হিন্দুস্তান-পাকিস্তান: দাঙ্গার আঁধারে লুকোনো সাম্রাজ্যবাদ

আশফাক আনুপআশফাক আনুপ
Published : 4 March 2020, 08:46 AM
Updated : 4 March 2020, 08:46 AM

ব্রিটিশরা যখন মোটামুটি গোটা ভারতে শাসন প্রতিষ্ঠা করল, দিল্লিভিত্তিক মুঘলদের দাপ্তরিক কাগজপাতি অনুসারে তারা গোটা অঞ্চলকেই মোটাদাগে ফারসি শব্দ 'হিন্দুস্তান' দিয়ে ডাকতে আরম্ভ করল। উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ রচিত নানান মানচিত্রে গোটা ভারতবর্ষের নাম হিন্দুস্তান হিসেবে লিখিত হতে দেখা যায়। কিন্তু এটা নিয়ে বিলেতাগত ব্রিটিশ অফিসাররা মাঠে ময়দানে কাজকর্ম করতে গিয়ে পড়ল এক সমস্যায়। তারা দেখল উত্তর থেকে মধ্য ভারতের একটা সীমাবদ্ধ অঞ্চলের বাইরে কেউ হিন্দুস্তান চেনে না। এই বাস্তবতার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয় আর্থার কোক সম্পাদিত এংলো-ইন্ডিয়ান অভিধানটি। যেখানে 'হিন্দুস্তান' বলতে চিহ্নিত করা হয় বিশেষভাবে বাংলা ও বিহার ব্যতিরেকে নর্মদা নদীর উত্তর পাশের বাকি ভূখণ্ডকে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতেও এই একই এলাকার বিবরণ দেয়া আছে। অর্থাৎ আধুনিক সময়ে যে অংশটুকু পাকিস্তানের বালুচ সীমান্ত থেকে উত্তর-ভারতের মহারাষ্ট্রের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত [মানচিত্র ০১]। এই হচ্ছে মূলত ঐতিহাসিক হিন্দুস্তান। মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকের হিন্দুস্তানকে যারা জন্মশত্রু মনে করে সেই 'পাকিস্তান'ও আসলে ১৯৩০'এ কবি ইকবাল'এর পাকিস্তান-প্রস্তাবের আগ পর্যন্ত ঐতিহাসিক হিন্দুস্তানেরই অংশ ছিল। এমনকি কবি ইকবাল নিজেও 'সারে জহা সে আচ্ছা, হিন্দুস্থাঁ হমারা' শিরোনামে গানটানও লিখেছেন। আদতে হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ভিন্ন কোনো সাংস্কৃতিক/ ঐতিহাসিক ভূখণ্ড নয়।

উপরন্তু, বাঙালিকে বুঝতে হবে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান এগুলো কেবল অভিন্ন ভূখণ্ডই না, বরং একটি অভিন্ন মানসিক অবস্থাও বটে! ভূখণ্ড দু'টো বিহারের সীমান্তে এসে শেষ হলেও মানসিকতাটি বার বার চেষ্টা করেছে ওই সীমান্তটা ডিঙিয়ে বাঙালির মানসিক পরিসরে ঢুকতে। ক্ষেত্রবিশেষে সফলও হয়েছে। অনেকাংশে হয়ওনি! তো সেই মানসিকতাটা আসলে কী? খুব মোটাদাগে বললে– এটি হচ্ছে বাস্তুচ্যুত দখলদারদের মানসিকতা।

আর্য'রা হচ্ছে আদি-পারসিকদের থেকে তাড়া খাওয়া মধ্য-এশিয় দখলদারের দল। এখানে দুটো জিনিস লক্ষ্যণীয়। বাস্তুচ্যুত এবং দখলদার। কারণ, বাধ্য হয়ে উত্তর-ভারতে অভিবাসনের পরে সেখানকার বাসিন্দা না হয়ে মালিক বনে গ্যাছে তারা৪, ৫। এই মালিক বনবার প্রক্রিয়ায় তাদেরকে গোটা অঞ্চলে নিজেদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রয়োজনেই ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বও প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। হিন্দুস্তান-পাকিস্তান নামক অঞ্চলে মানুষের ভেতরে তাই ধর্ম ব্যাপারটি আত্মীক নয়, বরং মূলত রাজনৈতিক অস্তিত্বরক্ষার হাতিয়ার। সহস্রাব্দের অভ্যাসবশত তাই– যেকোনো বিরোধীপক্ষকে তারা মোকাবেলা করেছে ধর্মীয় ভিন্নতা/শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে। এরই ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলে টার্কিক দখলদারদেরকে তাদের জাতিগত পরিচয়ে নয়, বরং লড়া হয়েছে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। এমনকি সেই দখলাভিযানের ফলে ধর্মান্তরিত আর্যরাও ধর্ম ঠিকই বদলেছে, কিন্তু ধর্মাশ্রয়ী মানসিকতা বদলায়নি। তাই এই অঞ্চলের মানুষ ধর্ম-নির্বিশেষেই নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ধর্মীয় পরিচয়ের থেকে আলাদা করতে সক্ষম নয়। উত্তর-ভারতীয় হিন্দুস্তানি বা পাকিস্তানিরা তাই যে অভিন্ন মানসিকতাটি ধারণ করে তার নাম ধর্মীয় রাজনীতি! তাদের ঢাল এবং তলোয়ার দুটোই এই একই।

অন্যদিকে দক্ষিণ ভারত এবং বাংলার পরিস্থিতি মৌলিকভাবেই ভিন্ন। কারণ- এই ভূখণ্ডগুলো মূলত ভূমিপুত্র অধ্যুষিত অঞ্চল। আধুনিক নৃতাত্ত্বিক ও জেনেটিক গবেষণা ভারতবর্ষের মানুষের রক্ত-সাংকর্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করছে যে– দক্ষিণ ভারতে সরাসরি আর্য অনুপ্রবেশ ঘটেছে অতি সামান্য [৪]; আর বাংলায় আর্য উপনিবেশের পরিবর্তে যেটা ঘটেছে তাহচ্ছে জাতি-নির্বিশেষে সুযোগভিত্তিক অভিবাসন৬, ৭, ৮। দক্ষিণ ভারতীয়দের অনার্যতা বা বাঙালির অতি-সাঙ্কর্য্য যেটা প্রমাণ করে তাহচ্ছে– একাংশের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণবাদিতা, আর অপর অংশের উদারতা। বাস্তুচ্যুত-দখলদার অধ্যুষিত উত্তর-ভারত ঐতিহাসিকভাবেই এই দুই মানসিকতার কোনোটিকেই ধারণ করতে সমর্থ নয়। অবশ্য দক্ষিণ ভারতীয় সংরক্ষণবাদিতাকে তারা যদিও কিছুটা হলেও বোঝে– বাঙালির উদারতা তারা কিচ্ছুটিও বোঝে না। বোঝে না বলেই এক অজানা আতংকে ভোগে বাঙালিকে নিয়ে। এই 'অদ্ভুত' মানসিকতা তারা মেনে নিতে পারে না। কিন্তু দখলদার হিসেবে তারা যেটা করতে পারে তাহচ্ছে নিজ মানসিকতাকে নিজেদের ভৌগলিক সীমানার বাইরে বিস্তৃত করা।

এই মানসিক দখলদারিত্বেরই একটি অংশ হচ্ছে ধর্মীয় শুদ্ধতার বড়ি! উত্তর-ভারতীয় মুসলমান যেমন মনে করে বাঙালি মুসলমান সহীহ মুসলমান নয়; উত্তর-ভারতীয় হিন্দুও মনে করে বাঙালি হিন্দু ঠিক বিশুদ্ধ হিন্দু নয়। এর প্রমাণ ৭১ পূর্ববর্তী পাকিস্তানভুক্ত বাঙলা, এবং বর্তমানের ভারতভুক্ত বাঙলা। তাই বাঙালিকে নিজেদের মতো 'ধার্মিক' (আদতে ধর্মাশ্রয়ী দখলদার) করে তোলার ট্রেনিং দিতে এরা সতত এক পায়ে খাড়া! এই আধুনিক সময়েও তাই এরা নিজেদের অজুত দালাল আর নিযুত পুঁজিকে লড়িয়ে দিচ্ছে বাঙালিকে নিজেদের আর্যত্বের ছাঁচে ফেলতে। উত্তর-ভারতের মতো করে ভাবতে, উত্তর-ভারতের মতো করে মারতে এবং মরতে!

তাই, উত্তর-ভারতীয় উষ্কানিতে ধর্মের ধ্বজা তুলে যতবার বাঙালির ভুখণ্ডে রক্তপাত হয়, তা সে কলকাতায় হোক বা নোয়াখালিতে হোক, ততবার একটু একটু করে জিতে যায় উত্তর-ভারত১০, ১১। ততবার একটু একটু করে জিতে যায় পাকিস্তান। ততবার একটু একটু করে জিতে যায় হিন্দুস্তান। বাঙালি কি তার শিকড়ের ডাকে সাড়া দেবে, নাকি দখলদারের পদলেহন করবে সে সিদ্ধান্ত আধুনিক বাঙালিরই। বাঙালিকে কিন্তু জিততে হবে। বাঙালি হিসেবেই জিততে হবে! বাঙালি যেভাবে জেতে, তেমন ভাবেই জিততে হবে!

জয় বাংলা!

তথ্যসূত্র ও টিকা সমূহ:

১৯৮৯ সালে ভারতের মহিসূরে হরিদাস ভাট ষষ্টিপূর্তি স্মরণে আয়োজিত নিয়মিত লেকচার সিরিজে ব্রতিন্দ্রনাথ মূখার্জি কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণ অনুসারে।

হেনরি ইয়ুল এবং আর্থার কোক সম্পাদিত, ১৮৮৬ তে প্রকাশিত Hobson-Jobson: The Anglo-Indian Dictionary অনুসারে- "Hindostan, …… north of the Nerbudda, and exclusive of Bengal and Behar. The latter provinces are regarded as pūrb (see Poorub), and all south of the Nerbudda as Dakhan (see Deccan)."

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থমাস বারো'র The Sanskrit Language বইটিতে আদি-পারসিকের সাথে আর্যিক বৈদিক ভাষার মিল নিয়ে তিনি বলেন– "অবেস্তা (আদি-ফার্সি) ভাষায় এমন পংক্তি খুঁজে পাওয়া খুবই সম্ভব, নিয়মানুগ ধ্বনিগত পরিবর্তন করলে যা ম্পূর্ণ বোধগম্য বৈদিক ভাষায় রূপান্তরিত হবে!" পরে সান হোসে স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক থায়ার ওয়াটকিনস মত দেন- বৈদিক ভাষার সাথে অবেস্তা ভাষার মূল পার্থক্যটা হচ্ছে– বৈদিক ভাষায় যে সব শব্দাবলি নানান ঐশ্বরিক সত্ত্বা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই শব্দগুলো অবেস্তা ভাষায় অশুভসত্ত্বা বুঝাতে ব্যবহৃত হতো। এ থেকে তিনি ধারণা করেন যে– বৈদিক আর্য'রা মূলত অবেস্তাভাষী আদি-পারসিকদের দ্বারা বিতাড়িত ও শত্রুভাবাপন্ন সমজাতি।

হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের বংশগতিবিদ্যার (জেনেটিক্স) অধ্যাপক ডেভিড রাইখের তত্ত্বাবধানে ২০০৭ সালের Reconstructing Indian Population History শীর্ষক গবেষণায় দেখানো হয় আধুনিক দক্ষিণ ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে মধ্য-এশিয় বংশোদ্ভুত "উত্তর-ভারতীয় আদিপুরুষ/Ancestral North Indian (ANI)" দের মিশ্রণ সর্বনিম্ন ৩৯% এবং আধুনিক উত্তর-ভারতীয়দের মধ্যে মধ্য-এশিয় ANI মিশ্রণ সর্বোচ্চ ৭১%। এবং পরে ২০১৩ সালে অধ্যাপক রাইখের তত্ত্বাবধানেই Genetic evidence for recent population mixture in India শীর্ষক আরেক গবেষণায় এটাও দেখানো হয় যে, মধ্য-এশিয় জিনের এই মিশ্রণের একশতভাগই ঘটেছে ব্রোঞ্জ যুগের আগে পরে। যা কিনা, মোটাদাগে আর্য অনুপ্রবেশের সময়কাল হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে আলোচিত। এ থেকে পরিষ্কার যে আর্য অনুপ্রবেশ একটি বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা এবং দক্ষিণভারতীয় রক্তেও কম হলেও সে প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, এই দুটো গবেষণাতেই পূর্ব-ভারত তথা বঙ্গীয় ব-দ্বীপ বা আধুনিক বাঙলা থেকে কোনো গবেষণা নমুনা গ্রহণ করা হয়নি।

নৃবিজ্ঞানী ড. অতুল সুর ওনার 'চৌদ্দ শতকের বাঙালি' গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে আর্যসভ্যতা মূলত সিন্ধুসভ্যতা হতে ভিন্ন। সেই ভিন্নতা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি জানাচ্ছেন– "দুই সভ্যতার মূলগত পার্থক্যগুলি আমি নীচে দিচ্ছি — (১) সিন্ধু সভ্যতার বাহকরা শিশ্ন-উপাসক ছিল মাতৃকাদেবীর আরাধনা করত। আর্যরা শিশ্ন-উপাসক ছিল না ও শিশ্ন-উপাসকদের ঘৃণা ও নিন্দা করত। আর্যরা পুরুষ দেবতার উপাসক ছিল। মাতৃকাদেবীর প্রজার কোন আভাসই আমরা ঋগ্বেদে পাই না। (২) আর্যরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল। ঘোড়াই ছিল তাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জন্তু। এখানে বলা দরকার যে ঘোড়ার কোন অশ্মীভূত (fossilized ) অস্থি আমরা সিন্ধুসভ্যতার কোন কেন্দ্রে পাইনি। সিন্ধুসভ্যতার বাহকদের কাছে বলীবর্দই প্রধান জন্তু ছিল। এটা শীলমোহরসমূহের ওপর পুনঃ পুনঃ বলীবর্দের প্রতিকৃতি খোদন থেকে বুঝতে পারা যায়। পশুপতি শিব আরাধনার প্রমাণও মহেঞ্জোদারো থেকে পাওয়া গিয়েছে। বলীবর্দ শিবেরই বাহন। সুতরাং সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমুহে বলীবর্দের প্রাধান্য সহজেই অনুমেয়। (৩) সিন্ধুসভ্যতার বাহকরা নগরবাসী ছিল। আর্যরা নগর নির্মাণ করত না । তারা নগর ধবংস করত। সেজন্য তারা তাদের দেবতা ইন্দ্রের নাম পুরন্দর রেখেছিল। (৪) আর্যরা মৃত ব্যক্তিকে দাহ করত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকরা মৃতকে সমাধিসহ করত।" উল্লেখ্য যে, প্রথাগত উত্তর-ভারতীয় হিন্দুত্বের পরিচয়ে পুরুষ দেবতার প্রাধান্য, দেবরাজ হিসেবে ইন্দ্রের অধিষ্ঠান, মৃতসৎকারে দাহ করবার প্রচলন এর সবই প্রমাণ করে যে আর্যগণই উত্তর-ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মূলত প্রাধান্য বিস্তার করে।

জেনেটিক জরিপের মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে টাটা মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউটের ড. ভি বালাকৃষ্ণান তার "A Preliminary Study of Genetic Distances among Some Populations of the Indian Sub-continent" প্রবন্ধে দেখাতে সক্ষম হন যে বাঙলা সংলগ্ন ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী মূলত আদি-আস্ট্রেলিয় ও মঙ্গোলয়েড মিশ্রণে গঠিত এবং জেনেটিক বৈচিত্রের দিক থেকে সবথেকে বৈচিত্রময় এবং সেখানে আর্য/ইউরোপয়েড প্রাধান্য নেই বললেই চলে। উপরন্তু তিনি এটাও দেখাতে সক্ষম হন যে, বাঙালি মুসলমানদের সাথেও ভারতের অপরাপর ৭ টি মুসলমান জনগোষ্ঠীর জেনেটিক বিশেষ মিল নেই। অর্থাৎ, হিন্দু-মুসলমান, পূর্ব-পশ্চিম নির্বিশেষেই বাঙালিরা উত্তর ভারতীয়দের মতো আর্য-সংলগ্ন নয়, আবার দক্ষিণ ভারতীয়দের থেকেও তারা রক্ত-সাংকর্যে অনেক বিচিত্র।

হাডার্সফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বংশগতিবিদ্যার অধ্যাপক ড. মার্টিন রিচার্ডস ও তার দল ২০১৭ সালে তাদের "A genetic chronology for the Indian Subcontinent points to heavily sex-biased dispersals" শীর্ষক গবেষণায় উত্তর-ভারতীয় দুটি জাতি পাঞ্জাবী ও গুজরাটি, দক্ষিণ ভারতীয় দুটি জাতি তেলুগু ও তামিল এবং বাঙালি–ভারতবর্ষের এই ৫ টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জিনগত মিশ্রণ পরীক্ষা করে দেখান যে উত্তর-ভারতীয়দের মধ্যে আর্য (ওনার ভাষায় পশ্চিম ইউরেশিয়ান) সংমিশ্রণ সর্বোচ্চ এবং দক্ষিণ-ভারতীয়দের মধ্যে মধ্যম এবং বাঙালিদের মধ্যে সর্বনিম্ন। তিনি এও দেখান যে, এই ৫ জাতির মধ্যে বাঙালিদের জিনগত বৈচিত্রই সর্বোচ্চ, অর্থাৎ, মঙ্গোলয়েড (ওনার ভাষায় পূর্ব-এশিয়), দক্ষিণ-এশিয় এবং আর্য, সকল মিশ্রণই বাঙালির মধ্যে বিদ্যমান।

নৃবিজ্ঞানী ড. অতুল সুর ওনার 'বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন' নামক গ্রন্থে বাঙালিদের সম্পর্কে বলছেন- "এরা (বাঙালিরা) পঞ্চনদের উপত্যাকায় আগত নর্ডিক নৃতাত্ত্বিক উপাদানে গঠিত ঋগ্বেদ রচয়ীতা আর্যভাষাভাষী জাতি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এরা ঋগ্বেদ রচয়িতা আর্যগণের পঞ্চনদের উপত্যাকায় আসবার অনেক পূর্বেই বাঙলাদেশে এসে বসবাস শুরু করেছিলো। এদের ধর্ম, জাতিবিন্যাস, সমাজ ও সংস্কৃতি পঞ্চনদের উপত্যাকায় বসবাসকারী আর্যগণের ধর্ম, জাতিবিন্যাস, সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিলো। এদের ধর্ম, জাতিবিন্যাস, সমাজ ও সংস্কৃতি পৃথক ছিলো বলেই পঞ্চনদের আর্যগণ এদের ঈর্ষা ও ঘৃণার চক্ষে দেখতো। বৈদিক সাহিত্যে এর প্রমাণের অভাব নাই। অথচ এদের ধর্ম, জাতিবিন্যাস, সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আর্যদের কৌতুহলও কম ছিলোনা। এটা আমরা বৌধায়ন ধর্মসূত্র থেকে জানতে পারি। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে বলা হয়েছে যে বাঙলাদেশ বৈদিক আর্য-সংস্কৃতির লীলাক্ষেত্র আর্যাবর্তের বাইরের দেশ। অথচ বাঙলাদেশের তীর্থস্থানগুলি এমনই মহিমান্বিত ছিলো যে বৈদিক আর্যসমাজগোষ্ঠীর উদার মনোভাবাপন্ন লোকেরা সেসব তীর্থে পুণ্য অর্জন করতে আসতেন।"

"অথচ বাঙলাদেশের তীর্থস্থানগুলি এমনই মহিমান্বিত ছিলো যে বৈদিক আর্যসমাজগোষ্ঠীর উদার মনোভাবাপন্ন লোকেরা সেসব তীর্থে পুণ্য অর্জন করতে আসতেন। কিন্তু এরূপ উদারমনোভাবাপন্ন লোকদের আর্যসমাজ ভালোচোখে দেখতেন না। সেজন্যই আমরা বৌধায়ন ধর্মসূত্রে এরূপ উদারমনোভাবাপন্ন বৈদিক আর্যিতীর্থযাত্রীর দল যারা বাঙলাদেশে আসতেন, তাঁদের জন্য প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থার বিধান দেখি।" বাংলা ও বাঙালির বিবর্তন, ড. অতুল সুর।

১০ কানাডার রিয়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ড. জনম মূখার্জি তার পিএইচডি গবেষণাপ্রসূত প্রকাশণা "Hungry Bengal" নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন– ১৯৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গা সংঘটিত হবার পেছনে সরাসরি ভূমিকা পালন করেছে ১৯৪৩ এ মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ যা ইতিহাসে 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' নামে পরিচিত। ৫০ লক্ষ বাঙালির প্রাণহারি এই দুর্ভিক্ষের প্রবল অসহায়ত্ব বাংলার জনসাধারণকে সামাজিক-মনস্তাত্বিক দিক থেকে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে ফেলেছিলো যেখানে নিজ অস্তিত্বের প্রয়োজনে মানুষের সর্বশেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ধর্মের বিভেদ। উল্লেখ্য যে, এই গ্রন্থেই গবেষক তথ্যপ্রমাণসহ এও দেখান যে, ব্রিটিশ সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষ সংঘটনে ব্রিটিশদেরকে সরাসরি সহায়তা করে হিন্দুস্তানি মারোয়ারি এবং পাকিস্তানী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ইস্পাহানরা, এবং বিপুল আর্থিক লাভ হস্তগত করে।

১১ গবেষক রণবীর সমাদ্দার তার টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক গবেষণা প্রকাশণা Policing in a riot-torn city: Kolkata, 16-18 August 1946 এ উল্লেখ করেন যে– ১৯৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গায় উত্তর-ভারতীয় হিন্দু ও পাঞ্জাবীরা সুনির্দিষ্টভাবে কলকাতার শালিমার মেরিন ওয়ার্কশপ ও ফেরিঘাটে কর্মরত পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান নৌশ্রমিক ও খালাসিদের হত্যা করে। যাদের প্রায় সকলেরই মূলনিবাস ছিলো নোয়াখালিতে। পরবর্তীতে কলকাতা দাঙ্গার ফলশ্রুতিতে নোয়াখালি হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হবার পেছনে এই কারণটি সরাসরি ভূমিকা রাখে। এবং সরাসরি উত্তর ভারতীয় উষ্কানীতে ঘটা এই দুই ধর্মীয় সহিংসতার ফলস্বরূপ ১৯৪৭ এ ভেঙে যায় বাঙলা। যার একাংশে গড়ে ওঠে পাকিস্তানী উপনিবেশ আর অপর অংশের ডি-ফ্যাক্টো মালিক হয়ে বসে হিন্দুস্তান।