অসুখে মরলে তো কথা নাই, মরমু তো না খাইয়া

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
Published : 28 March 2020, 11:21 AM
Updated : 28 March 2020, 11:21 AM

পেশায় রিনা বেগম (ছন্দনাম) একজন ফল বিক্রেতা। শেখেরটেক এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন। গতকাল তার সাথে কথা হচ্ছিল, বিক্রি নাই একদমই। পরিবারে ৫ জন খানেওয়ালা, অন্যদিকে তার বোন বাচ্চাকাচ্চাসহ এসে জুটেছে। চোখটা ছলছল করে ওঠে। হাতে খাবারের ব্যাগটা পেয়ে কেঁদেই দিলেন।

বাসার সামনে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফিরোজ (৪০)। ভোলার লালমোহনে বাড়ী । ঢাকায় শনির বিলে থাকেন, পরিবারে ৬ জন খানেওয়ালা। সারাদিনে ভাড়া মেরেছেন ২৫ টাকা। গতকাল ভাড়া মেরেছিলেন ১৭০ টাকা।

মোতাহার দালাল (৭৪) থাকেন চাঁদ উদ্যানের সোনামিয়ার টেক বস্তিতে। পেশায় ভিক্ষুক। কিন্তু এই আকালের দিনে তো রাস্তায় মানুষজনই নাই, ভিক্ষা দেবে কে? অভাবের জীবন। সামনে কী হবে সে চিন্তায় তার ঘুম আসে না। পরিবারে অনেকগুলো অভুক্ত মানুষ।

হনুফা (৩২) থাকে বোটঘাট এলাকায়। তার স্বামী তাকে ফেলে চলে গেছে। সে বলল, দুটো বাচ্চা নিয়ে একদম বিপদের মধ্যে আছিরে ভাই। বাসার কাজ থেকে ম্যাডাম বাদ দিয়ে দিছে, বেতনটাও এখনো দেয় নাই। ভাইরে অসুখে মরলে তো কথা নাই, মরমু তো না খাইয়া।

কামরাঙ্গীর চরের এনায়েত (৫৫) একসময় শ্রমিক রাজনীতি করতেন। এখন রিকশা চালান। বড় সংসার, মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা, তার আয় নাই ৩ দিন হলো।

উপরের প্রতিটি চরিত্রই গত কয়েকদিনে আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি খুব কাছ থেকে। না এরা কোনো ভিন দেশের মানুষ নন। গত কয়েকদিনে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য চাল, ডাল, তেলসহ কিছু খাদ্য দ্রব্য বিতরণের সময় নানান অভিজ্ঞতা মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এগুলো তাদেরই কথা। তাদেরই ব্যথার বয়ান। এই মানুষগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিন গ্রাম ছেড়ে নগরে আসতে বাধ্য হওয়া মানুষ। প্রতিবছর প্রায় ৬ লক্ষ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে ঢাকা শহরে। এই বাস্তহারা মানুষেরা নগরে এসে গৃহহীন হয়ে পড়েন। সংকট আরো তীব্র হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষকে নিয়ে আমাদের সামনে নতুন এক সংকটের তৈরি হয়েছে। এই নগরে দারিদ্রপীড়িত মানুষগুলোর বেঁচে থাকাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা জানি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সারা দুনিয়াই এক নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম না। কিন্তু এই মহামারীর মধ্যে সকল কিছুর থেকেই এক ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি হবে এই নিম্ন আয়ের বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষদের ক্ষেত্রে।

এই পরিস্থিতি বুঝবার জন্য আমাদের দেশের বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবন ও জীবিকাটাও বোঝা জরুরি। বুয়েটের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. শহীদুল আমিন বলেন, 'প্রতিদিন গড়ে সতেরো শ মানুষ ঢাকায় আসে এবং হিসাব করে দেখা গিয়েছে প্রতি বছরে প্রায় ৬ লাখ মানুষ ঢাকা শহরে নতুন করে যুক্ত হয়।' তিনি বলেন, 'নগরের মোট জনসংখ্যার ৩৫ ভাগ দরিদ্র এবং অতি দরিদ্র ১০ ভাগ যাদের আয় সাত হাজার টাকার নিচে।'

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, নদীভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, খরা, শৈতপ্রবাহ, লবনাক্ততার কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর গ্রামীন জনগোষ্ঠী জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে ভিড় করছে। ফলে সহজলভ্যতার কারণে তাদের অধিকাংশেরই জায়গা হচ্ছে শহরের অপরিকল্পিত এবং অপরিচ্ছন্ন বস্তিতে ও ফুটপাতের খোলা জায়গায়। তাছাড়াও গ্রাম এবং শহরের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য তাদেরকে শহরে আসতে বাধ্য করছে। ফলে দ্রুত বাড়ছে ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব এবং শহর হারাচ্ছে বাসবাসযোগ্যতা। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে কিন্তু দেশের সকল মানুষ এই সুফল সমানভাবে পাচ্ছেন না। ২০০৫ সালে নগর গবেষণা কেন্দ্রের হিসাব মতে মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল ৩৪,২০,৫২১ জন যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ৩৭.৪%। বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকা শহরে ৪০ লক্ষের অধিক বস্তিবাসী বাসবাস করে। এই সংখ্যা দিন দিন আরো বেড়েই চলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার পরিকল্পিত এলাকায় প্রতি একরে বসবাস করে ১২১ জন এবং আর বস্তি এলাকায় প্রতি একরে ৮৫০ জন মানুষ বাস করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বস্তিবাসীরা যে আয়তনের ঘরের জন্য ২৫০০-৩০০০ টাকা মাসিক ভাড়া দেয়, তা ধানমন্ডি-কলাবাগানের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়ার দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। ইউএনডিপির সম্প্রতিক গবেষণার তথ্যমতে, ধনী-দরিদ্রের গড় আয়ুর পার্থক্য ১৯ বছর। নিম্ন আয়ের মানুষদের গড় আয়ু যেথানে ৫৯ বছর, সেখানে ধনীদের গড় আয়ু ৭৮ বছর। এই ফলাফলই বলে দেয় তাদের জীবন জীবিকার অবস্থা এবং অবস্থান কোথায়।

বস্তি মানেই ঘিঞ্জি ঘর। এখানে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য যে ন্যূনতম দূরত্ব বজায় রাখা উচিত তার কোনো বাস্তবতা নেই। বস্তির মানুষ কমন টয়লেট, রান্নাঘর ব্যবহার করে থাকে। তাই তারা চাইলেও দূরত্বের যে নিয়ম তা মেনে চলার কথা সেটা ভাবতে পারছে না। বস্তিতে পরিচ্ছন্নতার কোন বালাই নাই। সারাবছরই সেখানে দুর্গন্ধ, ময়লা আবর্জনা ও জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। আর রোগ জীবাণু তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার তাদের জন্য। বস্তিতে সবাই যেমন ঘিঞ্জিভাবে বসবাস করে ঠিক সেভাবেই তাদের চলাফেরা করার চর্চাটা। তাই করোনাভাইরাস আক্রান্ত না হওয়ার যে প্রচলিত ফর্মুলা তা বস্তির ক্ষেত্রে মানাটা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমরা দেখি বস্তিতে পানি নেয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন দিতে হয়, লাইন দিতে হয় টয়লেটে যাবার জন্য, রান্নার জন্য আর তাই ন্যূনতম দূরত্ব রক্ষার কাজটা তাদের প্রচলিত জীবনচর্চার সাথে একদমই বেমানন। এই পরিস্থিতিতে আমি প্রায় ৫/৭টি বস্তিতে ঘুরে দেখেছি আর অন্তত ১২টি বস্তির মানুষের সাথে কথা বলেছি। তাদের সকলের অভিমত হলো বস্তিবাসীরা করোনাভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও সরকারের সবচেয়ে কম নজর হলো তাদের নিয়ে। যদিও ঢাকা উত্তরের মেয়র ৩ হাজার ভাসমান বস্তিবাসীর জন্য খাবার পাঠাচ্ছেন কিন্তু সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এ সময়ে আমরাও চেষ্টা করছি কিছু খাদ্য সামগ্রী নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু মানুষের সহযোগিতা যতটা পাওয়ার দরকার মানুষ ততটা আর করছে না। যেমন গতকাল আমাদের উদ্যোগের কথা শুনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ৫০ টাকার সহযোগিতা করা যাবে কিনা তা জানতে চেয়েছেন একজন। আমি ১ টাকার সহযোগিতা নেয়ার পক্ষের মানুষ কিন্তু যিনি এ প্রস্তাব দিয়েছেন আমি নিশ্চিত তার পরিবারের বাচ্চাটির চকলেটের আবদার মেটাতে মাসে ১ হাজার টাকা ন্যূনতম খরচ করতে হয়। অথচ তিনিই কিনা ভাবছেন ৫০ টাকার নাপা কিনে দেয়ার কথা। ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী, বস্তিবাসী ইউনিয়ন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনসহ কত কত সংগঠন ও ব্যক্তি হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য ত্রাণ বিতরণের কাজ করছে। কিন্তু আগে আমরা বন্যার ত্রাণ কাজ করতে গিয়ে যে সহযোগিতা পেতাম এখন মানুষ সেটা করছে কম। কিন্তু কেন?

এবার বাজারের দিকে একবার তাকাই। সেদিন এক চেইন শপে গেলাম। আমার সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক যে পরিমাণ বাজার করেছেন তা মোটামুটি একটি ছোটখাট দোকানের বাজার বলা যায়। শুধু এটা বলি, সে জুস কিনেছে ৪ কার্টুন, প্রতি কার্টুনে আছে ১৫/২০টা। আর কিছু না হয় নাই বললাম। যাইহোক এসব নিয়ে ফেইসবুকেও বিস্তারিত লেখালেখি করছেন সচেতন মহল কিন্তু আমি এমন কয়েকজনকে চিনি যারা বড় বড় কথা বললেও এই একই কর্ম করেছেন। এমনিতেই কালোবাজারী আর মজুতদাররা সুযোগ খোঁজে আর তার মধ্যে এই অতি লাগামহীন ভোগবাদী স্বার্থপর আচরণ বাজারকে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। এজন্য অবশ্যই আমি এই কাণ্ডজ্ঞানহীন জনগণকে দায়ী করব। আর আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই, এ সকল অবিবেচক ব্যক্তি মজুদদারদের কাছ থেকে খাবার সামগ্রী এনে নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা হোক। যাতে নগরের এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে না খেয়ে মরতে না হয়। আমরা নিশ্চয়ই করোনাভাইরাস নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন কিন্তু আমার উদ্বিগ্নতা বরাবরের মতই এই নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্ষুধা নিয়ে। তাদের খেয়ে বেঁচে থাকার ব্যবস্থাটা আগে করা জরুরি। তাই অতি দ্রততার সাথে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য বিশেষ ঝুঁকি ভাতা/প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হোক। সরকারের এদিকটি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখার কোনো বিকল্প নেই। আর সেটা করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর হ্যাঁ যারা এ লেখাটা পড়লেন তারা দয়া করে অন্তত একটি পরিবারের পাশে দাঁড়ান, যতটুকু পারেন।