স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং নতুন যুদ্ধ

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 26 March 2020, 09:05 AM
Updated : 26 March 2020, 09:05 AM

বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ করোনাভাইরাস-আতঙ্কের মধ্য দিয়ে আমরা এবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি। বাংলাদেশও করোনাভাইরাস আক্রান্ত। এই লেখার সময় পর্যন্ত করোনায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। আরো কয়েকজন আক্রান্ত। পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় সরকার কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালাও বাতিল করা হয়েছে। মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। ৪৯তম স্বাধীনতা দিবস যেখানে বেশি জাঁকজমকের সঙ্গে উদযাপনের কথা সেখানে কতগুলো নতুন শব্দ এসে আমাদের মনোজগতে এক ধরনের পরিবর্তনের দোলা দিচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব, সঙ্গনিরোধ, বিচ্ছিন্ন থাকা এবং বন্ধাবস্থা – এই চার পদ্ধতি এখন আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কোটি কোটি বাঙালিকে ঘরছাড়া হতে বাধ্য করেছিল। ২০১৯-এর ডিসেম্বর থেকে করোনাভাইরাস নামের এক ভয়াবহ শত্রু মানুষকে কর্মহীন এবং ঘরবন্দী হতে বাধ্য করেছে। মানুষের জীবন সংহারে করোনা উন্মত্তের মতো আচরণ করছে। করোনার প্রাদুর্ভাব ক্রমাগত বাড়ছে। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। গত ডিসেম্বরে চীনে শনাক্ত হওয়ার পর করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক লাখে পৌঁছতে সময় লেগেছিল ৬৭ দিন। পরবর্তী এক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে ১১ দিনে আর পরের এক লাখে পৌঁছতে সময় লেগেছে মাত্র ৪ দিন। অর্থাৎ করোনার বিস্তার ঘটছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। কোথায় গিয়ে থামবে, কত মানুষের মৃত্যুর পর করোনার উন্মাদনা বন্ধ হবে তা নিশ্চিত করে বলার মতো বিশেষজ্ঞ কিংবা বিজ্ঞানীর খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানব জাতি এত ভয়াবহ সংকটে আর পড়েনি। প্লেগ, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো মহামারিতে ব্যাপক মানুষের মৃত্যু হলেও পৃথিবী জুড়ে এমন শঙ্কা, অনিশ্চয়তা নাকি আর কখনো দেখা যায়নি। পৃথিবী আগে কখনো এভাবে স্থবির হয়নি, অবরুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধ, মহামারি যাই হয়েছে তা সীমাবদ্ধ থেকেছে কয়েকটি দেশে, সীমিত সংখ্যক মানুষের মধ্যে। করোনা কোনো সীমান্ত মানছে না, মানছে না শত্রু-মিত্র, ধনী-গরিব। শাসিতের সঙ্গে সঙ্গে শাসকও আক্রান্ত হচ্ছে। কেউ নিরাপদ নয়, কেউ দুশ্চিন্তা মুক্ত নয়। এমন দুঃসময় আর কখনো আসেনি। এই দুর্যোগকালে, একেবারেই ভিন্ন পরিস্থিতিতে আমরা উদযাপন করছি মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। স্বাধীনতা দিবসের জমায়েত, জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ সব কর্মসূচি বাতিল হলেও বাঙালি জাতি অন্তরের সবটুকু শ্রদ্ধা দিয়ে স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, সম্মান জানাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, '১৯৭১ সালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা শত্রুর মোকাবিলা করে বিজয়ী হয়েছি। করোনাভাইরাস মোকাবিলাও একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আপনার দায়িত্ব ঘরে থাকা'। আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছি, করোনা মোকাবিলার যুদ্ধেও জয়ী হবো নিশ্চয়ই।

আমরা জানি, বর্তমান দুর্যোগ কেটে যাবে। ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হবে বিশ্ব। বাংলাদেশও বিপদমুক্ত থাকবে না। তবে নানা সংকট-দুর্যোগকাল অতিক্রমণের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা একটি বিধ্বস্ত দেশ পেয়েও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছি। তবে হ্যাঁ, স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক উত্থান-পতনে আমরা পথবিচ্যুত হয়েছি। তারপরও আমরা এগিয়েছি। স্বাধীনতার সুফল হয়তো সবাই সমানভাবে পাননি,তবে চরম বঞ্চনার শিকার হওয়ার প্রবণতা কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা-কাঠামো বৈষম্যের অনুকূলে।

গত শতকের আশির দশকের মধ্যভাগে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৫-দলীয় জোটের একটি সভা হচ্ছিলো সাবেক ছাত্র নেতা নূরে আলম সিদ্দিকীর বাসভবনে। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া এই নেতা ততদিনে বিপুল ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন। খুব সক্রিয় না হলেও তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ছিলেন। বিভিন্ন জনের বাসা-বাড়িতেই সেসময় রাজনৈতিক দল ও জোটের বৈঠক হতো। সম্ভবত নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেই এটা করা হতো। তো, নূরে আলম সিদ্দিকীর বাসায় বৈঠক চলাকালে প্রবীণ সাংবাদিক ও কৃষক শ্রমিক সমাজবাদী দলের নেতা নির্মল সেন ওয়াশরুমে যান এবং ফিরে এসে কমিউনিস্ট পার্টির  সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের কানে কানে বলেন, 'ফরহাদ সাহেব, স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছেনি এই ভাষণ আর দেয়া যাবে না'। কমরেড ফরহাদ বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চান, 'কেন দাদা, সমস্যা কি'? নির্মল সেনের জবাব: 'দেখে আসুন, স্বাধীনতার সুফল নূরে আলম সিদ্দিকীর বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে'!

এটা কোনো গল্প নয়। এরকমই হয়েছে। এখনও একই ধারা অব্যাহত আছে। পাকিস্তানি আমলে আমরা ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এখন হয়তো সেটা ২২ হাজার কিংবা তারও কিছু বেশি পরিবার হয়েছে। সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে, পাচার হচ্ছে। অসততা, অনৈতিকতার প্রতিযোগিতা চলছে। রাষ্ট্র ক্ষমতা ধনী হওয়ার পথ প্রশস্ত করছে। তাই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি আর নীতি-নৈতিকতার ধার ধারছে না।

স্বাধীনতার স্বপ্ন বলে একটি কথা আমরা প্রায়ই উচ্চারণ করে থাকি। স্বাধীনতার সুফল কথাটাও বহুল প্রচলিত। প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতার স্বপ্ন বলতে আমরা আসলে কি বুঝি? কিংবা স্বাধীনতার সুফল বিষয়টিই বা কি? পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে কেন বাঙালি জাতি বেরিয়ে এলো? কেন স্বাধীনতার জন্য এত জীবন দান, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা? এক কথায় এসব প্রশ্নের জবাব হলো, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালির তথা এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছিল না। রাষ্ট্রটি ছিল নিপীড়ক এবং বৈষম্যমূলক। সব মানুষের সমান অধিকারের বিষয়টি ছিল পাকিস্তানে অনুপস্থিত। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামতের কোনো তোয়াক্কা করা হতো না। কারণ পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল না। তার মানে পাকিস্তান রাষ্ট্রে কতগুলো মৌলিক বিষয়ের ঘাটতি বা অভাব ছিল। অভাবগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে চিহ্নিত করা যায়- ১. গণতন্ত্রের অভাব, ২.উদারতার অভাব এবং ৩. সাম্যের অভাব। এই অভাবগুলো দূর করার প্রত্যাশা থেকেই বাঙালির মধ্যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈরী মনোভাব তৈরি হয়। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে কোনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয় – এই চেতনা বাঙালির মনে জাগিয়ে তোলেন শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক। বাঙালি জাতি শেখ মুজিবের মধ্যে তাদের আশা বা স্বপ্নপূরণের প্রত্যয় দেখে তার পেছনে সমবেত হয়েছিল, ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।

তারা ধরে নিয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানে যেসব জিনিসের অভাব ছিল সেগুলো দূর হবে। পাকিস্তানে নাগরিকদের মর্যাদা নিরূপণের মাপকাঠি ছিল ধর্ম। রাষ্ট্রচিন্তা ছিল সাম্প্রদায়িক। তার মানে বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক। বৈষম্য ও গণতন্ত্রহীনতা ছিল পাকিস্তানের ভিত্তি। বাংলাদেশ হওয়ার কথা ছিল বৈষম্যমুক্ত এবং গণতান্ত্রিক।

স্বাধীনতা অর্জনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে এই বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলেও টেকসই হয়নি। রাজনৈতিক নানা উত্থানপতনে অনেক কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন স্বাধীন বাংলাদেশ অনেকটাই পাকিস্তানি ভাবধারায় প্রভাবিত। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। কিন্তু সময়ের পরিবর্তন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগেও আদর্শিক অবস্থানেও ভাঙচুর হয়েছে, দলীয় নীতি-কৌশলেও পরিবর্তন এসেছে। বিএনপির মতো ক্ষমতার প্রয়োজনে হঠাৎ জন্ম নেয়া দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের শরীরেও আদর্শবিচ্যুতির হাওয়া লেগেছে।

আমরা এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। ৪৯ বছরে আমাদের যেমন অর্জন আছে, তেমনি হারানোর বেদনাও আছে। আমরা অসাম্প্রদায়িক হতে পারিনি। গণতন্ত্র শক্ত ভিত্তি পায়নি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে প্রকট ধনবৈষম্য। স্বাধীনতার সুফল কারো ঘরে অনেক বেশি পৌঁছে গেছে। অনেকের দোরগোড়ায়ও যেতে পারেনি। তাহলে আমরা কি গর্ব করার অবস্থায় আছি? কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সাফল্যের জন্য আমরা নিশ্চয়ই গৌরব বা অহংকার করতে পারি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে গৌরব করার জন্য আমাদের আরো এগিয়ে যেতে হবে, সুনির্দিষ্টভাবে আরো কিছু কাজ করতে হবে এবং আরো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে হবে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায়।

একদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামি বাড়ছে, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বাড়ছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-অসাদাচরণ। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা এমনভাবে উদযাপন করতে চাই যেন মুখ উঁচু করে বলতে পারি, হ্যাঁ, এমন স্বাধীনতাই আমরা চেয়েছিলাম। স্বাধীনতার সুফল যেন সব মানুষের ঘরে পৌঁছায় তার জন্য যেমন সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, তেমনি কঠোর নজরদারির মধ্য দিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নও করতে হবে। কিছু মানুষের অনেক সম্পদ এবং বেশি মানুষ সম্পদহীন বা স্বল্প সম্পদের মালিক – এই অবস্থা বহাল রাখলে স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হবে না। পাঁচতলা আর গাছতলার ব্যবধান দূর করতে হবে। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না-তা হবে না। সবার জন্য কাজ, শিক্ষা, মাথা গোঁজার ঠাঁই, চিকিৎসা সেবার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা রাখতে হবে। উগ্রতা পরিহার করে উদারতার চর্চা বাড়াতে হবে। স্বাধীনতাহীনতায় যেমন কেউ বাঁচতে চায় না, তেমনি এমন স্বাধীনতাও কেউ চায় না – যে স্বাধীনতা মানুষের অগ্রযাত্রা তথা বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার সুফল সবার ঘরে পৌঁছতে হবে সুষমভাবে।

করোনা-পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতিতেও ভাঙচুর হবে, পরিবর্তন আসবে। যেকোনো বড়ো ঘটনাই মানুষের চিন্তার জগতে নতুন আলো ফেলে যায়। করোনাভাইরাস মানুষকে এটা দেখালো যে, তারা এখনো কতো অসহায়। সভ্যতা নিয়ে অহংকার করার মতো অবস্থানে মানব জাতি এখনও পৌঁছতে পারেনি। এতো আবিষ্কার, এতো উন্নতি, এতো শক্তির দম্ভ, হাতের মুঠোয় দুনিয়া – একটি ভাইরাসের কাছে কিছুই কিছু না। মানুষকে এখন নিজের সঙ্গেই আরেক দফা বোঝাপড়া দেখতে হবে। মূল্যায়ন, পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে তার পথরেখার। করোনা-ঝাঁকিতে নড়েচড়ে বসতে হবে চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের। বাংলাদেশেও রাজনৈতিক ভাবনায় নতুন চিন্তার প্রকাশ ঘটবে বলে আশা করা যায়। মানুষের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী সাম্যচিন্তা প্রবল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়েই উদযাপিত হোক স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী।