পুণ্যের আশায় দান করে পাপের ভাগীদার হলেন না তো?

Published : 5 March 2020, 10:03 AM
Updated : 5 March 2020, 10:03 AM

মুখে আমরা যাই বলি না কেন, মনে মনে আমরা সবাই পাপী। ভাবি, ইহকালটা কাটল আমার যেমন তেমন, পরকালটায় যেন ভালো থাকি। বুঝে না বুঝে কত ভুল যে হয়ে গেল জীবনে, সেসব কি করে শুধরানো যায় তাই নিয়ে চিন্তিত হই৷ হজ্জ্বে যাই, দান খয়রাত করি। ভাবি, শুধরানোর তো এখন আর সময় নাই তেমন, বেলা পড়ে এলো যে জীবনের। কিন্তু আল্লাহর নামে যদি কিছু দান খয়রাত করতে পারি, তাহলে একটু হলেও হয়তো সেই পাপের বোঝা কমতে পারে। আর সেই ভাবনা থেকেই আমরা অনেকেই মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করি , সাহায্য করতে চাই দ্বীন শিক্ষাকে। যদিও নিজেদের সন্তানকে সেখানে পড়াই না। কিন্তু ভাবি, আমার উছিলায় যদি গরীবের সন্তানেরা আল্লাহর পথে থাকে, দ্বীন শিক্ষা পায়, তাহলে আমার পুণ্য কামাই হবে। পরকালে ভালো থাকতে ইহকালের পুণ্য লাগে, তা কে না জানে? কিন্তু এই পুণ্য কামাই করতে গিয়ে উল্টা পাপের বোঝা বাড়ল কিনা, তার খবর কি রাখেন?

চারিদিকে আলোচনা/ সমালোচনা করার মতো, প্রতিবাদে ফেটে পড়ার মতো অসংখ্য ওজনদার ঘটনাবলীর ভীড়ে আমার এই "প্রশ্ন" হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে আপনার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং সেই আইনের প্রতিবাদে দিল্লিতে দাঙ্গা, মুজিব বর্ষ এবং মুজিব বর্ষে মেদিকে আমন্ত্রণ জানানো, পাপিয়া কাণ্ড, করোনাভাইরাস, ইত্যাদি ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রতিবাদে, সমালোচনায় আপাতত ব্যস্ত আছেন আপনারা। সেখানে এসব "কম গুরুত্বপূর্ণ" ইস্যু আপনাদের প্রতিবাদের তালিকায় জায়গা করতে পারে না। কিন্তু কি করব বলুন? আমাদের এই ব্যস্ততার ফাঁকে ধর্ষণের ধকল সহ্য করতে না পেরে নীরবে মরে গেলো কোনো এক মাদ্রাসা ছাত্রী, কোথাও নীরবে ধর্ষিত হয়ে চলেছে কোনো এক মাদ্রাসা ছাত্র, যাদের খবর রাখার দরকার পড়ে না এই বিদগ্ধ সমাজের। তাই অধম এই আমিই আবার বলতে এলাম, বহুবার বলা কথা। লিখতে এলাম বহুবার লেখা আমার নিস্ফল চিৎকার!

বিস্তারিত বলার আগে, সদ্য মরে যাওয়া আমেনা খাতুনের গল্পটা তো আগে বলে নেই। গল্প অবশ্য তেমন বিশেষ কিছু নয়। এই তো গতানুগতিক ধর্ষণ আর মৃত্যুর মতো মামুলি বিষয়। গত ২৪ ফেব্রুয়ারিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর সলিমগঞ্জে জান্নাতুল ফেরদৌস মাদ্রাসায় ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে ১২ বছরের আবাসিক ছাত্রী আমেনা খাতুনকে। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা মোস্তফা (৪০) অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করার সময় মরে গেছে আমেনা।

তো, এমন কতো ছাত্রীই তো ধর্ষিত হয় রোজ রোজ, মরে যায়। আরো একজন আমেনা মরে গেলে আমাদের আর ক্ষতি কি বলুন? যার বুকের ধন গেছে সে বুঝুক গিয়ে। তাছাড়া, মাদ্রাসায় আরো মওলানারা তো আছেনই, আছেন আরো হাফেজরা, যারা লাশের সুব্যবস্থা আর ধর্ষণের সত্য ধামাচাপা দেয়ার উদ্যোগ নিতে পারেন। যেমন উদ্যোগ নিয়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস মাদ্রাসার পরিচালক ও চারজন শিক্ষক। সবাই মিলে আমেনার লাশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন মাদ্রাসার চিলিকোঠায়!

এইতো গেলো এক আমেনার কথা৷ কিছুদিন আগেও একইরকম লালসার শিকার বানাতে না পেরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উজ দৌলার নির্দেশে পুড়িয়ে মারা হলো ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে। আখিরাতের ভয়, মিথ্যা হাদিস আর বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ৩ বছর ধরে ১১ জন ছাত্রীকে ধর্ষণ করলো নারায়ণগঞ্জের দারুল হুদা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মোস্তাফিজুর রহমান। ৮ থেকে ১১ বছর বয়সী আবাসিক ছাত্রীদের ধর্ষণের পর সেকথা গোপন রাখার জন্য কোরআন শরীফ ছুঁইয়ে শপথ করালো নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মা হাওয়া (আ.) কওমী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক (মুহতামিম) মওলানা খায়ের বেলালী। বগুড়ার সোনাতলা ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসায় উপবৃত্তির খবর নিতে এলে আলিম দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করলো অধ্যক্ষ ফজলুল করিম (৬২)।

শুধু কি মাদ্রাসা ছাত্রীরাই ধর্ষণের শিকার? না, বাদ যায় না ছাত্ররাও। এইতো ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে জামিয়া ইসলামিয়া যাইনুল আবেদীন মাদ্রাসায় পাঁচ শিশু ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ উঠল দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অক্টোবরে সোনাগাজী (ফেনী) উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মাদরাসাতু ওসমান (রা.) মাদ্রাসায় আবার ছাত্র বলাৎকারের ঘটনা ঘটে গেল। ধর্ষক মাদ্রাসার খাদেম নুর ইসলাম দরবেশ (৫৫)। আবাসিক ছাত্ররা জানালো, বলাৎকার এখানে নিয়মিত ঘটনা হলেও লজ্জায় অনেকে মুখ খোলে না। ডিসেম্বরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক মোবারক হোসেনকে একাধিক ছাত্রকে ধর্ষণের দায়ে গ্রেফতার করা হলো।

এমন অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনার কিছু নমুনা উল্লেখ করলাম মাত্র। প্রকাশিত ঘটনার সংখ্যাই এতো বেশি যে, অপ্রকাশিত বাস্তবতার কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার (আনুমানিক) কওমী মাদ্রাসার অর্ধেকেও যদি ধর্ষণ/যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে থাকে, তবে এর ব্যাপকতার মাত্রাটা আপনারাই ভেবে দেখুন।

বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসাগুলো মূলতঃ চলে দেশে বিদেশে থাকা ধনী ও স্বছল মুসলমানদের দান খয়রাতে। যারা পুণ্যের আশায় জাকাতের টাকা, ফিতরার টাকা অথবা দেশে বা বিদেশে বসে কামানো মোটা আয়ের একটা অংশ মাদ্রাসায় দান করেন। এইসব ধনী ব্যক্তিরা দান করেই তাদের দায়িত্বটুকু শেষ করেন, কিন্তু সেই টাকায় মাদ্রাসাগুলোতে আসলেই কতোটুকু দ্বীনের শিক্ষা দেয়া হয়, আর কতোটুকু নির্যাতন, অত্যাচার, ভোগ আর লালসার পাপকর্ম চলে, তার খবর কেউ রাখেন না!

এই আপনাকেই বলছি শুনুন, আপনার দানের টাকায় মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত হলে আপনি যদি পুণ্যের ভাগীদার হন, তবে সেখানে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে, হত্যার শিকার হলে, আপনি সেই পাপেরও ভাগীদার হন নাকি? সরকার এসব ব্যাভিচারের হাত থেকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে কি করবে জানি না, কিন্তু আপনি পুণ্য কামাতে গিয়ে আরো পাপ কিনবেন কিনা ভেবে দেখুন। যদি মাদ্রাসার শিশুদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারেন, ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে না পারেন, একটাও হত্যা বন্ধ করতে না পারেন, তবে শুধু পুণ্যের আশায় এইসব দান খয়রাত বন্ধ করুন। আপনার দানের টাকায় কোমলমতি শিশুদের জন্য এমন ধর্ষণের কারখানা আর মৃত্যুফাঁদ তৈরি হতে দেবেন না।

ভেবে দেখবেন আশা করি। সিদ্ধান্ত আপনার।