুগতিক পদ্ধতিতে বাড়িতে যাওয়ার অভ্যাস; কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি কিংবা সবাই সবার নিজ নিজ উদ্যোগে মরণঘাতী করোনাভাইরাস গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছি কিংবা নিয়ে যাচ্ছি কিনা-আমাদের ভাবতে হবে এবং অনুসন্ধানভিত্তিক তথ্যানুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।