এসি ল্যান্ডের বাহাদুরি এবং আমাদের প্রতিবাদের শ্রেণিচরিত্র

Published : 28 March 2020, 01:03 PM
Updated : 28 March 2020, 01:03 PM

মানুষ কথা শুনছে না, কোয়ারেন্টিনের নিয়ম মানছে না।  আমরা দাবি করলাম, জোর করে মানুষকে ঘরে পাঠানো হোক। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হোক। সরকার সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিল করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করতে। তারাও সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন। এবং এই চেষ্টাটা করতে গিয়ে যশোরের মনিরামপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান তিনজন দরিদ্র ও প্রবীণ ভ্যান চালককে কান ধরিয়েছেন।

নিজের মোবাইলে সেটার ছবিও তুলেছেন এবং ভূমি অফিসের অফিসিয়াল পেইজে সেই ছবিটাকে কাভার ফটোও বানিয়েছেন!

স্বাভাবিক কারণেই আমাদের খারাপ লেগেছে এবং আমরা প্রতিবাদ করছি এই অমানবিক আচরণের। একজন সরকারী কর্মকর্তা, তা তিনি যে পদেরই হোন না কেন, এই ধরনের অসভ্য আচরণ করতে পারেন না। তাদের জনগণের সেবক হওয়ার কথা, নিপীড়ক নয়। তারপরেও কথা থাকে৷ এইযে আমরা আজকে যে কাজটাকে এতো ঘৃণা করছি, এতো প্রতিবাদ করছি, অনেকেই বুর্জোয়া মানসিকতাকে গালি দিচ্ছি, অনেকে এই কর্মকর্তার ব্যাক্তিগত মোবাইল নম্বরটা পর্যন্ত ভাইরাল করে দিচ্ছি, আমরা কি আসলেই এই কাজগুলোকে এতোটাই ঘৃণা করি? একইরকম প্রতিবাদ করি? না, করি না। নিপীড়ক আর নিপীড়িতের সামাজিক, লৈঙ্গিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের সাথে সাথে আমাদের প্রতিবাদের চরিত্রও পাল্টে যায়।

আসুন, খুঁজে দেখি এই ঘটনায় আমাদের খারাপ লাগার পয়েন্টগুলো কী কী?

কান ধরানো

সরকার কি বলেছে কান ধরিয়ে উঠবোস করাতে? না বলে নাই। লাঠিপেটা করতে বলেছে? না, তাও বলে নাই। তবুও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আমরা লাঠিপেটা ও কান ধরে উঠবোস দুটোই করাতে দেখেছি। তাতে কি আমরা অখুশি হয়েছি? নাতো। বরং আমরা খুশি হয়েছি, বাহবাও দিয়েছি। তাহলে আজকে হঠাৎ এই সহকারী কমিশনার তিনজনকে কান ধরানোয় এতো ক্ষেপে উঠলাম কেন? একই কাজের জন্য কাউকে হাততালি, আবার কাউকে গালি দিচ্ছি কেন? উনিতো আমাদের প্রশংসা পাওয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র। উনি নারী বলে? আমি অবশ্যই শুধুমাত্র নারী বলে কাউকে ওয়াকওভার দিতে চাই না৷ কিন্তু, আপনারা বুকে হাত রেখে বলুনতো, একজন পুরুষ এসি ল্যান্ড একই কাজ করলে আমাদের কি এতো খারাপ লাগতো?

গরীব ও বয়স্ক মানুষ

মানুষগুলো গরীব ও বয়োবৃদ্ধ। পেটের দায়ে রাস্তায় নেমেছে। তাদের বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি পাঠালেই হতো৷ শাস্তি কেন? হক কথা। কিন্তু এইবারেই কেন চোখে লাগছে বলুনতো। এর আগেও কি অসংখ্যবার আমরা গরীর ও বয়স্ক মানুষের গায়ে হাত তুলতে দেখিনি। আবার, গরীর এবং কমবয়সী কাউকে কান ধরালে বা মারধোর করলে কি ঠিক হতো? দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষকে পেটানো বা অসম্মান, অপমান করাতো আমাদের এখানে নতুন নয়। আমরা গাড়িওয়ালারা রিক্সাওয়ালাদের মারি। ট্রাফিক পুলিশতো হরহামেশাই মারে। আবার ঘরের ভিতর গৃহকর্মী বলতে যে প্রাণীটাকে থাকতে দেই, তাকেও কি কম মারি? তাহলে আজ গরীবের জন্য এতো খারাপ লাগছে কেন? ওহ্, দিনের আলোতে বেশি স্পষ্ট দেখা গেছে বলে? আর সেনাবাহিনী নয়, একজন সরকারী কর্মকর্তা বলে?

মাস্ক পরা না পরা

এইতো গেল প্রতিবাদের শ্রেণীচরিত্রের কথা। এবার আসুন দেখি,  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাহাদুরির শ্রেণিচরিত্রটা কেমন। গতকাল একটা ভিডিও দেখলাম, একজন বয়স্ক মানুষ জুম্মার নামাজ পড়ে ফিরছেন। মুখে মাস্ক নাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন হাজার বলেও তাকে মাস্ক পরার জন্য রাজি করাতে পারছেন না। উনার এক কথা- 'হায়াত মউতের মালিক আল্লাহ, উনি কিছুতেই মাস্ক পরবেন না।' খোদ শেখ হাসিনা আসলেও তিনি মাস্ক পরবেন না। সৌদি আরবের উদাহরণ দিয়েও লাভ হলো না। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও এইরকম আরো অনেক মুসুল্লী শুক্রবার মাস্ক ছাড়া মসজিদে গেছেন, কোনও সরকারি কর্মকর্তা বা কোন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহস থাকলে তাদের কাউরে কান ধরিয়ে কিংবা লাঠির বাড়ি দিয়ে দেখাক দেখি। ঢাকা শহরে দরকার নাই, কোন প্রত্যন্ত গ্রামেই করে দেখাক। পারবেন না। চ্যালেঞ্জ রইলো।

কাজেই বলছি কি, আপনারা যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তারা একটা কনসিসটেন্সি মেইনটেইন করলে হয় না? আমরা যারা প্রতিবাদ করছি, তারাও একই চেষ্টা করি না হয়। কী বলেন? বিশেষ বিশেষ ঘটনায় হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে উঠলে, অন্যদের সাথে অন্যায় করা হয়,তাই না?