বাংলাদেশে করোনাভাইরাস – আপনার, আমার, আর সরকারের করণীয়

নাবীল আশরাফ আলী
Published : 22 March 2020, 11:22 AM
Updated : 22 March 2020, 11:22 AM

সহলেখক: আশফাক আনুপ, ডক্টরাল গবেষক, শেফিল্ড হালাম বিশ্ববিদ্যালয়, শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য।

কেন এই লেখা?

বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯-এর ভয়াল থাবার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় নানান ক্ষেত্রে এ নিয়ে নানান মতামতের ছড়াছড়ি চোখে পড়ছে আমাদের; যার কিছু একেবারেই অদরকারি, কিছু সত্যিকার অর্থেই দরকারি। এই বৈশ্বিক  মহামারীর সামনে দাঁড়িয়ে করণীয় কার্যাবলি যে শুধু একমুখী হবে না সেটাই স্বাভাবিক। নানামুখী তৎপরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন বহুপাক্ষিক সমন্বয়। এজন্য বিভিন্ন উদ্বেগ থেকে বিভিন্ন মতামত প্রকাশিত হচ্ছে নানান মাধ্যমে। আমাদের মনে হয়েছে এই মতামতগুলোর সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। এজন্যই আমরা কয়েকজন স্বাস্থ্যসেবা গবেষক, গণস্বাস্থ্য গবেষক, চিকিৎসা কর্মী, আইনজ্ঞ, প্রকৌশলী প্রমুখের সমন্বয়ে চেষ্টা করেছি এইসব মতামত এবং সেগুলোর অন্তর্গত দাবিগুলোকে এক জায়গায় সংকলিত করতে। মোটাদাগে এই পরামর্শ ও দাবিগুলোকে সরকারের করণীয়, স্বাস্থ্যখাতের করণীয় এবং ব্যক্তিপর্যায়ে করণীয় – এই তিন অংশে সংকলন করা হয়েছে। সে কারণেই লেখা আকারে বড়। পুরোটা পড়তে না চাইলে এই তিন অংশের যে অংশের প্রতিনিধি বলে নিজেকে মনে করেন কেবল সে অংশটুকু পড়ে নিতে পারেন।

যে যুদ্ধকৌশল না জানলেই নয়

আচরণ বিজ্ঞানে (behavioral sciences) বলা হয়, মানুষের ব্যবহার, আচার আচরণ ইত্যাদি বদলানো সবচেয়ে কঠিন। এই কাজে যেমন লাগে ধৈর্য, তেমনই প্রয়োজন সময়ের। জনস্বাস্থ্য গবেষণায় আমরা সেটার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছি। তবে, সবচাইতে কঠিন হলেও, আমরা দেখেছি আচরণগত পরিবর্তন আনতে পারলে একটি ইন্টারভেনশন সবচাইতে বেশি কার্যকর ও টেকসই হয়, কারণ সেই পরিবর্তনগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যায়। দুঃখের বিষয়, প্যান্ডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারীর ঠিক মধ্যখানে বসে আমরা এমন কোনো কাজের কথা ভাবতে পারি না, যার ফল পেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। হাতে সময় নেই। আমরা যা-ই করি না কেন সেটাকে এমন কিছু হতে হবে যা এক্ষুণি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

অতএব, বিচক্ষণতার সঙ্গে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। যেমন, দাবি উঠেছিল – সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনতিবিলম্বে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। সেই দাবি ওঠার চার দিনের মাথায় সরকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। সাধুবাদ সরকারকে – দেরিতে হলেও এই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপটি নেওয়ার জন্য। দেরি বলছি এই কারণে যে, এই ভাইরাসের আগমন, বিস্তার, CFR (case fatality ratio বা এই রোগে মৃত্যুর হার)[1], ও অন্যান্য দেশে মহামারীর চিত্র থেকে আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, সেটা থেকে আগেভাগেই আমাদের বোঝা দরকার ছিল – স্কুল/কলেজ তথা সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব সহজেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে। এর মূল কারণ এই নয় যে, কম বয়সীরা বেশি ঝুঁকিতে আছে। মূল কারণটি হলো – স্কুল/কলেজে জনসমাগম হয়। তাদের যে কেউ এই ভাইরাস বয়ে বেড়াতে পারে, ছড়াতে পারে, এবং শেষমেষ যারা ঝুঁকিতে আছে তাদের ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই ধারায় প্রকৃতপক্ষে কম বয়সী ছেলেমেয়েরা বেশ বড় একটা পদক্ষেপ নিতে পারে – বিশেষ করে সংক্রমণের যে চক্র তা ভাঙার ক্ষেত্রে।

মনে রাখা প্রয়োজন – যারা সংক্রমিত হবে তাদের অন্ততপক্ষে ২% থেকে ৪%-কে আমরা হারাব[2]। (এই রোগে মৃত্যুর হার যে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এটা অনেকখানি নির্ভর করবে, কোন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা মোকাবেলায় কতখানি প্রস্তুত তার ওপর। যদি প্রস্তুত থাকে তবে মৃত্যুর হার ১%-এর নীচে থাকতে পারে, আবার যদি প্রস্তুত না থাকে, অতিরিক্ত রুগীর চাপে বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যকর্মী ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতার কারণে ভারাক্রান্ত থাকে, তবে সেটা ৫% বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।) হ্যাঁ, তার মানে – ১০০ জনে ৪ জন (যদি ৪% ধরা হয়), ২০০ জনে ৮ জন, দুই হাজারে ৮০ জন, দুই লক্ষে ৮ হাজার জন; আর যদি দশ লক্ষ মানুষ (মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৬%) সংক্রমিত হয়, তবে মৃতের সংখ্যা গিয়ে ঠেকবে ৪০ হাজারে! আমাদের দেশ দুনিয়ার বুকে সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। মনে রাখতে হবে ইউরোপীয় দেশগুলো ধারণা করছে এই ভাইরাস তাদের মোট জনসংখ্যার ন্যূনতম ৬০-৭০% মানুষকে আক্রান্ত করবে[3]। তাই আমাদের দেশে ১০ কেন, ২০ কিংবা ৩০ লক্ষ মানুষের মাঝে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়াটা খুব বিচিত্র কিছু হবে না। ভাবা যায়! দুই থেকে আড়াই লক্ষ মানুষ শেষ হয়ে যাবে এই সংক্রমণ না ঠেকাতে পারার কারণে! বস্তুত, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের ড. মলয় মৃধার সাম্প্রতিক হিসেব মতে মৃত্যুর এই সংখ্যা এমনকি সাড়ে পাঁচ লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে!

এই পর্যায়ে জানিয়ে রাখা ভালো, উপসর্গের উপর ভিত্তি করে কোভিড-১৯ সংক্রমণের তীব্রতাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কীভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। বিভিন্ন খবর, ব্রিফিং, ও প্রজ্ঞাপনে আমরা দেখতে পাচ্ছি  mild, severe, and critical-এর মতো কয়েকটি শব্দের ব্যবহার। পাঠকদের সুবিধার্থে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন থেকে আমরা সাধারণভাবে এই শ্রেণিবিন্যাসকে তুলে ধরছি[4]

মৃদু (mild): শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গগুলি মৃদু থাকবে। মৃদু বলতে সাধারণ অর্থে বোঝায় – প্রথমে জ্বর আসবে, যার সাথে কিছু শ্বাসপ্রশ্বাস-জনিত সমস্যা থাকতে পারে। এর সাথে থাকবে শুষ্ক কাশি এবং এই সময়ে শরীরে অল্প ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই সকল ক্ষেত্রে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না, তবে বয়োবৃদ্ধ বা যাদের অন্য কোনো রোগ (যেমন, ডায়াবেটিস) আছে, তাদের ক্ষেত্রে ডাক্তার বা হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়াটা জরুরি।

তীব্র (severe): শতকরা ১৪ ভাগ ক্ষেত্রে তীব্র উপসর্গ দেখা দেবে। তীব্র উপসর্গ হলো শ্বাসকষ্টের তীব্রতা (প্রতি মিনিটে ৩০ বারের বেশি শ্বাস নিলে ধরে নিতে হবে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে)। এই পর্যায়ে রোগীকে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। এই পর্যায়ে একজনের নিউমোনিয়া হয়ে থাকতে পারে, যা অনেকের ক্ষেত্রে (বিশেষ করে যারা সুস্থ, অন্য কোনো অসুখে ভুগছে না এবং কম বয়সী) নিজে থেকেই সেরে যেতে পারে। তবে অসুস্থ ছিলেন বা অন্যান্য অসুস্থতা আছে এমন কারো ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে এই উপসসর্গগুলোর অবনতি ঘটতে পারে।

সংকটজনক (critical): শতকরা ৬ ভাগ ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের তীব্রতা এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে যার জন্য আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে থাকতে হবে, যেখানে রোগীর কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস নেয়ার (Ventilator) ব্যবস্থা থাকবে।

সংক্রমণের হার ও জীবন নাশের আশঙ্কা মাথায় রেখে আমাদের শক্ত হতেই হবে। জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে, তা সেটা যেকোনো ধরনের জনসমাগমই হোক না কেন! আজকাল অনেকেই বলছেন সামাজিক দূরত্বের কথা, কিন্তু সেটা আসলে কী? সহজ করে বললে – এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তি থেকে দূরত্ব (তিন থেকে ছয় ফুট) বজায় রেখে চলবে। কিন্তু সেটা কেমন করে? এর সোজা উত্তর হলো – জনসমাগম এড়িয়ে চলে।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা রাখার চেষ্টা করা যে কার্যকর, তা সাম্প্রতিক একটি লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। লেখাটির ভিত্তি একটি সিমুলেশন অনুশীলন। একজন থেকে আরেকজনের কাছে রোগ কীভাবে কী হারে ছড়িয়ে পড়তে পারে সেটা বোঝার জন্য কম্পিউটারে এই অনুশীলনটি করা হয়েছে। এতে আমাদের জীবনের জটিলতা যোগ করা সম্ভব নয়। তবে, এই অনুশীলনে স্পষ্ট যে, কোভিড-১৯ একজন থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে আমাদের পারস্পরিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে – বিদেশ থেকে দেশে, পরিবারের একজন থেকে অন্যদের মাঝে, এক পরিবার থেকে অন্য পরিবারে, এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায়, শহর থেকে গ্রামে, এবং ক্রমান্বয়ে সারাদেশে! এই অনুশীলনটি দেখায় যে আমরা যদি কোনো ধরনের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজ না করি তবে এই রোগ সারা দেশের প্রতিটি মানুষকে (যারা সংক্রমিত হতে পারে) সংক্রমিত করবে [চিত্র ১ (ক)]! আমরা যদি এলাকা-ভিত্তিক কোয়ারেন্টিন (কিছু কিছু এলাকাকে দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে সম্পূর্ণরূপে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া) করার চেষ্টা করি, তা সাময়িকভাবে কিছুটা উপকার করলেও দ্বিতীয় দফায় তা আবারো ছড়িয়ে পড়বে [চিত্র ১ (খ)]; আমরা যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব দিই, তাহলে সেটা এলাকা-ভিত্তিক কোয়ারেন্টিনের চাইতে হয়তো আরেকটু ভাল কাজ করবে [চিত্র ১ (গ)]; তবে, আমরা যদি ব্যাপক হারে সফল সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি, তাহলে সেটা সবচেয়ে বেশি সুফল দেবে [চিত্র ১ (ঘ)]।

জনস্বাস্থ্য গবেষণায় এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজের ফলাফলকে flattening the curve বা 'রোগ বিস্তারের গ্রাফের বক্ররেখাকে সমতলকরণ' বলা হয়। ধরা যাক, মোট রোগী ৭০০ জন। কিন্তু, স্বাস্থ্যসেবা খাত দৈনিক ১০০ জনকে সেবাদানের সামর্থ্য রাখে। এক্ষেত্রে সব রোগীই পূর্ণ সেবা পাবে কেবল যদি ৭ বা তার বেশিদিন দিন যাবৎ দৈনিক ১০০ বা তার কম সংখ্যক রোগী হাসপাতালে আসে। কিন্তু একদিনেই যদি ৭০০ রোগীকে সেবাদান করতে হয় তবে ৬০০ জন বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাবে। অর্থাৎ, এই গ্রাফের সমতলকরণের মাধ্যমে যারা সংক্রমিত হচ্ছে, তাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ সহজ হবে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মাত্রাতিরিক্ত চাপ থেকে রক্ষা করবে।  ওপরের চিত্র ০২ flattening the curve বা রোগ বিস্তারের গ্রাফের বক্ররেখাকে সমতলকরণ এবং তার সুফলের ধারণাকে চিত্রায়িত করে।

এখন, অমোঘ সত্য হচ্ছে – করোনা ভাইরাস আসছে (বা এসেই গেছে) আমাদের শহরে, আমাদের গ্রামে, আমাদের ঘরে। প্রথমে আমরা দু-একটা করে মানুষের অসুস্থ হবার খবর পাব, যেমনটা আমরা রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IEDCR)-এর পরিচালকের মাধ্যমে জানতে পারছি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে হঠাৎ করেই এই সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করবে জলোচ্ছ্বাসের মতো। এর কিছুটা হয়তো এরই মধ্যে আমরা টের পেতে শুরু করেছি। যখন জলোচ্ছ্বাস আসবে তখন আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, স্বাস্থ্যকর্মীরা অসুস্থ হওয়া শুরু করবেন, এমনকী কেউ কেউ মৃত্যুও বরণ করতে পারেন। অবস্থা এমনই হবে যে, স্বাস্থ্যকর্মীরা তখন সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেবেন আর কাকে দেবেন না; কাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন আর কাকে বাঁচানোর চেষ্টাও করা সম্ভব না। আমরা যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপক কার্যক্রম এই মুহূর্তেই নিষ্ঠার সাথে শুরু না করি, অচিরেই আমরা লক্ষ লক্ষ মানুষকে হারাব – যাদের আমরা বাঁচাতে পারতাম[6]

আমাদের দেশে  অনেকের ধারণা, জনসমাগম এড়ানো একটি অবাস্তব কল্পনা। এত মানুষ… কোথায় যাবে? উত্তরটি সহজ – বাসায় থাকবে। যদি কোনোভাবেই বাইরে বের হওয়া এড়ানো না যায় – তখন বাইরে যাবে, তবে যতক্ষণ সম্ভব ঘরেই থাকবে। এটা স্বাভাবিক যে এই পরিকল্পনার ১০০% সফল প্রয়োগ চীনও করতে পারেনি। তবে, আগে আমরা লিখেছি, যত বেশি করা যাবে ততই ভালো হবে; কমও যদি হয়, তা হলেও না করার চাইতে ভালো হবে। ধরা যাক – মুজিব শতবর্ষের কিছু ইভেন্ট বাতিল করা, স্কুল/কলেজ বন্ধ করা, বিদেশ থেকে আসা মানুষদের কোয়ারেন্টিনে[7] রাখা (বা কিছু মানুষকে নিজেদের বাড়িতে হোম-কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা), ইত্যাদি কোনোটাই শতভাগ সঠিকভাবে করা যায়নি। হোম-কোয়ারেন্টিন অনেকেই মানেনি, তবে অল্প হলেও তো মেনেছে – এমনকী সেটাও ইতিবাচক।

এই সবকিছুরই একটা ইতিবাচক প্রভাব আছে flattening the curve-এর ক্ষেত্রে। তাই বলে গাফিলতি হয়নি, এটা বলা বোকার স্বর্গে বসবাসের নামান্তর। যেসব অসঙ্গতি আমাদের সবার চোখেই পড়েছে সেগুলো নিয়ে আমরা কথা বলব না, তা একেবারেই নয়। বরং, আমাদের সবার উচিত হবে গাফিলতিগুলোকে খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিতে পারা এবং পরিকল্পনার সাথে সাংঘর্ষিক আচরণের প্রতিবাদ করা। এখানে আমরা বেশ কিছু ঘটনা উল্লেখ করে এ বিষয়ে জবাবদিহিতা ও ভবিষ্যৎ সতর্কতার দাবি জানাব! আমাদের এই লেখা সে কারণে সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধি ও সেটা বজায় রাখা এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা প্রদানে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই লেখা। তবে ব্যক্তিপর্যায়ে সম্ভাব্য কার্যক্রম নিয়েও কিছু আলোচনা করবার চেষ্টা আমরা করব।

সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণের সাফল্য-ব্যর্থতা ও সরকারের অবশ্যকরণীয়সমূহ

১) সামাজিক দূরত্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে মুজিব শতবর্ষের মূল অনুষ্ঠান বাদ দেয়া হয়েছিল। জনসমাগম এতে এড়ানো গেছে। নিঃসন্দেহে এটা সাধুবাদ পাবার মতো সিদ্ধান্ত। তবে মুজিব শতবর্ষ ‍উদযাপনকে উপলক্ষ করে আতশেবাজি ওড়াবার জন্য হাজার হাজার মানুষকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যত্র একত্রিত হবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যা অনুষ্ঠান বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এরকম জনসমাগমে প্রবল বেগে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু করিয়ে দেওয়ার জন্য মাত্র একজন অসুস্থ ব্যক্তির উপস্থিতিই যথেষ্ট। আমাদের দাবি – জনসমাগম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে! এই পরিপ্রেক্ষিতে যদিও সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি নির্দেশনা জারি করে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমাবেশ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে[8], আমরা এখানে সেগুলোর বাস্তবায়নের ব্যাপারে আরো কিছু পরামর্শ দিতে চাই।

ক. স্টেডিয়ামে কোনো খেলা বা কোনো প্রকার কনসার্ট আয়োজন করা উচিত হবে না; এ বছর পহেলা বৈশাখের আয়োজন সীমিত আকারে করাও ঝুঁকিপূর্ণ হবে, তাই বর্ষবরণ ও নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে জনসমাগম রহিত করা সমীচীন হবে। একই কথা প্রযোজ্য নবান্ন ও চৈত্র সংক্রান্তির ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে সমন্বয়ের ভিত্তিতে দ্রুততার সাথে নীতিমালা প্রণয়ণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

খ. বিয়ে বা জন্মদিন বা এ ধরনের বড় কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য অনুমতি দেওয়া অনুচিত হবে। এই মর্মে স্থানীয় প্রশাসনকে ওয়াকিবহাল করতে হবে এবং সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রস্তুত করতে হবে।

গ. যেকোনো প্রকার বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ (ওয়াজ, জামাতে নামাজ, পুণ্যস্নান ইত্যাদি) পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার আগ পর্যন্ত স্থগিত রাখার কথা আমর প্রস্তাব করছি। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরে করোনাভাইরাস উপলক্ষ্যে দোয়া মাহফিলে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছে[9] – এটা রীতিমতো পাগলামি। দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র একজন আক্রান্ত ব্যক্তি নিষেধাজ্ঞা না মেনে চার্চে প্রার্থনার উদ্দেশ্য গিয়েছিল। সেখানে দুই দফায় এই রোগী আক্ষরিক অর্থেই হাজারো মানুষকে সংক্রমিত করে। এখন এই রোগী "রোগী ৩১" নামে পরিচিত[10]! মালেশিয়াতেও ধর্মীয় সমাগম থেকেই তাদের মহামারী ছড়িয়েছে[11]। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ইতিমধ্যেই সকল ধর্মীয় সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে, সৌদি আরব ওমরাহ হজ বাতিলের সাথে সাথে দেশজুড়ে সব মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ করেছে[12], মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশে এমনকি আজানের বাণীকেও পরিবর্তিত করা হয়েছে মুসল্লিদের ঘরে নামাজ আদায়ে উৎসাহী করতে[13]। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও একইভাবে জনসমাগম রোধের উদাহরণ রয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে সরকার এই ধরনের জনসমাগমে বিধিনিষেধ আরোপ না করলে তা আদতে ফলপ্রসূ হবে না বলেই আমরা মনে করি। এসব উদাহরণ এবং ব্যাখ্যা কাজে লাগিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়'কে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় জোরালো জনসংযোগ এবং নীতিনির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন-সহ অন্যান্য ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সাথে সমন্বয় সাধনের দায়িত্বও মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে।

ঘ. রাজনৈতিক মিটিং মিছিলের অনুমতি কোনোভাবেই দেওয়া উচিৎ হবে না। কিছু কিছু এলাকায় ভোট গ্রহণের কথা আছে – সেগুলো সাময়িক স্থগিত করা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের গড়িমসি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। আসন্ন ভোটগুলোর জনাকীর্ণ প্রচারণা সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে জনকল্যাণকর। এক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনকে সমন্বিতভাবে শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ইতিপূর্বে সরস্বতী পূজার জন্য নির্বাচনের সময় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এই সমন্বয় আমাদের চোখে পড়েছে। আমরা দেখেছি প্রার্থীরা নিজেরাই এক্ষেত্রে নির্বাচন পেছানোর জন্য আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি, এখন আমাদের আগের থেকেও অনেক বেশী সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন, রাজনৈতিক দৃঢ়তা প্রয়োজন।*

২) বর্ডার কন্ট্রোল এবং বিদেশ থেকে আগতদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন নিয়ে অনেক ধরনের কথা শোনা গেছে। কেউ কেউ আন্দোলন করেছে, এবং সেই মতে অনেককেই নাকি হোম কোয়ারেন্টিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে একদিন পরই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এরপর অনেককেই দেখা গেছে বাসায় না থেকে ঘুরে বেড়াতে, আড্ডা দিতে, বন্ধুবান্ধব পরিবার পরিজনসহ সমুদ্র সৈকতে আনন্দভ্রমণ করতে, এমনকি মহা ধুমধামে বিয়ে সম্পন্ন করে অনুষ্ঠানাদি করতে! এদের শাস্তি প্রাপ্য, এবং সেই শাস্তি বিধানে যে সংক্রামক রোগ আইন, ২০১৮-এর[14] প্রয়োগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে তা আশার কথা[15]। তবে, শঙ্কার ব্যাপার হলো, শাস্তি দিয়েই কিন্তু সংক্রমণ আটকানো যাবে না। ক্ষতি যা হবার হয়েই যাবে। অতএব, কোয়ারেন্টিন যে বাধ্যতামূলক, সেটাকে কথায় না রেখে কাজে রূপান্তরিত করতে হবে। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে পরিপূর্ণ পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দ্রুততার সাথে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে এই সমন্বয়ের ভিত্তিতে স্থলবন্দরে বিজিবি ও নৌবন্দরে কোস্টগার্ডকে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিমানবন্দরে বিদেশফেরতদের সরাসরি কোয়ারেন্টিনে পাঠাবার উদ্যোগটি একটি ভালো উদ্যোগ[16], দেরিতে গৃহীত হলেও।

৩) সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। সাধুবাদ বন্ধ করার জন্য, দেরিতে হলেও। উল্লেখ্য যে কোচিং সেন্টারগুলোও এই বন্ধের আওতায় থাকলেও সেগুলোর তদারকির জন্য স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতা একান্ত প্রয়োজন; তাই সেই সুস্পষ্ট নির্দেশনা তাদের কাছে থাকতে হবে। তবে, এই বন্ধ কেবল ৩১ তারিখ পর্যন্ত কেন? এর কি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে? নাকি, অনির্দিষ্টকাল বা যতদিন ভাইরাসের সংক্রমণ আয়ত্তে না আসছে, ততদিন পর্যন্ত বন্ধ রাখা দরকার? আমরা মনে করি  যদি আগেভাগে আবার স্কুল/কলেজ খুলে যায়, তাহলে আমরা যা অর্জন করবো, তা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার হারিয়ে ফেলব। এসব ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই অযথা তাড়াহুড়ো করা যাবে না এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দৃঢ়তার সাথে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে অনেকেই নানান পর্যটন স্থানে ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই প্রবণতা রোধকল্পে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়'এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে স্থানীয় প্রশাসন বরাবর।

৪) করোনাভাইরাস পজেটিভ কোনো রোগীর মৃত্যু হলে, সেই মরদেহ সৎকারের ব্যাপারে কার্যকরী, দৃঢ় কিন্তু মানবিক প্রটোকল থাকাটি অত্যন্ত প্রয়োজন!  আমাদের বিশ্বাস ইতিমধ্যেই একটি প্রটোকল বিদ্যমান আছে। তবে মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে একটি সুষম ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় – যাতে করে এধরণের মৃতদেহ থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং একই সাথে আবার এমন পারিবারিক আবহ তৈরি না হয় যা পরবর্তীতে জনমানসে করোনা সংশ্লিষ্ট উপসর্গ গোপনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানেও জনসমাগম বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫) স্বাস্থ্য ও তথ্য মন্ত্রণালয় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে সংক্রমণের হার কমানোর (flattening the curve) ধারণাটির ব্যাপারে সকল মন্ত্রী, তথ্য সম্প্রচার দপ্তর, এবং সকল স্বেচ্ছাসেবীদের মাঝে সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়ে সে অনুসারে কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

৬) এই লেখাটি লিখতে গিয়ে আমরা সবথেকে বেশি যেটা অনুভব করেছি তা হচ্ছে, প্রতিটি কার্যক্রমের ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদেরকে নির্দিষ্ট করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সরকারি দপ্তরের দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। অথচ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২'র ২ এর ১১(ই) ধারা অনুসারে উদ্ভুত এই 'প্যান্ডেমিক' পরিস্থিতিটি একটি জাতীয় দুর্যোগ হিসেবেও বিবেচিত হবার কথা[17]। এবং এধরণের ক্ষেত্রে একই আইনবলে গঠিত জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক গোটা পরিস্থিতির বিশ্লেষণ, ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সাধন ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করবার কথা। বাংলাদেশে জলবায়ুগত দূর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বেই অনুকরণীয়, সুতরাং সরকারি এই অধিদপ্তরের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতা আছে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। আমরা যদিও এই বৈশ্বিক মহামারী ঘোষিত হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই কাউন্সিলের কোনো সমন্বিত সভার সংবাদ জানতে পারিনি, কিম্বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনার ব্যাপারে জানতে পারিনি, তবুও আমাদের দাবি থাকবে যথাদ্রুত উপরোক্ত পরিকল্পনা ও পরামর্শসমূহকে আমলে নিয়ে এই আইনয়ানুগ সত্তাটি কর্তৃক প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব গৃহীত হবে।

স্বাস্থ্যসেবা খাতের সাফল্য-ব্যর্থতা ও করণীয়

বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্ভবত বাংলাদেশের সবথেকে তৎপর এবং মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মন্ত্রণালয়টির নাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানটির নাম রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (IEDCR)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অন্তর্গত এই প্রতিষ্ঠানটি নিঃসন্দেহে এ ধরণের অবস্থায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান এবং এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে যতটুকু সফলতা বা ব্যর্থতা তার সিংহভাগের সরাসরি কৃতিত্ব তাদেরই প্রাপ্য। তবে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তাদের স্বদিচ্ছার হয়তো কোনো ঘাটতি আসলেও নেই, তবে সে অনুযায়ী তাদের জনবল, সামর্থ, পরিকল্পনা, এমনকি নীতিমালাসমূহও যথেষ্ট কার্যকরী হিসেবে প্রতিয়মান হচ্ছে না।

১) রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা/টেস্ট: এই মুহূর্তে সবচাইতে দরকারি বিষয় হচ্ছে যতবেশি সম্ভব করোনাভাইরাস নির্ণয়ের পরীক্ষা কেন্দ্র চালু করা। এক্ষেত্রে IEDCR এর কৌশল এককথায় আত্মঘাতী। তাদের বর্তমান প্রটোকল অনুসারে তাদের হটলাইন মারফত যোগাযোগের সূত্রে রোগীর উপসর্গ, বিদেশ ভ্রমণ ইতিহাস ও পারিবারিক সংসর্গ যাচাই'এর মাধ্যমেই  কেবল এই টেস্ট করা সম্ভব। এ ধরণের প্রটোকল নীতিগতভাবেই তথ্যবিকৃতি বা তসরুপের ফাঁদে পড়তে বাধ্য এবং লোকাল/পারিবারিক সংক্রমণ ব্যতীত আর কোনো প্রকার সংক্রমণকেই শনাক্ত করতে অকার্যকর। অনতিবিলম্বে এই প্রটোকলে পরিবর্তন এনে বয়স ও ভ্রমণ-ইতিহাস বা সংসর্গ নির্বিশেষে কো-মরবিডিটি আছে এমন সকলের ক্ষেত্রে এবং কো-মরবিডিটি নেই এমন বয়স্ক কারো ক্ষেত্রে "শ্বাসকষ্ট" থাকলেই টেস্টের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নইলে সামাজিক সংক্রমণ কোনোক্রমেই সনাক্তকরণ সম্ভব নয়। সংক্রমণের সংখ্যা ও ব্যাপকতা আমরা যদি সঠিক ভাবে জানতে না পারি, তাহলে এই রোগের বিস্তার রোধে সঠিক নীতিগত সিদ্ধান্তও আমরা নিতে ব্যর্থ হব।

২) রোগ নির্ণায়ক টেস্ট কিট: পরীক্ষার ক্ষেত্রে নীতিগত পরিবর্তন আনার প্রথম বাধাটি হচ্ছে টেস্ট কিটের সংখ্যা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংখ্যানুসারে বর্তমানে টেস্ট কিটের সংখ্যা মাত্র হাজার দেড়েক। অথচ তারপরও আমরা গণমাধ্যমে ও সংবাদ সম্মেলনগুলোতে IEDCR এর পরিচালককে বলতে শুনছি যে- তাদের কাছে পর্যাপ্ত কিট রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে দৈনিক ১০০০ টেস্ট করতে পারবার ফেসিলিটি সম্পন্ন ল্যাবে গত দু'মাসে কেন মাত্র তিনশো টেস্ট পরিচালিত হয়েছে তার ব্যখ্যা পাওয়া যায় না। সুতরাং ওনার এ ধরণের অবাস্তব দাবি করবার কারণ স্পষ্ট নয়, তবে কারণটি যাই হোক তা কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরি! ইতোমধ্যেই আরো ১০,০০০ কিট সিঙ্গাপুর হয়ে দেশের পথে এবং চীন সরকার মারফত আরো ১০,০০০ কিট সাহায্য হিসেবে প্রেরিত হয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। যদিও ১৮ কোটি মানুষের দেশে এই ২০,০০০ টেস্ট কিটও নিতান্ত নগণ্য, তবে এক্ষেত্রে উপরোল্লেখিত প্রটোকল পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্তত কিছুটা হলেও এই সীমিত সংখ্যার সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব।

৩) পরীক্ষা বা টেস্টিং কেন্দ্র: পরীক্ষা বা টেস্টের ক্ষেত্রে প্রটোকলগত পরিবর্তন আনতে দ্বিতীয় যে বাধাটি আসতে পারে তা হচ্ছে- IEDCR এর কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। IEDCR পরিচালক একাধিকবার জানিয়েছেন যে, করোনাভাইরাসের পরীক্ষা ঢাকায় তাদের নিজস্ব ল্যাব'এর বাইরে যেখানেই হোক না কেনো তা সরাসরি IEDCRএর তত্ত্বাবধানেই হতে হবে কারণ সেই দক্ষতা কেবলমাত্র তাদেরই আছে। ভাইরাস কন্টেইনমেন্ট, লেভেল-৩ বায়োসেফটি ল্যাব পরিচালনায় দক্ষতা, কোভিড-১৯ পজেটিভ কেসের ক্ষেত্রে কন্টাক্ট ট্রেসিং ইত্যাদি সম্পন্ন করতে যে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন আছে তা অনস্বীকার্য। পর্যাপ্ত টেস্টকিট থাকলেও লেভেল ৩ বায়োসেফটি ল্যাব না থাকলে নিউ-করোনোভাইরাসের পরীক্ষা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এটা কোনোক্রমেই ঢাকাভিত্তিক এই সনাক্তকরণ পরিকল্পনার সঠিকতা প্রমাণ করে না। এক্ষেত্রে তাই IEDCR এর দায়িত্ব টেস্টিং কেন্দ্র কেন্দ্রীভূত করে না রেখে বরং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই দক্ষ জনবল তৈরি করা। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এই কাজে সর্বোচ্চ শক্তি বিনিয়োগ করা যাতে তাদের পূর্বতন ঘোষণা মতো ৮টি বিভাগে কেবল করোনা তথ্যকেন্দ্র নয়, বরং ৩য় স্তরের বায়োসেফটি সম্পন্ন সনাক্তকরণ কেন্দ্রও গড়ে ওঠে! আইসিডিডিআরবি এর মত গবেষণা কেন্দ্র দেশে আছে – তাদের এবং অন্যান্য সরকারি ও বড় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করে রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা পদ্ধতির বিকেন্দ্রীকরণ খুবই সম্ভব, এবং সেটা অল্প সময়েই।

৪) দ্রুত সনাক্তকরণ কিট: এখানে একটি অপ্রিয় কথা বলতে হচ্ছে। আমরা সম্প্রতিই জানতে পেরেছি শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি নির্ভর একটি "দ্রুত সনাক্তকরণ" কিট গণস্বাস্থকেন্দ্র কর্তৃক উদ্ভাবিত হবার প্রেক্ষিতে, ঔষধ প্রশাসনের কাছ থেকে এর উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির অনুমতি নিয়েছে তারা। এক্ষেত্রে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে- পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড গত সপ্তাহেই এ ধরণের রেপিড টেস্ট-কিট ব্যবহারের ব্যাপারে শক্তভাবে নিরুৎসাহিত করেছে- কারণ এর সেনসিটিভিটি ও স্পেসিফিসিটি পরীক্ষিত নয়, এবং ফলস-নেগেটিভ বা ফলস-পজেটিভ ফলাফলের আধিক্য থাকলে তা যথাক্রমে মিথ্যা নিশ্চয়তার ফলে ভয়াবহ সংক্রমণ বিপর্যয় বা ব্যাপক সামাজিক ভীতির ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর অহেতুক চাপ তৈরি করতে পারে। আশার কথা এই যে- IEDCR এই টেস্ট-কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে চূড়ান্ত অনুমোদনের অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্ণ পরীক্ষণ উতরে এই কিট বাজারে এলে তা অবশ্যই সাধুবাদের যোগ্য; তবে এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, রাজনৈতিক সঠিকতা কিম্বা জনতোষণের মানসিকতা থেকে কোনোক্রমেই যেন তাড়াহুড়ো করে এই টেস্টকিটের বাণিজ্যিক অনুমোদন না দেয়া হয়।

৫) সরবরাহ ব্যবস্থাপনা বা রিকিউজিশন: প্রশ্ন আসতে পারে সেক্ষেত্রে রোগ সনাক্তকরণে যে বিরাট ঘাটতি তা সামাল দেয়া যায় কীভাবে? এক্ষেত্রে ঢাকার মধ্যে IEDCR বাদেও icddr,b, অ্যাপোলো, ইউনাইটেড ও স্কয়ার হাসপাতালকে বায়োসেফটি ল্যাব স্থাপন করার নির্দেশ দেয়া যাতে পারে। জরুরি অবস্থায়, সরকারের অধিযাচন করার ক্ষমতা আছে এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহার করার সঠিক সময় এখনই। সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের দায়িত্ব নেয়া উচিত IEDCR এর। প্রয়োজনে দায়িত্ব বন্টনের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে একটি প্রশিক্ষণ পাঠ্যসূচি এবং বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ দল গঠন করা হোক, যারা বায়োসেফটি নিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন নির্ভরযোগ্য হাসপাতালগুলোকে নির্দেশনা দিতে পারবেন। এই উদ্যোগ নেয়া হলে, প্রয়োজনে ব্যক্তিউদ্যোগেও অনেকে এই ভাইরাসের পরীক্ষা করে নিতে পারবেন। এতে করে সরকারি খরচ কমবে, কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার উপর চাপও কিছুটা হলেও কমবে, সাথে বাড়বে টেস্টের পরিমাণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়'এর পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ নেয়াটা এখন খুবই প্রয়োজন। কেবল পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন ও রোগ নির্ণয় নয়, বরং দক্ষ ডাক্তার, নার্স, মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট – এক কথায় স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সকল কিছুই সরকার অধিযাচন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত হাসপাতাল, বেসরকারি সকল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা, সকলের কাছ থেকেই সাময়িক ভাবে নিতে পারে।

৬) স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের উপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব: এই মুহুর্তে এবং পুরোটা সময় জুড়েই সবচাইতে বেশি ঝুঁকির মুখে আছেন চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যকর্মীরা। মহামারী ও বৈশ্বিক মহামারীর ইতিহাস থেকেই আমরা জানি সংক্রামক রোগের স্বাস্থ্যকর্মীরাই অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে (disproportionately) প্রভাবিত হন। একাধিক গণমাধ্যম সূত্রে এখন এটা আমাদের জানা যে, চিকিৎসা কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (PPE) নেই। এর ফলশ্রুতিতে ক'জন চিকিৎসক গৃহে অন্তরীণ (হোম কোয়ারেন্টাইন) হতেও বাধ্য হয়েছেন বলে আমরা জানতে পারছি। এই সমস্যার দ্রুত সমাধান জরুরি। নাহলে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এখানে পিপিই'র পর্যাপ্ততা একটি মূল সমস্যা, তবে সে আলোচনা আমরা পরবর্তীতে করব। এই অংশে মূলত এর ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতা নিয়ে বলতে হচ্ছে। আইইডিসিআর পরিচালক দাবি করছেন যে উনাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পিপিই আছে এবং সেগুলোকে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে বন্টন করছেন! অথচ, আমরা জানতে পারছি যে স্থানীয় পর্যায়ে পিপিই'র অভাবে চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, রোগীমৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। সুতরাং হয় এখানে অসত্য আছে, নয়তো ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে! এই ত্রুটির সংশোধন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে হওয়া জরুরি। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থাপনা এমনিতেই বিভিন্ন ভারে ভারাক্রান্ত, স্বাস্থ্যকর্মী হারিয়ে আমরা কেবল আত্মহননের পথেই এগিয়ে যাব।

৭) অন্যান্য শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ ও আইসোলেশন বা অন্তরণ: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট প্রটোকল এবং যুগপত চিকিৎসা কর্মীরা পিপিই না পেলে করোনা নয় এমন নিউমোনিয়া বা অ্যাজমা অ্যাটাক এমনকি হার্ট অ্যাটাকেও (কিছু ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের রোগীও শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসতে পারেন) মৃত্যু ঘটবে অনেক। যেহেতু সনাক্ত করা যায়নি, আমরা জানবো না এটা করোনার জন্যে কি না, এবং ফলশ্রুতিতে এটা আরো আতংক ছড়াবে। খবরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাষ্যে প্রকাশ যে- জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশন ওয়ার্ড খুলতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একান্ত দায়িত্ব এই যে- এই নির্দেশ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে অনতিবিলম্বে। আপাতত, শ্বাসতন্ত্রজনিত যেকোনো উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের কাঁধ থেকে ঝেড়ে না ফেলে (ডিশোল্ডারিং) আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসাপ্রদান শুরু করতে হবে।

৮) অক্সিজেনের যোগান নিশ্চিতকরণ: এখনো পর্যন্ত পাওয়া হিসেব অনুসারে প্রায় ২০% কভিড আক্রান্ত রোগীর অসুস্থতা গুরুতর থেকে সংকটাপুর্ণ হয়ে উঠতে পারে। গুরুতর রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন এর যোগান থাকাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে অক্সিজেন বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদনের সক্ষমতা দেশের ভেতরেই বিদ্যমান। তাই তীব্র সংকট শুরু হবার পূর্বেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের খুবই জরুরি দায়িত্ব হবে অক্সিজেনের উৎপাদকদের সাথে জরুরিভিত্তিক সমন্বয়সাধণ করা এবং তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেনের যোগান প্রস্তুত রাখতে নির্দেশনা দেয়া।

৯) ভেন্টিলেটর সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান: করোনা ভাইরাস অন্তত ৫-৬% রোগীর অবস্থা সংকটাপূর্ণ করে তোলে। এই অবস্থায় তাদের রক্ষার জন্য সবথেকে বেশি যে চিকিৎসা সরঞ্জামটির প্রয়োজন তাহলো মেডিকেল ভেন্টিলেটর[18]। আমাদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বাদে এই সরঞ্জামের যোগান নেই। এডভান্স জার্নাল অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন'এ ড. নাফসিন মোস্তফা'র প্রকাশিত প্রবন্ধের হিসেবে গোটা দেশে আইসিইউ বেড'এর সর্বমোট সংখ্যা সাকুল্যে মাত্র ১০০০, যার মাত্র ২২৩টি আছে সরকারী মালিকানায়[19]! অথচ, দেশের ১% মানুষও যদি করোনা আক্রান্ত হয় তবুও সংকটাপূর্ণ রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়াবে! সুতরাং, এই মুহূর্তে PPE এবং টেস্টকিট নিয়ে যে পরিমাণ হাহাকার আমরা লক্ষ্য করছি, কিছুদিনের মধ্যেই সেই হাহাকার করতে হবে ভেন্টিলেটর নিয়ে! শত শত, বা হয়তো হাজার হাজার সংকটাপূর্ণ রোগীকে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে হবে এই অতি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামটির অভাবে। এই আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পেতে শীঘ্রই কয়েকটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন:

ক. সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অতিদ্রুত বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আয়ত্তাধীন ভেন্টিলেটরসমূহের প্রাপ্র্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। প্রয়োজনের সময়ে যত দ্রুত সম্ভব বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে এই সেবা গ্রহণের ব্যাপারে সরকারকে কিভাবে এগোতে হবে সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে এই দূর্যোগ মুহূর্তে এগিয়ে আসতে আলোচনার ভিত্তিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

খ. গোটা পৃথিবীতেই বর্তমানে মেডিকেল ভেন্টিলেটরের বিপুল চাহিদা দেখা দিয়েছে[20]। সে কারণে এটা মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি যে চাইলেই সরকারের পক্ষে হয়তো হঠাৎ এই সরঞ্জামের বড় যোগান সহসাই হাতে পাওয়া সম্ভব না। সে কারণে দেশের ভেতরে ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত ভেন্টিলেটরগুলোর সুষম ব্যবহারের যথার্থ নীতিবিধি গ্রহণের পাশাপাশি সরকারকে দেশীয় হাইটেক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে (ওয়ালটন, আরএফএল, মিনিস্টার ইত্যাদি) প্রণোদনা প্রদান করতে হবে দেশীয় প্রযুক্তিতেই ভেন্টিলেটর উৎপাদনের। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এই মহামারীকালীন পৃথিবীতে "নিত্যপ্রয়োজন"এর অনেক সংগাই বদলে যাচ্ছে। গাড়ী বা উড়োজাহাজ উৎপাদক ভক্সহল ও এয়ারবাস তাদের বিলাস পণ্যের উৎপাদন বন্ধ রেখে তৈরি করছে জীবনরক্ষাকারী ভেন্টিলেটর[21]! সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রনালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে কেবল এই দূর্যোগে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া নয় বরং একইসাথে বৈশ্বিক বাজার ধরার মতো সক্ষমতাও অর্জন করতে পারে।

গ. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বায়ো-মেডিকেল সায়েন্স, যন্ত্রকৌশল, তড়িৎকৌশল ইত্যাদি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করেই গৃহনির্মীত ভেন্টিলেটর যন্ত্র[22] তৈরির উদ্যোগ নিতে পারেন। সেই সাথে স্থানীয় হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোকে সহযোগীতা প্রদান করতে পারেন এই দুর্যোগে আরো কিছুটা ভালোভাবে সেবাদান করতে।

ঘ. একই ভেন্টিলেশল যন্ত্র ব্যবহার করে একাধিক রোগীকে সেবাদানের বিজ্ঞানভিত্তিক এবং সফল পদ্ধতিটি ব্যবহারের মাধ্যমে আপদকালীন পরিস্থিতিতে খুব দ্রুততার সাথে অধিক সংখ্যক রোগীর জীবনরক্ষা এবং বিদ্যমান চাহিদাকে আনুপাতিক হারে কমানো সম্ভব। এখানে উল্লেখিত তথ্যসূত্রে গবেষণাটি এবং পদ্ধতিটির ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট যে কেউ এখান থেকে বিস্তারিত জ্ঞানার্জন করতে পারেন [23] [24]

১০) সংক্রমণের মাত্রা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন সংক্রমণ কমিউনিটি/সামাজিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, অন্য দিকে সেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরভুক্ত IEDCR এরই পরিচালক তার সর্বশেষ ভাষ্যেও বলেছেন সংক্রমণ এখনো লোকাল/পারিবারিক পর্যায়েই কেবলমাত্র সীমাবদ্ধ। এই সাংঘর্ষিক বক্তব্য দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ করে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা এবং আমাদের দেশে সেটার বিস্তার, বর্তমান টেস্টিং প্রটোকলের ফাঁকফোঁকড় এগুলোকে বিবেচনায় নিলে বোঝা যায় – এই রোগের সংক্রমণ এখন ঠিক কোন পর্যায়ে রয়েছে তা নিয়ে সন্দিহান থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই সন্দিগ্ধতা নিরসনও অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে খুবই তড়িৎ গতিতে সমন্বয়সাধন করতে হবে এবং এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ ধরণের সমন্বয়হীনতা কঠোরভাবে এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করতে হবে।

১১) স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা সেবার বিকেন্দ্রিকরণ: যখন সংক্রমণ কমিউনিটি ট্রান্সমিশনে বা সামাজিক সংক্রমণ যাবে (হয়তো চলেই গেছে, আমরা জানি না), তখন অসংখ্য মানুষের চিকিৎসার দরকার হবে। এবং এই প্রয়োজন হবে সারা দেশজুড়ে, কেবল ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকবে না এই ঘটনাগুলো। আমরা কি প্রস্তুত? ঢাকার বাইরে হাসপাতালে যথেষ্ট বেড নেই (আসলে, যেই আকারে মহামারী দেখা দেবে, সেটার জন্য ঢাকাও প্রস্তুত নয়!)। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে – তাই আমরা মনে করি, অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প তৈরি করতে হবে, যেখানে থাকবে মৃদু/মাইল্ড, তীব্র/সিভিয়ার, এবং সংকটপূর্ণ/ক্রিটিকাল কেইসগুলো আলাদা করার স্ক্রিনিং নীতিমালা, যাতে করে সিভিয়ার কেইসগুলো রেফার করে দেয়া যায় জেলা বা সেন্ট্রাল/ঢাকা পর্যায়ে। এর জন্য আমাদের তড়িৎ গতিতে অনেক অনেক স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রশিক্ষিত করতে হবে– দক্ষ জনবল তৈরি করে তাদেরকে কেন্দ্রীভূত না রেখে বরং কেন্দ্রীয় চেইন অব কমান্ডের ভেতরে নিয়ে আসতে হবে। এদের কাজ হবে বিশেষায়িত। তারা এই ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গগুলো  জানবে এবং স্ক্রিনিং এ পারদর্শী হবে। এই মর্মে প্রয়োজনে আইসিডিডিআরবি এর সহায়তা চাইতে হবে। এটা খুবই সম্ভব, যদি সদিচ্ছা থাকে।

১২) করোনা মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ: করোনা মোকাবেলায় গোটা স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতাই বাড়াতে হবে। এই খাতে দরকার হলে অন্য খাত থেকে এনে অর্থনৈতিক বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে, এবং সেটা সম্ভব হবে রাতারাতি প্রধানমন্ত্রীর আদেশ বলে। হাজার হাজার টেস্ট করতে পারতে হবে; আইসিইউ-এর ভেন্টিলেটোরের সংখ্যা নিরূপন করে সেটা বাড়াতে হবে; স্বেচ্ছাসেবী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দূর শিক্ষণের মাধ্যমে খুব দ্রুত হটলাইনে স্বেচ্ছাসেবা দেবার মতো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব।

১৩) জরুরী পিপিই উৎপাদন: তৈরি পোষাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বিশ্ব নন্দিত। দেশের জরুরি অবস্থায় আমরা মনে করি কয়েকটি পোষাক তৈরির কারখানা এগিয়ে আসলেই জরুরি পিপিই উৎপাদন করে জায়গা মতো পৌছে দেয়া খুব সমস্যার ব্যাপার হবে না। স্ব উদ্যোগে কেউ এগিয়ে না আসলে জরুরি অবস্থায় সরকারি নির্দেশেই এই কাজ করানো সম্ভব বলে আমরা মনে করি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে সমনন্বয়ে কাজ কাজ করতে পারে।

১৪) সম্ভাব্য ওষুধসমূহের ব্যবহার ও যোগান: ইতিমধ্যেই অন্যান্য বিভিন্ন দেশে এই রোগের চিকিৎসায়, এন্টি-হেপাটাইটিস[25], এন্টি-ম্যালেরিয়াল[26] ও এন্টি-এইচআইভি[27] বেশ কিছু ঔষধ কার্যকর হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এগুলোর কোনোটির ব্যাপারেই এখনো সিদ্ধান্ত নেবার মতো যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবুও ভুক্তভোগী দেশসমূহের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যখাত যেন প্রয়োজনেই এ সকল ওষুধের যোগান নিশ্চিত করতে পারে সেই সক্ষমতা গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।

স্বেচ্ছাসেবক, প্রবাসী, আপনি, আমি: করণীয়

১। প্রথমত, একটি সংকটকাল মানেই গুজবের ডালপালা ছড়িয়ে পড়া। তাই এমন কোনো তথ্য বিশ্বাস করবেন না, যা সমর্থিত নয়। আপনার ধারণার সাথে মিলে গেলেও না। সাবধানতা অবলম্বন করতে, আপাতত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত কোনো কিছুতেই বিশ্বাস রাখবেন না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ক্ষেত্রেও যেগুলোতে পিয়ার-রিভিউড বৈজ্ঞানিক কাজের আলোচনা করা হয়নি বা যেগুলো ওয়াকিবহাল গবেষকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়নি, এমন কোনো সংবাদ/তথ্যেও বিশ্বাস রাখবেন না। কেউ গুজব ছড়াচ্ছে বলে নিশ্চিত হলে স্থানীয় প্রশাসনকে জানান।

২। নিজেদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব ইত্যাদি) ব্যবহার করে যোগাযোগ জোরদার করুন। পারলে নিজেদের এলাকাভিত্তিক অনলাইন গ্রুপ গড়ে তুলুন। আপনার আশপাশে করোনা আক্রান্ত কোনো দেশ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে দেশেফেরা প্রবাসী কেউ বিনা কোয়ারেন্টিনে থাকলে, নিয়ম অমান্য করলে, এসব গ্রুপের মাধ্যমে তাদের সংবাদ প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করুন। দয়া করে নিজেরা লাঠিসোটা নিয়ে এদের সংস্পর্শে গিয়ে হাজির হবেন না।

৩। জনসমাগমে (ওয়াজ, জামাত, পুজো, বিয়ে, জন্মদিন, খেলা, মিলাদ, রাজনৈতিক মিটিং মিছিল, কনসার্ট ইত্যাদি) যাওয়া বন্ধ করুন এবং বন্ধু, পরিবারবর্গসহ অন্যকেও নিরুৎসাহিত করুন। কারো সামনে গেলেও নিরাপদ দূরত্ব (৩ থেকে ৬ ফুট) বজায় রাখুন।

৪। সবচেয়ে বড় যেটা করণীয় তা হচ্ছে – চলুন, আমরা সকলে ঘরেই থাকার চেষ্টা করি যতদূর সম্ভব। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করি। এবং অন্যকেও এই কাজে উৎসাহিত করি। যেসব স্বেচ্ছাসেবী জনে জনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা এই কাজ থেকে বিরত থেকে বরং সবাইকে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যাপারে জানান। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের তুলনায় সাবান অধিক কার্যকর। দেশীয় ক্ষারযুক্ত কমদামী পঁচা সাবান আরো বেশি কার্যকর। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে লিফলেটের ব্যবহার ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ, এড়িয়ে চলুন। দরকারে ব্যক্তি উদ্যোগে মাইকিং-এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে জনসাধারণের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতের ব্যবস্থা করুন।

৫। ছোটখাট শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে আপাতত চিকিৎসা কেন্দ্রে বা হাসপাতালে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন এবং একই সাথে আশেপাশের অন্যকেও বিরত রাখতে চেষ্টা করুন। পরিবারের যে কারো যেকোনো প্রকার ফ্লু (flu) জাতীয় অসুস্থতা চোখে পড়লে নিজ উদ্যোগে গোটা পরিবার নিয়ে হোম-কোয়ারেন্টিনে থাকতে চেষ্টা করুন অন্তত ২ সপ্তাহ। তা সম্ভব না হলে অন্যদের থেকে নিজ দায়িত্বে দূরত্ব বজায় রাখুন এবং মাস্ক পরিধান করুন।

৬। নিজের উদ্যোগে পারলে মাস্ক বানাবার দায়িত্ব নিতে পারেন। এক্ষেত্রে মাথায় রাখুন – স্থানীয়ভাবে মাস্ক বানাবার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক কাঁচামালের অভাব রয়েছে। সেক্ষেত্রে যেকোনো প্রকার কাপড় দিয়ে মাস্ক বানালেই তা কার্যকর হবে না। বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য বলছে গেঞ্জির কাপড়ের তুলনায় ডিশ-টাওয়েল/টি-টাওয়েল ভাইরাস প্রতিরোধে বেশ কয়েকগুণ অধিক কার্যকর[28] [29]। এ ধরনের টাওয়েল দেশেই কিনতে পাওয়া যায়। আরো বিস্তারিত জানতে এখানে উল্লিখিত তথ্যসূত্রটি অনুসরণ করতে পারেন। তবে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, জরুরি পরিস্থিতিতে সার্জিকাল মাস্কের অনুপস্থিতিতেই কেবল এই মাস্ক ব্যবহৃত হতে পারে!

৭। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (PPE)-এর বিপুল চাহিদা শীঘ্রই দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে তৈরি হবে, সেই যোগানে যথেষ্ট ঘাটতিও রয়েছে। ইতিমধ্যেই বিদ্যানন্দ[30] নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন নিজ উদ্যোগে এ ধরনের PPE তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে[31]। নিজেদের তৈরি PPE-গুলোর ব্যবহারিক মান ও চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহারোপযোগিতা নিশ্চিত করতে সংগঠনটি চেষ্টা করছে। IEDCR কর্তৃক এদের তৈরিকৃত PPE-র মান পরীক্ষিত হলে, ঘরে বসে, পর্যাপ্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই তাদের সহযোগিতা করতে পারেন আপনারা, শ্রম কিংবা আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে। প্রবাসীরা এই মুহূর্তে দেশে না গিয়ে এসব উদ্যোগে সহায়তা করতে চেষ্টা করুন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনার কাছে দাবি

করোনা বৈশ্বিক মহামারী – সে কেবল আমাদের দেশের জন্য নয়, বরং বিশ্বের জন্যই এই অমোঘ বার্তা নিয়ে এসেছে যে, সে লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ঘটাতে পারে। দুনিয়ার সকল জনস্বাস্থ্য গবেষকগণ এই মর্মে একমত যে, একটি দেশও রক্ষা পাবে না এই করোনাভাইরাসের মরণছোবল থেকে। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের জন্য এর ঝুঁকি অন্য কারো চেয়ে কম তো নয়ই, বরং বেশি। আপনার মতো দেশি ও আন্তর্জাতিক নেতারা যদি এখনই সঠিক ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করেন, তাহলে এই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের অবসান হবে আপনাদেরই হাতে।

আমরা বিশ্বাস করি, আপনি সকল নীতিনির্ধারণী বৈঠকেই আছেন, নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে, এই সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রয়োজন মনোবল। সেই মনোবল আপনি দিতে পারেন জাতির সামনে এসে। আপনার মুখেই জাতি শুনতে চায় দিক নির্দেশনার কথা। অবকাঠামো নিশ্চিতকরণের সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস প্রদান – সেটা জাতি আপনার কাছেই চায়। বৈজ্ঞানিকভাবে সুনির্দিষ্ট এবং আত্মপ্রত্যয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা চাই আমরা আপনার কাছে।

আমরা জানি, কঠোর সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন এবং সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা অর্থনৈতিকভাবে দেশকে অনেক দিনের জন্য ভোগাবে। কিন্তু, লক্ষ প্রাণ বাঁচানোর বিপরীতে এই ত্যাগ জাতি করবে, অবশ্যই করবে – আপনি সেই প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন আশা করি এবং সেটাকে কাজেও প্রতিফলিত করবেন। কোনো ধরনের গাফিলতি, গড়িমসি, আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে আপনি প্রশ্রয় দেবেন না। আপনার নীতিনির্ধারকদের বলে দিন, বলে দিন মন্ত্রী মেয়রদের, কেউই রক্ষা পাবে না নিজের কাজে অবহেলা করলে। করোনাভাইরাস ধনী গরিব চেনে না, করোনা রাজা প্রজা মানে না।

প্রিয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই ক্রান্তিলগ্নে জাতির উদ্দেশ্যে একটি বিস্তারিত, সুনির্দিষ্ট, ভবিষ্যৎমুখী ও নির্দেশনামূলক বক্তব্য আমরা আপনার কাছ থেকে চাইতেই পারি!

* বিঃ দ্রঃ এই লেখাটি যখন একেবারে শেষমুহূর্তে তখন আমরা জানতে পেরেছি যে দীর্ঘ গরিমসি এবং তিনটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ চালু রেখেই, পরবর্তী কিছু স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচনের তারিখ সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। দৃষ্টিকটু সিদ্ধানহীনতা সত্ত্বেও বিলম্বিত কিন্তু জরুরি এই সিদ্ধান্তকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: লেখাটি দাঁড় করাতে মূল্যবান সময় ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ড. মোহাম্মদ আব্দুল হালিম, রসায়ন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব আরকানসাস – ফোর্ট স্মিথ; ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন, ট্রাস্টি, আইসিএসএফ; ড. রায়হান রশীদ, ট্রাস্টি, আইসিএসএফ; ড. নজরুল ইসলাম, জনস্বাস্থ্য গবেষক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়; রানা মেহের, ন্যায়বিচার কর্মী; ড. সানজিব হোসেন, শিক্ষক, ওয়ারিক বিশ্ববিদ্যালয়; ডা. সিরাজুম মনিরা শাখী, সাবেক জনস্বাস্থ্য কর্মী, ডক্টরস উইদাউট বর্ডার।

[1] সাধারণভাবে মোট মৃতের সংখ্যাকে মোট সংক্রমিতের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই কেইস ফ্যাটালিটি রেশিও পাওয়া যায়। তবে, CFR নির্ধারণের আরো অনেক পদ্ধতিও আছে। আমাদের এই লেখার জন্য এই সাধারণ উপায়টিই যথেষ্ট।

[2] "Global Covid-19 Case Fatality Rates – CEBM." https://www.cebm.net/global-covid-19-case-fatality-rates/. Accessed 20 Mar. 2020.

[4] আমরা এখানে সাধারণ ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি, এবং শতকরা হারের ভগ্নাংশ না দিয়ে পূর্ণ নম্বরে প্রকাশ করেছি – আরো বিষদ ভাবে জানতে ও বুঝতে এই লিংকে যেতে পারেন।

[6] এই কথাগুলো আরো বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন।

[7] Quanrantine শব্দটির অর্থ মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা যাতে রোগ না ছড়িয়ে পড়ে। Home quarantine অর্থ নিজের ঘরের বাইরে বের হবার উপর নিষেধাজ্ঞা।

[8] "BBC Bangla – খবর – সবরকম মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ." https://www.bbc.com/bengali/mobile/news/2010/08/100823_mb_bdrally_ban.shtml. Accessed 20 Mar. 2020.

[9] "Coronavirus: Bangladesh mass prayer event prompts alarm …." 19 Mar. 2020, https://www.bbc.co.uk/news/world-asia-51956510. Accessed 20 Mar. 2020.

[12] "Saudi Arabia bans prayers at mosques over coronavirus fears …." 20 Mar. 2020, https://www.aljazeera.com/news/2020/03/saudi-arabia-bans-prayers-holy-mosques-coronavirus-fears-200320063001931.html. Accessed 20 Mar. 2020.

[13] "Islamic call to prayer changes in Kuwait amid coronavirus …." 14 Mar. 2020, https://www.theguardian.com/world/video/2020/mar/14/coronavirus-the-impact-on-islam-video. Accessed 20 Mar. 2020.

[14] "সংক্রামক রোগ – Laws of Bangladesh." 14 Nov. 2018, http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-details-1274.html. Accessed 20 Mar. 2020.

[15] "করোনাভাইরাস: বাংলাদেশে আসা প্রবাসীরা … – BBC.com." 13 Mar. 2020, https://www.bbc.com/bengali/news-51855214. Accessed 20 Mar. 2020.

[16] "সেনা পরিচালনায় কোয়ারেন্টিন আশকোনা ও … – Bdnews24." https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1736653.bdnews. Accessed 20 Mar. 2020.

[17] "দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ | ২। সংজ্ঞা – Laws of Bangladesh." 24 Sep. 2012, http://bdlaws.minlaw.gov.bd/act-1103/section-42225.html. Accessed 21 Mar. 2020.

[18] "Ventilators prevent coronavirus deaths—but there's a shortage …." 17 Mar. 2020, https://fortune.com/2020/03/17/coronavirus-ventilator-shortage/. Accessed 20 Mar. 2020.

[19] "Critical Care Medicine: Bangladesh Perspective – NCBI." 9 Jan. 2018, https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC6549198/. Accessed 20 Mar. 2020.

[20] "European countries search for ventilators as virus cases surge …." 15 Mar. 2020, https://www.ft.com/content/5a2ffc78-6550-11ea-b3f3-fe4680ea68b5. Accessed 20 Mar. 2020.

[21] "UK manufacturers to regear factories to build ventilators for NHS." 17 Mar. 2020, https://www.theguardian.com/business/2020/mar/17/uk-manufacturers-regear-factories-build-ventilators-nhs. Accessed 20 Mar. 2020.

[22] "The Pandemic Ventilator : 6 Steps (with Pictures) – Instructables." https://www.instructables.com/id/The-Pandemic-Ventilator/. Accessed 20 Mar. 2020.

[23] "COVID-19: Ventec Life Systems Stands Ready to Help with …." 17 Mar. 2020, https://www.venteclife.com/page/covid19-coronavirus-ventec-life-systems-stands-ready-to-help-with-vocsn. Accessed 20 Mar. 2020.

[24] "Neyman – 2006 – Wiley Online Library." https://onlinelibrary.wiley.com/doi/abs/10.1197/j.aem.2006.05.009. Accessed 20 Mar. 2020.

[25] "Diagnosis and treatment of 2019 novel coronavirus infection …." 5 Feb. 2020, https://link.springer.com/article/10.1007/s12519-020-00344-6. Accessed 21 Mar. 2020.

[26] "Doctors Turn to Malaria Drugs as Potential Coronavirus …." 20 Mar. 2020, https://www.wsj.com/articles/doctors-turn-to-malaria-drugs-as-potential-coronavirus-treatment-11584729626. Accessed 21 Mar. 2020.

[27] "China trials anti-HIV drug on coronavirus patients | World …." 7 Feb. 2020, https://www.theguardian.com/world/2020/feb/07/china-trials-anti-hiv-drug-coronavirus-patients. Accessed 21 Mar. 2020.

[28] "What Are The Best Materials for Making DIY Masks? – Smart …." 8 Mar. 2020, https://smartairfilters.com/en/blog/best-materials-make-diy-face-mask-virus/. Accessed 20 Mar. 2020.

[29] "Testing the efficacy of homemade masks: would they protect in …." https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/24229526. Accessed 20 Mar. 2020.

[30] "One Taka Medical Aid – Bidyanondo." https://bidyanondo.org/projects/One-Taka-Medical-Aid. Accessed 21 Mar. 2020.

[31] "করোনাভাইরাস: ডাক্তার নার্সদের মাঝে বিনামূল্যে গাউন বিতরণ …." 20 Mar. 2020, https://www.jagonews24.com/photo/bangladesh/event/7384. Accessed 21 Mar. 2020.