একুশের ব্যানার: কি চমৎকার দেখা গেল!

Published : 25 Feb 2020, 11:11 AM
Updated : 25 Feb 2020, 11:11 AM

আমাদের শৈশবে বায়োস্কোপ নামে একটা মজার ব্যাপার ছিল। চারকোণা একটা বাক্সে দুইটা বা তিনটা গোল জানালার মতো। তাতে চোখ রেখে দেখতে হতো রং-বেরং এর ছবি। কখনো কোন নায়িকার ছবি, কখনো কোন পশুপাখি বা প্রাকৃতিক দৃশ্য। বায়োস্কোপওয়ালা হাতে ঝুনঝুনির মতো একটা বাজনা বাজিয়ে সুর করে বলে যেতেন একের পর এক ছবির বর্ণনা। ভালো করে দেখার আগেই প্রতি মুহূর্তেই বদলে যেত ছবিগুলো।  কোনওটা বর্ণনার সাথে মিলতো, কোনটা মিলতো না। তাতে অবশ্য কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না। বায়োস্কোপওয়ালা বলার আনন্দে বলে যেতেন, আর দেখনেওয়ালা আমরাও মহা আনন্দে দেখে যেতাম। দেখা এবং দেখানোর আনন্দই ছিলো বায়োস্কোপের মূল লক্ষ্য।

বায়োস্কোপের চল উঠে গেছে অনেকদিন। কিন্তু তাতে কী? মহাসমারোহে আমাদের বায়োস্কোপ দেখার অনুভূতি ফিরিয়ে দিয়েছে ভাষা দিবসের নানা গুণিজনের ব্যানার! ঠিক সেই বায়োস্কপের মতোই, ছবির সাথে বর্ণনার মিল নাই। মিল নাই দিবসের সাথেও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে দেখা গেল- "চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনু ভাইয়ের পক্ষ থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ত্রিশলক্ষ শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলী!

২১নং ওয়ার্ড, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ এর ব্যানার ছিল- হে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি হাজারো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে শহীদ দিবস আমি কি তোমায় ভুলিতে পারি।

সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী সাহেব তো ভাষা আন্দোলনের সালই বদলে দিয়েছেন। উনার ব্যানারে লিখেছেন, ১৯৫১ এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ব্যানারে ছেপেছে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ছবি। পিছিয়ে থাকে নাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও। তারাও সাত বীরশ্রেষ্ঠকেই বেছে নিয়েছে ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে।

নিজের ইতিহাসকে সঠিকভাবে না জানার এবং ধারণ না করার নির্লজ্জ আর প্রকট প্রকাশ এই ব্যানারগুলো! এবং এক ভয়ংকর বাস্তবতার প্রতিফলন। যেই বাস্তবতায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ- এসব কেবলই পোশাকী শব্দমাত্র, কেবল দায়সারাভাবে বক্সে টিক দেয়ার বিষয়। শব্দগুলো চেতনায় ধারণ করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। সবই কেমন লোক দেখানো, ঠিক ছোটবেলার সেই শিশুভোলানো বায়োস্কোপটার মতো।

এসব ব্যানার দেখে আমার বেশ কয়েক বছর আগের এক টিভি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। কোন এক টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক পথে পথে সাধারণ মানুষদের গিয়ে জানতে চাইছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস কবে? বিজয় দিবস কবে? অপারেশন সার্চ লাইট কী? কাল রাত কোনদিন?

এ প্রশ্নগুলোর অপ্রত্যাশিতভাবে (নাকি প্রত্যাশিতই হবে আসলে) অধিকাংশ উত্তরদাতাই হয় ভুল উত্তর দিচ্ছিলেন অথবা মোটেও উত্তর দিতে পারেন নাই। তখন বিএনপি আমল ছিল। ভুল ইতিহাস শেখানোর, ইতিহাস মুছে ফেলার, ভুলিয়ে দেয়ার তাদের সক্রিয় রাজনৈতিক চেষ্টাকে দায়ী করেছিলাম অনেকে।

তারপর জল গড়িয়েছে অনেকদূর। আমরা ২০১৩ এর গণজাগরণ পেয়েছি৷ পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে আনার জোরালো উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার পেয়েছি টানা প্রায় একযুগ ধরে। এখনও তারাই ক্ষমতায় আছে। ফলস্বরূপ, সবাই রাতারাতি ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ বনে গেছে৷ এই সেদিনও যেই ছেলেটা নারায়ে তাকবীর শ্লোগান দিতো, অথবা ধানের শীষ নিয়ে মিছিল করতো, তারা সবাই কোন না কোন উপায়ে লীগের ছায়াতলে জুটে গেছে। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই লেজেগোবরে পাকিয়ে গেছে সব।

মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ শহীদ, মা-বোনের ইজ্জত -এই ধরনের কিছু বুলি মুখস্থ করে নিয়েছে। এ শব্দগুলোর অর্থও বোঝে নাই, বোঝার দরকারও পড়ে নাই। জায়গামতো এ শব্দগুলো বলতে পারলেই যদি সব স্বার্থ হাসিল হয়, তবে আর কষ্ট করে বুঝতেই বা যাবে কেন? তারই এক খণ্ডিত প্রকাশ আমরা এবার দেখলাম ভাষা দিবস পালনে।