করোনাভাইরাস: চিকিৎসকদের নেতৃত্বে আনতে হবে

জিয়া আরেফিন আজাদ
Published : 27 March 2020, 01:45 PM
Updated : 27 March 2020, 01:45 PM

চিকিৎসার প্রয়োজনটা মৌলিক। জনগণের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের সহযোগিতা করতে হবে। কোভিড-১৯ আক্রমণের এত বড় বিপদে প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনীকে সে জন্যই প্রস্তুত করা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করছি যে, গতানুগতিক ধারায় প্রশাসনের কর্তৃত্বেই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে নামতে যাচ্ছি। যেখানে চিকিৎসকদের ভূমিকাটা হুকুম পালনকারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাদের সুরক্ষার দিকটি উপেক্ষিত। দায়িত্ব পালন শেষে ঘরে ফিরতে গিয়ে বিসিএস ক্যাডার তরুণ চিকিৎসক পুলিশের ওসির দ্বারা প্রহৃত হয়েছেন। এই বিপর্যয়ে চিকিৎসকদের আবাসন, পরিবহন ও সংক্রমণ ঝুঁকির সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এরকম একটি অবস্থায় আতঙ্কিত চিকিৎসকগণ জানতে পেলেন চিকিৎসা দিতে না চাইলে পুলিশ বা সেনা টহলকে নালিশ করতে অফিস আদেশ দেওয়া হয়েছে। জনগণ এসব নিয়ে কথা বলছে। বিভিন্ন স্থানে ইন্টার্ন চিকিৎসকগণ ধর্মঘটে গেছেন। পুলিশি ব্যবস্থায় সেবা প্রদানকে অবমাননাকর আখ্যা দিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন কর্মবিরতির আল্টিমেটাম দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ সেই আদেশটি স্থগিত করেছ।

দেশের এই বিপদে সকলেই এগিয়ে এসেছে। আমরা দেখেছি শতাধিক সরকারি কলেজে শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যগণ রসায়ন গবেষণাগারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে তা জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করছেন। শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে কেউ মাস্ক তৈরি করেছেন। কেউ বা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ লিখছেন, মানুষকে সচেতন করছেন। এসব ছোট ছোট প্রতিটি উদ্যোগেরই কার্যকারিতা আছে। সরকার সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে একত্রিত করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে চাচ্ছে। অথচ, একটি মহল চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশাজীবীদের জনগণ তথা সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে তৎপর। কাজ করতে গিয়ে অসঙ্গতি চোখে পড়ায় ভুক্তভোগী চিকিৎসক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা কথা বলছেন। কেউ কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। জনগণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারছে। কারো কারো পোস্টে হয়ত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে। কয়েকজন সহকর্মীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা দেখছি, কিছু জুনিয়র কর্মকর্তা বিষয়টিকে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখছেন। শৃঙ্খলার বিষয়টি অবশ্যই আইন অনুযায়ী চলবে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাও অনেক আক্রমণাত্মক পোস্ট দিয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ আমরা দেখিনি। ক্যাডার বৈষম্য একটি বাস্তবতা। কিছু ঘটনা সেটিকে আরও প্রকটভাবে দেখিয়ে দেয়। সমালোচনা অবশ্যই যুক্তিনির্ভর ও শোভন হওয়া উচিত। সেখানে ব্যত্যয় কাম্য নয়। অভিভাবকসুলভ শাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সকলকে দায়িত্বশীল হওয়ার শিক্ষা দেবেন – এটাই স্বাভাবিক। সেই সাথে প্রকট বৈষম্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেতর থেকে কতটা ‍দুর্বল করছে – সেই বিষয়টা অনুসন্ধান করা দরকার।

আমরা সবাই জানি, ২০১৫ সালের পে-স্কেলে কিছু পদক্ষেপের ফলে বিরাজমান বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়। ২৬ ক্যাডার, প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি এবং সকল নন-ক্যাডার সার্ভিস একযোগে আন্দোলনে নামে। সেই আন্দোলন ছিল নজিরবিহীন। সে বছরের ২৪ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে ঘোষিত ছয় দফা সরকার মেনে নেয়। গঠিত হয় 'বেতন বৈষম্য নিরসন মন্ত্রীসভা কমিটি'। এর পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিনজন সিনিয়র সচিবের সমন্বয়ে একটি কোর কমিটি গঠন করে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে সকল সার্ভিসের দাবিসমূহ পূরণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। সবার আগে প্রস্তাব জমা দেয় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। বিদ্যমান বৈষম্যের তুলনায় সেই প্রস্তাব ছিল নিতান্তই নগন্য। আসলে কোর কমিটি যতটুকু সম্মত হয়েছিলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সেই গাইডলাইনের বাইরে যায়নি। দেশবাসী জানলে অবাক হবেন, অন্যান্য সকল ক্যাডারে একজন কর্মকর্তা পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত হন। অথচ শিক্ষা ক্যাডারে পঞ্চম গ্রেডের সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপকগণ চতুর্থ গ্রেডের উপরে উঠতে পারেন না। বহু আন্দোলনের পর কর্তৃপক্ষ পঞ্চাশভাগ অধ্যাপককে তৃতীয় গ্রেড দিতে সম্মত হয়েছিল। আজ পাঁচ বছর হতে চলল সেই প্রস্তাবনার এক শতাংশও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং সেই প্রস্তাব কাটছাঁট হয়ে ফাইল ওঠানামার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা, মন্ত্রীসভা কমিটির সিদ্ধান্ত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কোর কমিটির অঙ্গীকারের পরও যদি সীমাহীন বিলম্ব হতে থাকে, সংশ্লিষ্ট পেশার কর্মীদের মধ্যে হতাশা জন্ম নেওয়াটা স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ জানে না, স্বাধীনতার পর থেকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ মহাপরিচালক পদটিতে মাত্র তিনজন কর্মকর্তা পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই হল শিক্ষার মত একটি পেশার করুণ চিত্র।

স্বাস্থ্য ক্যাডারের অবস্থা আরও শোচনীয়। মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসগণ প্রতিনিয়ত শারীরিকভাবে নাজেহাল হচ্ছেন। কোনো একটি ঘটনার সুরাহা হচ্ছে না। নবীন চিকিৎসগণ ধৈর্য হারাচ্ছেন। ফলস্বরূপ তাদের অনেকেই বিভাগীয় প্রক্রিয়ায় শাস্তি লাভ করেছেন। স্বাস্থ্য ক্যাডারের সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ চিকিৎসকদের সমস্যাগুলি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। যৌক্তিক সমস্যাগুলি যদি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো যেত তাহলে শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা দেখতে হত না। চিকিৎসকদের সম্মান ও নিরাপত্তা জনগণের জন্যই। গণতান্ত্রিক সরকার সেটি নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অথচ জরুরি বিষয়গুলির নিষ্পত্তিতে কোথাও যেন একটি বাধা আছে। এই বাধাটি নিরসন করা দরকার।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য – অতি জরুরি সেবা। এটা মৌলিক মানবাধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট। উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে হলে কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। একজন দেশপ্রেমিক কর্মচারীর দায়িত্ব হল বিধিবিধান মেনে, শৃঙ্খলার সাথে নীতি নির্ধারকদের কাছে সংস্কারের প্রস্তাবনা পেশ করা, কোনো অসঙ্গতি দেখলে তা গোচরীভূত করা। বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগী একটি অংশ চায় না সরকারের কাছে সেই বার্তা পৌঁছাক। সমালোচনাকারী কর্মকর্তাদের বিরূদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা সর্বদা অতি উৎসাহী পরামর্শ প্রদান করে আসছে। শৃঙ্খলা তাদের কাছে ইস্যু নয়। তারা চায়, এই ধরনের প্রতিবাদ সংকুচিত হোক। এটাও এক ধরনের উসকানি। কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করার রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে সেটা রাষ্ট্রের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে – ভাবা দরকার।

যাইহোক, আমরা প্রজাতন্ত্রের সেবক, কর্মচারী। আমাদের অভিভাবকের কাছে কেবল সুপারিশ তুলে ধরতে পারি। আমরা মনে করি বর্তমান অবস্থায় প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরূদ্ধে যুদ্ধে চিকিৎসকদেরকে সামনের কাতারে আনতে হবে। তাদের পরামর্শ ও চাহিদার ভিত্তিতে সমগ্র প্রশাসনকে পরিচালনা করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে আমরা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি পদক্ষেপকে বিবেচনায় নিতে পারি। ভারতের চিকিৎসকগণ অভিযোগ করেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে গৃহমালিকগণ তাদের গৃহ পরিত্যাগ করতে বলছেন। সরকার বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছে। এরকম গৃহমালিকদের খোঁজ পাওয়া মাত্র তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সকল ডেপুটি কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এই আদেশ একটি বার্তা। প্রয়োজনের সময় রাষ্ট্র অবশ্যই শক্তি প্রয়োগ করবে। কিন্তু সেটা কার বিরুদ্ধে? কার পক্ষে? আপাতদৃষ্টিতে এটা চিকিৎসকদের পক্ষে মনে হলেও চূড়ান্ত বিচারে এই শক্তি প্রয়োগ জনগণের জন্য। বর্তমান জরুরি পরিস্থিতিতে আমরাও শক্তি প্রয়োগ করছি। রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে আমরা চাইব সেই শক্তি যেন জনগণের কল্যাণেই ব্যয় হয়। কোনো গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা যেন গুরুত্ব না পায়। এই বিপদের দিনে সবাই যেন হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারি। আন্তঃ ক্যাডার দ্বন্দ্ব যেন মাথাচাড়া না দেয়। আমরা সবাই নিবেদিত হলে নিশ্চয় এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাব। মুজিববর্ষ ও পঞ্চাশতম স্বাধীনতা দিবসে এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।