আবর্জনার স্তুপ এবং সর্বাধিক বিক্রিত লেখকরা

আনিসুর রহমান
Published : 27 Feb 2020, 04:15 PM
Updated : 27 Feb 2020, 04:15 PM

রবীন্দ্র উত্তর বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয়তা বা সর্বাধিক বিক্রির নিরীখে হুমায়ূন আহমেদ অগ্রগণ্য। হুমায়ূন চলে গেছেন অর্ধযুগ হয়ে গেল। এরপরের জনপ্রিয় ধারা বা সাহিত্য বা অসাহিত্যের হাল-হকিকতটা কেমন তা কী আমরা খতিয়ে দেখেছি?

তার আগে একজন হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে কিভাবে আবির্র্ভূত হলেন তা একটু আলোকপাত করতে চাই। হুমায়ূনের প্রথম সাড়া জাগানো 'নন্দিত নরকে' গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন আহমদ শরীফ। সেটা আমরা অনেকেই জানি। হুমায়ূনের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে আরো একজন লেখকের কথা আমরা অনেকে নাও জানতে পারি। তিনি হলেন আহমদ ছফা। তিনি হুমায়ূনের পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। তারপর তো সব ঘটনা দিনের মত উজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী দাপটগিরি করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি লেখক হিসেবে যেমন সৎ ছিলেন। তেমনি ছিলেন একজন প্রস্তুতি সম্পন্ন সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথের গল্পের বা কথাসাহিত্যের যে রস বা ধারাবাহিকতা তা তিনি রপ্ত করেছিলেন। তার গল্পগুলো বিশেষ করে ছোটগল্পগুলো বিশ্বসাহিত্যের নিরিখেই আন্তর্জাতিক মানের। তারপরও তার লেখালেখির বড় একটা অংশ ছিল বৈঠকখানার আলাপচারিতা। তিনি জনপ্রিয় বা সর্বাধিক বিক্রিত লেখক হয়েছিলেন নানা কারণে। জনপ্রিয় হবার মত যথেষ্ট সম্ভাবনা তিনি ধারণ করতেন। লেখক ও শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দারুণ সৎ ও মেধাবী। কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকদের বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত কিশোর তরুণ ও মধ্য পরিণত প্রজন্মের দৈনন্দিন জীবন ও যাপনের সুখ দুঃখ হাসি কান্না টানাপোড়েন ও উচ্ছাস ধরেছিলেন নিখাদভাবে। তারপর বাংলাদেশের একমাত্র দূরদর্শনে একাকী দাপট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নাটক লিখে।
একই সঙ্গে সাহিত্য সম্পাদকের প্রাপ্য মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। নিজে থেকে জনপ্রিয় হবার জন্যে বাড়তি কোন উদ্যোগ বা বিনিয়োগ আয়োজন তিনি করেননি। হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গ এইটুকুই। এবার হুমায়ূন উত্তর জনপ্রিয় বা সর্বাধিক বিক্রিত লেখকদের জগতটা একটু দেখে নেয়া যাক।

ডিজিটাল বা অন্তর্জাল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দাপটগিরির সময়ে বইয়ের দোকান বা মেলায় পসরা সাজিয়ে বই বিক্রির চেয়ে অনলাইনে বই বিক্রির ব্যারোমিটারটা এই সময়ে অগ্রগামী। তারমধ্যে একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করেছে রকমারিডটকম নামে অনলাইনে বই বিক্রির একটি ওয়েবসাইট। এখানে চল্লিশজন সর্বাধিক বিক্রিত লেখকের তালিকায় অন্যদের মাঝে উল্লেখ করার মত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন আছেন তেমনি ষষ্ঠ অবস্থানে আছেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। আনিসুল হকের অবস্থান অষ্টাদশ। আর বাকিদের অধিকাংশই মূলধারার লেখালেখিতে অপরিচিত। মূলধারায় অপরিচিত থেকেও সাহিত্য সম্পাদকের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঘা বাঘা প্রকাশকদের টেক্কা দিয়ে রাশভারী পণ্ডিত, অপণ্ডিত লেখকদের বাজিমাত করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে এলেন কারা? এদের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনের রহস্য বা কৌশলটা কী?

এদের বড় একটা অংশ অনলাইনকর্মী, ফেসবুক তারকা, ব্লগার, ইউটিউব মহারথী। এদের রয়েছে নিজস্ব ভক্ত ও সমর্থকগোষ্ঠী। এরা প্রতিনিয়ত নিজ নিজ ফেসবুক, ব্লগ এবং ইউটিউবে নিজস্ব সমর্থক ও ভক্তগোষ্ঠী তৈরি করেছেন। এদের দুই একজনের গোপন রাজনৈতিক যোগাযোগ বলয় বা যোগসূত্রও এই সমর্থক গোষ্ঠী তৈরিতে কাজে এসেছে। এই হল মোটাদাগের একটা চিত্র।

অসমর্থিত সূত্রে আরো কিছু গল্প চলমান রয়েছে। গল্পগুলো এরকম: জনপ্রিয়দের কেউ কেউ জনপ্রিয় হবার প্রাক্কালে নীলক্ষেত বা আশেপাশের এলাকা থেকে রাজনৈতিক দলের মত ট্রাকে ট্রাকে লোকভাড়া করার ঢঙে ভক্তগোষ্ঠী বা ক্রেতাগোষ্ঠী বইমেলায় জমায়েত করিয়ে নিজের বই কিনিয়েছেন। আবার কেউ কেউ প্রথম দুই এক দিনেই বইয়ের দ্বিতীয় বা তৃতীয় মুদ্রণ লেখা সম্বলিত বই মেলায় হাজির করেছেন। আদতে তা প্রথম মুদ্রণই। এভাবে এক একজন নানা চমক দেখিয়ে তাদের ভক্ত আর অভক্তদের চমকে দিয়েছেন।

আমরা অনেকেই জানি আইরিশ লেখক বার্নাড শ সম্পর্কে একটা গল্প চালু আছে। তিনি বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে নিজের বইয়ের তালাশ করতেন। আমাদের জনপ্রিয়রা বানার্ড শকেও তুড়ি মেরে দিলেন।

এবার থমাস স্টার্নস এলিয়ট বা টি এস এলিয়টের একটি উক্তি স্মরণ করব: একটি দেশের ধ্রুপদী সাহিত্য কেমন হবে তা নির্ভর করে ওই দেশের সমাজব্যবস্থা কেমন তার উপর। আমি এলিয়টের উক্তি ঘুরিয়ে বলতে চাই, একটি দেশের জনপ্রিয় সাহিত্য বা অসাহিত্য কেমন হবে তা নির্ভর করে সমাজের উপর।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাইরে এবং মূলধারার লেখালেখির দুইজন জনপ্রিয় লেখক সম্পর্কে একটা প্রশ্ন তুলতে চাই। তারা হলেন- মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং আনিসুল হক, যারা রকমারির শীর্ষ চল্লিশেও আছেন। তাদের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট কতটা ন্যায়ানুগ?

জাফর ইকবাল নিজস্ব সামাজিক অবস্থান, জাতীয় অগ্রাধিকারমুলক পৃষ্ঠপোষকীয় বাস্তবতা এবং আনিসুল হকের পেছনে প্রথম আলোকেন্দ্রিক গণমাধ্যমের মুঘলীয় আচরণ কি প্রভাব ফেলেনি? এই বাস্তবতায় রফিক আজাদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন এই প্রজন্মের দুভার্গ্য তারা ভাল কোন সাহিত্য সম্পাদক পেল না। শুধু সাহিত্য সম্পাদক নয়, সামাজিক রমরমা আর গণমাধ্যম ফাঁপা সময়ে আমরা কি সেই পর্যায়ের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সান্নিধ্য পেলাম? তাই যদি হত তাহলে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে সাহিত্যের নামে সৃজনশীল লেখালেখির নামে আবর্জনার স্তূপের সর্বাধিক বিক্রিত লেখার খতিয়ান দেখতে হত না। দুই একটা ব্যাতিক্রম ছাড়া, এসব লেখালেখি আদতে সাহিত্যের আবর্জনা ছাড়া কিছুই না। এদের অনেকগুলো সাহিত্যের কোন বিভাজনে ফেলাও কঠিন। আর এই আবর্জনাগুলো কেন আমাদের সাহিত্যের উপর খবরদারির উঁকি দিল? এসব বইয়ের নাম, বিষয় ও ভেতরের দুই এক পাতা পড়লেই সহজেই প্রতীয়মান হয়।
কথা হল, আমাদের সাহিত্যের পাতাগুলো দুর্বৃত্তায়নের দখলে গেলে, সাহিত্যের পুরস্কারগুলো বিতর্কিত হয়ে পড়লে, পাঠ্যপুস্তকের লেখা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমিসহ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃত প্রতিভার চিহ্নিত করার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমলা লেখক নির্ভর হয়ে পড়লে, সাহিত্যের নামে আবর্জনার স্তূপ যে জনপ্রিয়তার শীর্ষ উঠে আসবে, তা অবাক হবার ছিল না।

তবে অবাক অন্য ক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক বছরে আমাদের প্রতিষ্ঠিত কোন কবি বা লেখক কি কোন নতুন বা পুরাতন লেখকের উল্লেখ করার মত কোন বই নিয়ে কোন আলোচনা করেছেন বেতার, দূরদর্শন বা খবরের কাগজে? আমি নাম ধরেই বলি- নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সেলিনা হোসেন, আনিসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, শাহীন আখতার ও নাসরীন জাহান। একটা উদাহরণ দেব, রফিক আজাদের প্রথম কবিতার বই নিয়ে আলোচনা ছেপেছিলেন শওকত ওসমান। আমরা সেই ঐতিহ্য কোথায় হারালাম?

আমাদের এখন মন্ত্রী-আমলার বই নিয়ে লেখার লেখকের অভাব নাই। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্পোরেট কবির উপন্যাস ও কবিতা নিয়ে লেখার মানুষের অভাব নাই। এরকম ঠিকাদারি ফরমায়েশি লেখালেখির চর্চায় পাঠক সাহিত্যের পাতাগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মানুষ ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, ফেসবুক-ইউটিউবে ঝুঁকেছে। তার ফল স্বরূপ আবর্জনাকেও বিক্রির শীর্ষে দেখতে হচ্ছে। এসব নিয়ে খোলামেলা কার্যকর বিতর্কের জায়গা কোথায়? সুযোগ কোথায়?

টেনেটুনে পাঠককে ধোঁকা দেয়া বা ফাঁকি দেবার উপায় বেশিদিন দীর্ঘ হয় না। আমরা নিশ্চয় ভুলে যাইনি গণমাধ্যমের মুঘল এক সম্পাদকের মেয়ের লেখা প্রথম উপন্যাস নিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক পণ্ডিতদের থেকে শুরু করে সাহিত্যের পাতাগুলো কি সব উপর্যুপরি তোড়জোড়। তাকে রাতারাতি জনপ্রিয় করার জন্যে একেবারে জাতীয় উদ্যোগ। এসব ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখতে হল আমাদের। সাহিত্যের রমরমা? রকমারি বেশ! বেশ তো?

এবার প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ফেসবুক কেন্দ্রিক বা ইউটিউব ভিত্তিক জনপ্রিয় লেখক যেমন আমাদের রয়েছে- তেমনি এসব মাধ্যমে একদল জনপ্রিয় মোল্লাও রয়েছেন। ওয়াজ নসিহতের নামে এদের অনেকে কার্যত ভাঁড়ামো বা স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানের কাজ করে যাচ্ছেন।

গ্রাম বাংলার যাত্রা সংস্কৃতির বিলুপ্তির জায়গাটা এরা পাকাপোক্তভাবেই দখল করেছেন। যেমনটা আমাদের অনলাইনে বিক্রিত তালিকার শীর্ষ লেখকরা করেছেন বইয়ের জগতে। এরকম মোল্লাদের কর্মকাণ্ড নজরদারিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কি কিছুই করার নাই? এখন সময় এসেছে এই ফাউন্ডেশনের একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিজিটাল বিভাগ থাকার।

আহা! সর্বাধিক বিক্রির তালিকায় সাহিত্যের নামে আবর্জনার দীর্ঘ স্তূপ! এবার একটু হালকা করে বলি- লেখককে মনে করা হয় ভাষার অভিভাবক। বিক্রির শীর্ষে এসব আবর্জনার পাতা উল্টালে ইংরেজি বাংলার মিশেলে ভাষার কি যে ছিরি! কী বলব? লেখালেখি হচ্ছে সত্যকে উন্মোচন করা। ভাঁড়ামো করে কিছু মানুষকে সাময়িক টানা যায় বা বিভ্রান্ত করা যায়। আদতে তা সাহিত্য হয় না।

লেখক হবার অর্থ কী? লেখক হওয়া মানে পরিপক্ক মানুষ হওয়া। এরকম ভাগ্য একটি দেশের কম মানুষের জীবনেই ঘটে। যে কারণে জীবনানন্দ বলে গেছেন- এক দশকে এক আধজন কবির আবির্ভাব হয়।

আর আমরা রাতারাতি সর্বাধিক বিক্রিত চল্লিশ জন লেখক পেয়ে গেলাম। অনলাইনে বিক্রির শীর্ষ তালিকায় থাকা দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ লেখকদের সাহিত্যের নামে আবর্জনা নিয়ে আলাদাভাবে মন্তব্য করার সুযোগ এখানে নাই। আমি সচেতনভাবে এই বিষয়ে খোলামেলা বিতর্ক উসকে দেবার জন্যে আলোচনার সূত্রপাত করলাম।
পাঠক হিসেবে আমি যথেষ্ট বিরক্ত। তবে হতাশা আমি নই। রাতের শেষে দিন যেমন আসে, আমাদের সমসাময়িক সাহিত্যও এই জুয়াড়ি থাবা থেকে বের হয়ে আসবে।

একটা গল্প বলে লেখাটার ইতি টানতে চাই। আমার শৈশবকালে আমাদের বাড়িতে প্রতি শনিবারে অন্ধ এক মিসকিন আসতেন। প্রায় প্রতি শনিবারেই আমার মা কূলার মধ্যে কিছুু চাল, শুকনো মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে বাহির বাড়িতে পাঠাতেন মিসকিনকে দেবার জেন্যে। এর আগে মিসকিনকে এক পেট খাবারও দিতেন। মিসকিন মুরুব্বি কূলার চাল মরিচ আর পেঁয়াজ নিয়ে দুহাত তুলে দোয়ার শেষে একটা শ্লোক বলতেন। তা আজও আমার কানে বাজে-

আলীর হাতে ঝাড়ফুকার
ফাতেমার হাতে তীর
যেই পথে আইছস বালা
সেই পথে ফির।

আমাদের জনপ্রিয়দের নিয়ে আমার আর কিছু বলার নাই। সকলের সুমতি হোক।