করোনাভাইরাসে করণীয়: টেস্ট-টেস্ট-টেস্ট

সৌরভ সিকদার
Published : 28 March 2020, 02:23 PM
Updated : 28 March 2020, 02:23 PM

সরকার কিংবা আইইডিসিআর যত কথাই বলুক না কেন, যত আশ্বাসই দিক না কেন করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে আমরা যে একটি বিপদের সন্ধিক্ষণে (আসলে তো বিপদের মধ্যে) আছি তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

দেশের বর্তমান অবস্থা বা বাস্তবতা এরই মধ্যে প্রমাণ হয়ে গেল করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বেশ কিছু ঘটনায়। এতদিন শুনেছি কিট, পিপিই, মাস্ক সব কিছুই পর্যাপ্ত পাওয়া যাবে। কিন্তু মাত্র শুক্রবার নাগাদ দেখা গেল আলিবাবা চিনবাবা হেনবাবা তেনবাবা মিলিয়েও কিট পঞ্চাশ হাজার হচ্ছে না। অথচ আমরা সতেরো কোটি মানুষের দেশ। আর এ বাস্তবতায় সম্ভাব্য রোগীদেরকে আমরা পরীক্ষা করছি কিপটের মতো। অথচ বিশ্বস্বাস্থ্য বলছে- বেশি বেশি টেস্ট করো, বিচ্ছিন্ন করো (যা করে কোরিয়া, সিঙ্গাপুর জাপান দ্রুত সাফল্য পেয়েছে)। আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে জীবিতকালে তাকে টেস্ট করার সুযোগ দেইনি অথচ মৃত্যুও পর টেস্ট করছি আশপাশে আক্রান্ত কিনা তা বোঝার জন্য। দিন যত যাবে করোনার সংক্রমণ গতি তত বাড়বে, গত দুদিন আমেরিকার দিকে তাকালে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। ঘোষণার দু সপ্তাহ পরও আমরা ঢাকার বাইরে পরীক্ষা সম্প্রসারণ করতে পারিনি। গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা কিংবা বিয়ানিবাজার থেকে সিরিয়াস রোগীদেরকে ঢাকায় আনতে আনতেই মারা যাবে। আর স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসা কিংবা সহায়তা পাওয়া যে কত কঠিন এবং সে প্রত্যাশা করলে মৃত্যু যে অনিবার্য তা সম্প্রতি বগুড়ার ঘটনা দেখে আমরা বুঝে ফেলেছি। কাশি দিলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে কেউ আসেনা পাশে, না ডাক্তার, না প্রশাসন, না প্রতিবেশি। আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা যে ভীষণ দুর্বল তা কেন যে আমলা কিংবা সরকার বুঝতে দেরি করছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।

এখন প্রায়ই আমাদের নতুন রোগী নেই, মৃত্যু নেই। এটা আশার কথা হলেও, পর্যাপ্ত টেস্ট না করে এটা থেকে এমন সিন্ধান্তে আসার কোনো সুযোগ নেই যে, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে না।

আসল কথা আমরা টেস্ট করনোর বিষয়ে কৃপণতা করছি কিংবা আমাদের বেশি টেস্ট করার সামর্থ্য নেই। আমরা তো চীন-আমেরিকা নই, হতেই পারে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মিনমিন না করে সোজা বলে ফেললেই পারেন। সরকার হয়তো ভেবেছে, বেশি আক্রান্তের খবর জানলে মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়াবে, এটা হয়তো আংশিক সত্য, কিন্তু আমরা ভীতি ছড়ানো ঠেকাতে গিয়ে সংক্রমণ বাড়িয়ে ফেলছি না তো? সেদিকে কি খেয়াল রাখছি?

প্রথম থেকেই আমাদের বেশ কিছু বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো শুধরানোর যথেষ্ঠ সময় পেয়েও আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। কিন্তু এখন আর ভুল করার উপায় নেই। ইতোমধ্যে মহানগর থেকে এক বিপুল সংখ্যক মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। তাদের মধ্যে কারা ভাইরাস সংক্রমিত, কারা নন- আমরা জানি না। এদের দুই ভাগের মধ্যেও যদি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে থাকে তাহলে কী ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে তা কি আমরা কল্পনা করেছি? আগামী ১৫ দিনের মাঝে সে ফয়সালা হয়ে যাবে এবং আমরা আশা করি খারাপ কিছু ঘটবে না। কিন্তু যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটে থাকে তখন কী করবো? কী প্রস্তুতি আছে আমাদের?

নিষ্ঠুর শোনালেও এটাই হচ্ছে বাস্তবতা যে গ্রাম বা মফস্বলে আক্রান্তরা চিকিৎসা সেবা পাবেন না। (এই না পাবার সব রকম পরিস্থিতি বিদ্যমান, সবাই যেন 'এখন চাচা আপন জান বাঁচা'- এই নীতিতে আছেন) জানাও যাবে না যে লোকটি সে সত্যি করোনাভাইরাসাক্রান্ত হয়ে মারা গেল, না নিউমোনিয়ায়। নিউমোনিয়ায় মারা গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু করোনাভাইরাস হলে সে তার পরিবার বা প্রতিবেশিদের আক্রান্ত করেছে কি-না কীভাবে জানবো?

তাই সেজন্য এমুহূর্তে প্রধান কাজ ব্যাপকহারে টেস্টের ব্যবস্থা নেওয়া এবং আক্রান্তদের পৃথক করা। এ মহামারী ঠেকাতে এর কোনও বিকল্প নেই।

যেহেতু আমাদের কিট কম, আর ক্রয়ের সামর্থ্যও তত নয়, তাই সে বিষয় বিবেচনা করে আমি মনে করি অতি দ্রুত গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত সস্তা ও স্বল্পসময়ে ফলাফল পাওয়ার উপযোগী কিটটি পরীক্ষা করে (কেনো রকম সময় ক্ষেপণ না করে, যা এরই মধ্যে ভারত করেছে) ব্যাপকহারে উৎপাদনে যাওয়া। এবং একাজে সরকারকে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। এখানে রাজনীতি বা অন্য যেকোনও বিষয়ের চেয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো জরুরি। আরো উল্লেখ্য যে, এ কিটে আক্রান্ত ব্যক্তি শুধু রক্ত দিলেই চলে, এটা তো আর ভ্যাকসিন নয় যে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বিবেচনার জন্য সময় লাগবে। শুধু এটা কার্যকর কিনা এপরীক্ষার জন্য তিন দিনের বেশি লাগার কথা নয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এখন এক-একটা দিন এক এক বছরের মতো। একদিন পিছনে পড়া মানে হাজার মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি। ইটালি, স্পেন, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র যেখানে করোনাভাইরাস সামলাতে নাকের জল- চোখের জল এক হয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের কী দশা হতে পারে সে কথা ভাবলে তো গা শিউরে উঠে।

তাই সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, প্লিজ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়ে এখনই কাজে নেমে পড়ুন। মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। জনগণই দেশের প্রাণ। তাদের বাঁচানো সরকার ও রাষ্ট্রের মৌলিক ও প্রধান দায়িত্ব।