দুয়েক বছর আগে পরিবারসমেত বইমেলায় গিয়ে বাধলো বিপত্তি। জলবিয়োগের তাগিদ দেখা দিলে খোঁজ নিতে আগে গেলাম বাংলা একাডেমি চত্বরে নতুন ভবনে। সেখানে শৌচাগার ব্যবহারে সাড়া না পেয়ে জলের গানের তাল-লয় কেটে যাবার আগেই পৌঁছালাম ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভবনে।
ভবনটি নির্মাণ ও উদ্বোধনের সময় শুনেছিলাম এটি নাকি অত্যাধুনিক; তো এই অতিরিক্ত আধুনিক বা আলট্রামর্ডান ভবনে জাগতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক ক্রিয়াটি সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে করা যাবে ভেবে দোতলার ওঠার সিঁড়ি ভাঙা শুরু হলো।
বইমেলা মানে হলো 'আমরা মাখবো পায়ে রাঙাধুলি' গাইতে গাইতে ঘুরতে হবে । এরই আফটার শক হচ্ছে ভবনের সিঁড়ি 'ধূলায় যাই ভাই গড়াগড়ি' দশা।
তো ধাপে ধাপে উঠতে উঠতে নাকে ঠেকলো কিসের যেন গন্ধ। ভবনের ভেতরে সিঁড়ির পাশে বই কেনাবেচার কেন্দ্র আছে। সেখানে অনেক পুরনো বইও পাওয়া যায়। পুরনো বইয়ের গন্ধে তীব্র মাদকতা আছে। বইয়ের সুবাস বুঝি বসন্ত বাতাসে ভেসে সিঁড়িতেও এসে ঠেকেছে ভেবে নাক টানতেই দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম; অ্যামোনিয়া।
সিঁড়ি শেষ হতেই মেঝে শুরু। টাইলস বসানো মেঝের একদিকে বসার ব্যবস্থাসহ বড় ক্যান্টিন। আর একদিকে শৌচাগার। এই তলার মেঝে জল গ্রহণ ও বিয়োগের ব্যতিব্যস্ততার চিহ্ন হিসেবে পদধূলিকে কাদা কাদা করে রেখেছে।
তবু শৌচাগার পানে পায়ে পায়ে হেঁটে তারপর পশ্চাৎপদ হতে হলো পরিবারকে। ওখানে অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝে টেকা যাচ্ছে না। উপরন্তু অত্র অঞ্চল বর্ষণে এতই প্লাবিত যে ওদিকে নৌকা চালানো রীতিমত ঝঞ্ঝা। তাই কাণ্ডারিকে ব্যর্থ মনোরথে নেমে এসে আবারো একটি শৌচাগারের জন্য খোঁজ-দি সার্চ অপারেশনে নামতে হয়।
কয়েকজন নারী পুলিশ দেখিয়ে দিলেন বইমেলায় বাংলা একাডেমির চত্বরে ঢোকার গলিতে টয়লেট আছে। এবার তাও কোনোমতে কাজ সেরে হাঁফ ছাড়া।
ব্লাডারের চাপ কমতে পাকস্থলি টন টন করে উঠলো খাওয়ার দাবি নিয়ে। আবার ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভবনের দোতলায় হানা; ক্যান্টিনে। কিন্তু বার্গার, স্যান্ডউইচের সামনে দাঁড়িয়ে গণ-পেশাবের গন্ধে পেট গুলিয়ে গেল। অ্যামোনিয়া ফ্লেভারের পুডিং খাওয়া হয়নি সেবার আর।
এই লম্বা ফিরিস্তি দেওয়ার কারণ হলো, বইমেলার আয়োজকরা এখন মেলায় আগতরা কী চায় না চায়- তা নিয়ে ভাবা শুরু করেছেন। শুধু তাই না, বইমেলায় শিল্প-সাহিত্যের সাথে জড়িতদের দাবি-দাওয়া পূরণে বাংলা একাডেমি ফাইভ-জি গতিতে সাড়া দিচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে বই নিষিদ্ধ বা প্রকাশকদের আইনশৃংখলা বাহিনী হেনস্তা করলেও বাংলা একাডেমি 'স্পিকটি নট' ছিল। তবে লেখক-প্রকাশনাকর্মীদের শরীরে নিকোটিন অনুভূতিকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিতে আগামী বইমেলায় স্মোকিং জোন করার ঘোষণা দিয়েছে স্বায়ত্বশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একটি প্রতিবেদনে পড়লাম 'মেলায় অনেকেই ধূমপান ছাড়া থাকতে পারেন না' এটা বাংলা একাডেমির নজরে এসেছে। কবি-সাহিত্যিক-প্রকাশকদের বইমেলায় এসে ঠিকমত ধূমপান করতে না পারার কষ্ট বাংলা একাডেমির চোখে জল এনে দিয়েছে। পেশাবের বেগ তাও সামলে রাখা যায়: কিন্তু নিকোটিন আবেগ কী করে সামলাবে তারা? তাই তো বইমেলা উপলক্ষে আগামী বসন্তে একের অধিক 'স্মোকিং জোন' গড়ে দিতে ইশতেহার ঘোষণা করেছে বইমেলা কর্তৃপক্ষ।
পুরো বইমেলাকে সাথে নিয়ে কর্তৃপক্ষকে এই দাবি মানতে বাধ্য করেছেন জনৈক প্রচ্ছদশিল্পী। শোনা যায় তিনি রীতিমত রাজত্ব করছেন প্রচ্ছদ জগতে। যারা রাজত্ব করেন তাদের আচরণ রাজার মতই থাকে। রাজ্যচালনার পাশাপাশি রাজাদের হরেক শখও থাকে। এসব শখ সর্বোচ্চ আয়েশে মেটাতে চান রাজারা। শখের দাম লাখ টাকা। ওই প্রচ্ছদশিল্পী তার শখ মেটাতে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন।
'হেডম' শব্দটা কানে ইংরেজি-ইংরেজি ঠেকলেও এটা না কি নোয়াখালী ভাষার শব্দ। একটা প্রচলিত কথাও আছে, হেডম জাহাজের কচ্ছপ; যার অর্থ যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও দাপট দেখিয়ে বেড়ানো।
একুশে ফেব্রুয়ারির দিন পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টু- এমন খবর এসেছে কয়েকটা পত্রিকা ও অনলাইনে। অনেকের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, পুলিশ নাকি কলার চেপে ধরেছিলেন চারু পিন্টুর। পুলিশের এত্তবড় হেডম! ভাবা যায় এগ্লা!
ঘটনা ছোটখাটো ছিল না সেদিন। প্রকাশক-লেখক না জোট হয়ে পুলিশের প্রতিপক্ষ হয়েছিলেন। পরিস্থিতির লাগাম ছুটে যাওয়ার আগে শেষমেষ নাকি পুলিশের হয়ে বাংলা একাডেমিকে হাতজোড় করে মাফ চাইতে হয়েছিল। বইমেলায় লেখক-প্রকাশকদের হেডমও কিন্তু কম না!
কিন্তু 'কাটাপ্পা নে বাহুবলী কো কিউ মারা'?
অনেকে বলছেন, চারু পিন্টু বইমেলায় করাতকল প্রকাশনার স্টলের সামনে সিগারেট ধরাতে গেলে এই বিপত্তি ঘটে। সিগারেট খাওয়ার অনেকটা অন্ন-বস্ত্রের অধিকারের মত এমন ইনোসেন্ট এক সুরে চারু পিন্টু বলেছেন, এখানে অনেকেই সিগারেট খায়। তবে তিনি না খেলেও একজন তাকে সিগারেট দিয়েছিল যা তিনি হাতে নিতেই পুলিশ ঘাপলাটি করে।
আমাদের দেশে বিপ্লবী হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে, পুলিশের বিরুদ্ধে হেডম দেখানো। তাও আবার পুলিশের মাঠ পর্যায়ে যারা দায়িত্বে থাকেন, তাদের সাথে একটা হাতাহাতি না হলে গোটা প্রশাসনকে এক হাত দেখে নেওয়া যায় না। বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিবেদিত লেখক-প্রকাশকগোষ্ঠীর অল্পস্বল্প শিক্ষিত ও সাধারণ পরিবার থেকে উঠে পুলিশে যোগ দেওয়া কর্মীর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে ওঠার এই ঘটনাতেও সেই বিপ্লবী হেডম দেখানোর আভাস আছে।
করাতকল স্টলের সামনে যদি অনেকেই সিগারেট খেয়ে থাকেন তবে সেটা যে গর্হিত কাজ তার বিরুদ্ধেই বরং লেখক-প্রকাশকদের আরো আগে প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। না করাটা অন্যায়। সেই অন্যায়টি উপলব্ধি না করে লেখক-প্রকাশক ব্রাদার হুডের আস্কারা পেয়েই চারু পিন্টু সিগারেটের আগুন ছড়িয়ে দিলেন।
স্মোকিং জোন নিয়ে যখন বাংলা একাডেমি কর্তাব্যক্তিরা ও চারু পিন্টু ঐক্যমতে পৌঁছালেন, সেসময়ও কি তারা ধূমপান করছিলেন? চারু পিন্টু বই মেলায় গিয়েও সিগারেটের মুখে আগুন দিয়ে এর পেছনটায় সুখটান দিতে চান সেটা এখন জাতীয় খবর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পর স্মোকিং জোনের অধিকার আদায় করে নেওয়াই আজকে জাতির সবচেয়ে বড় বিজয়!
কিন্তু কোথায় হবে সেই স্মোকিং জোন? বইমেলার বাইরে। মানে উদ্যানে? তাহলে উদ্যানকে ধূমপানমুক্ত এলাকা ঘোষণা করার জো নেই। অথবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হবে আনুষ্ঠানিক স্মোকিং জোন? তারমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও আর ধূমপানমুক্ত এলাকা বলা যাবে না। তাহলে কি বাংলা একাডেমি কার্যালয়েই হবে স্মোকিং জোন?
২০১২ সালে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি জনস্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করতে সব রেস্তোরাঁকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করে। হাসপাতালকে ধূমপানমুক্ত রাখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, ২০১৪ সালে সে প্রশ্ন তুলেছিল হাই কোর্ট। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ ভবনকে ধূমপানমুক্ত এলাকা ঘোষণা করতে স্পিকারের হস্তক্ষেপ চান আওয়ামী লীগের সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী।
২০১৪ সালে সিলেটের নগর ভবন ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে সচিবালয়ের ভেতরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া ছাড়াও সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী দপ্তর সচিবালয়কে ধূমপানমুক্ত করার উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
২০১৮ সালে নৌপরিবহন এবং নৌবন্দরগুলো ধূমপানমুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহন (বিআইডব্লিউটি) কর্তৃপক্ষ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সদরদপ্তরসহ সব কার্যালয়কে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এর নগর ভবন ও আঞ্চলিক অফিসগুলোকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করে।
অলিম্পিক আয়োজনের আগে টোকিও শহরকে ধূমপানমুক্ত করতে চায় জাপান। অধূমপায়ীদের নাকি অতিরিক্ত ৬ দিন ছুটি দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিল একটি জাপানি প্রতিষ্ঠান। কলকাতা শহরটিও নিজেদের ধূমপানমুক্ত করার পথে হাঁটছে।
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে গোটা দেশকে ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন বাংলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় চারু পিন্টু ব্রাদার হুড তাতে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিল।
'বইমেলা ধূমপানমুক্ত' শিরোনাম হওয়ার বদলে একজন চারু পিন্টুর দাবির মুখে স্মোকিং জোন খবরের শিরোনাম হওয়া ধূমপান ও তামাকবিরোধী সকল প্রচেষ্টাকে হা-হা-হা ইমো দেওয়ার মত। এখন সবাই জানবে, ধূমপান করা একটি অধিকার এবং এই দাবি নিয়ে গেলে আস্ত স্মোকিং জোন পাওয়া যাবে।
২০১৭ সালে মাকবিরোধী সংগঠন প্রগতির জন্য জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স- আত্মার উদ্যোগে এক অনুষ্ঠানে 'পাবলিক প্লেসে' ধূমপান করলে জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছিলেন, কেউ বাধা দিচ্ছে না। এই বাধাটা দেওয়া প্রয়োজন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদনে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যটি ছিল এরকম- "আমি বিদেশে দেখেছি, যে জায়গাটা 'নো স্মোকিং জোন' সে জায়গায় কেউ সিগারেট ধরালে অন্য মানুষ যেভাবে তার দিকে তাকায়, সে আর সারা জীবনে সিগারেট খাবে না- এমন একটা পরিস্থিতি দাঁড়ায়।
"আমি অনুরোধ করব, ঠিক সেইভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। যেখানে ধূমপান করা নিষেধ, সেখানে কেউ ধূমপান করলে তাকে এমনভাবে ধীকৃত করতে হবে যেন, সে আর সেখানে চেষ্টা না করে।"
কিন্তু এটাতো বিদেশ না; এটা বাংলাদেশ। এখানে বইমেলার মত পাবলিক প্লেসে ধূমপায়ীদের হেডম চলে। এখানে বাংলা একাডেমি ধূমপায়ীদের কাছে মাফ চান। এখানে ধূমপায়ীকে বাধা দিয়ে পুলিশ হয় লাঞ্ছনাকারী।
প্রচ্ছদশিল্পীর হেডম দেখানো এই ধূমপান মুভমেন্ট আগামি বইমেলায় 'স্মোকিং স্প্রিং' ঘটিয়ে দেবে। বইমেলায়, উদ্যানে অথবা ক্যাম্পাসে পরিচ্ছন্ন টয়লেট নয়, মনোরম ফুলের বাগান নয়, ঘন সবুজ ঘাসের মাঠ নয়, আমরা বাংলা একাডেমি পরিবেশিত একটি নিকোটিন বসন্ত দেখার অপেক্ষায়।