পাপিয়ার কাণ্ড ও সমাজের ন্যায়-অন্যায়

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 24 Feb 2020, 01:24 PM
Updated : 24 Feb 2020, 01:24 PM

আওয়ামী যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউর (২৮) নামে-বেনামে ঢাকায় ও নরসিংদীতে বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। পাপিয়া ছিলেন অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘণিষ্ঠজন। এ ঘণিষ্ঠতার সূত্রে অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। পুলিশের এসআই পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে অনেকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থও হাতিয়ে নিয়েছেন পাপিয়া।

এছাড়া অস্ত্র ও মাদক কারবার, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে মাসোহারা আদায়ের মাধ্যমে অবৈধভাবে তিনি বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। গত রোববার বিকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

পাপিয়া এখন টক অব দ্য সিটি বা কান্ট্রি তো বটেই সারা বিশ্বের বাঙালি বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরে  আলোচনার ও বিষয়। পাপিয়া কে, পাপিয়া কী এবং পাপিয়া কেন? এই প্রশ্ন যতো সহজ উত্তর ততো কঠিন। দেশে গিয়ে আমি বদ্ধমূল ধারণা পেয়েছি আর যা কিছুর অভাব থাক নেশার মাদক, যৌনতার জন্য নারী বা সরঞ্জাম আর অর্থের কোনও অভাব নাই। এই উপচে পড়া জঞ্জালের ওপরতলার এক চরিত্র 'পাপিয়া'। যা তার চেহারা সূরত তাতে প্রয়াত লেখক বুদ্ধিজীবী ওয়াহিদুল হকের কাছে শোনা একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি অসাধারণ বিশ্লেষণ জানতেন। তার মতে বাঙালি ঘরে ঘরে নানা চিন্তা  আর্থিক অনটন টেনশনের কারণে ক্লান্ত স্ত্রী-র ছিপছিপে শরীরে একঘেঁয়েমি বোধ করে তখন তার পছন্দ মাংসল নারী। আজকাল নারীবাদীদের যুগ। তাঁরা কোন কথা যে কোথায় টেনে নিয়ে দাঁড় করায় বোঝা মুশকিল। কিন্তু এটা মূলত স্থূলতা প্রিয়তার একটা কারণ ছাড়া আর কিছু না।

পাপিয়া দেখতে তেমন এক রমণী। তাতে আপত্তির কিছু নাই। কিন্তু তার শরীরে যে পরিমাণ উল্কি আর মেদ- দুটিই প্রমাণ করে তার সুখের সীমা ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে পাপিয়া কিভাবে এত শক্তিধর হয়েছিল? কারা ছিল এর নেপথ্যে?

আমরা কিছুদিন থেকেই দেখছি এসব কর্মকাণ্ডের পেছনে অনিবার্য ভাবে যুবলীগের নাম যোগ হচ্ছে। যুবলীগ সংগঠনটা আসলে কতটা দরকারী? আমরা বিএনপি আমলেও দেখতাম যুবদল নামে সংগঠনের উৎপাত। বিএনপি বিপাকে পড়ার পর এর ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার নৃশংস রাতে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনিও  সস্ত্রীক নিহত হয়েছিলেন। সেদিনও আমরা যুবলীগের কোনও চিহ্ন দেখিনি। মাঠে নামেনি কেউ। এসব ইতিহাস সত্য হবার পরও যুগ যুগ ধরে যুবলীগ-যুবদল চলে আসছে।  এবার দেখছি মূল দল আওয়ামী লীগের নেতাদের নামে যত অপবাদ বা অপকীর্তি তার চৌদ্দগুণ বেশি যুবলীগ নিয়ে। মহিলা যুবলীগের অস্তিত্বই আমার কাছে কেমন কেমন লাগে! নামের মত কাজও খটকাপূর্ণ। এর পেছনে যারাই থাকুক এটি একটি শাখা সংগঠন ছাড়া আর কিছুই না। যেখানে এখন কর্মী সমর্থক বা নেতার চাইতে শাখামৃগের সংখ্যাই বেশি মনে হচ্ছে।

এর বদনাম আর একের পর এক ক্যাসিনো কাণ্ড ভিসি পর্বের পর এবার যৌন কেলেঙ্কারীর ঘটনা কি এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে না মূলত মাথার ওপর শক্ত নেতৃত্বের সরাসরি প্রভাব বা ছায়া না থাকাতেই এমন বেপরোয়া সবকিছু? খেয়াল করবেন- মূল দলের মাথার ওপর আছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। যাঁর চোখে পড়ে না এমন কিছুই নাই। হয়তো সে কারণে মূল দলে নিয়ম শৃংখলা ভাঙা কঠিন। কিন্তু যুবলীগে সহজ। তাই অনুমান করা যায় বহু এলিট, নন-এলিট আর ডাকসাঁইটে লোকজন সেখানেই তাদের মনের আশা চরিতার্থ করতেন। আমাদের রাজনীতি ও সমাজ বাস্তবতায় এদের ধরা যায় না। তাই অলৌকিক কিছু না ঘটলে পাপিয়ার আসল জবানবন্দি বা মনের কথা 'আমজনতা' জানতে পারবে না।

যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কিংবা আওয়ামী বিরোধিতার কারণে ঢালাওভাবে বড় বড় নেতাদের দিকে আঙুল তুলছেন তাদের মতলবও বুঝি। এখনকার সময়ে কারো সাথে ছবি থাকা কোনও ঘটনা না। তা ছাড়া ফটোশপ পারে না এহেন কোনও কাজ নাই। ফটো দিয়ে কোনকিছু প্রমাণ হয় না। তবে চাইলেই আসল দায়ীদের খূুঁজে বের করা সম্ভব। যা হবার না বলেই ধরে নিতে পারি।

আর যারা এই সুযোগে পাপিয়ার নাম করে নারী জাতির ওপর বিষ ঢালছেন, তাদের বলবো নিজের চেহারা আয়নায় দেখুন একবার। নিজের ফেইসবুক ইনবক্সটাও দেখুন। তারপর কথা বলুন। ঢালাওভাবে নারীকে গালাগাল করে 'পাপিয়াকে বেশ্যালীগে'র নেতা বলাও অপরাধ। ভাষা অসংযত করার ভেতর নিজের গ্লানি আর নিচুতা ছাড়া কিছু নাই।

মূলত এটি এখন আমাদের সামাজিক রোগ। রাজনৈতিক আবরণে ঢাকা অপরাধ জগতের এক বাস্তবচিত্র। এখানে কে খদ্দের আর কে যে দেয় তাও বোঝা মুশকিল। সব মিলেমিশে একাকার। ভয়টা এই এসব অপরাধের পেছনে আছে বড় বড় মানুষেরা। সমাজে এখন যে কোনও বয়সী গার্লফ্রেন্ড থাকা ইজ্জতের ব্যাপার। এই তালিকায় কে নাই? আমলা থেকে লেখক শিল্পী রাজনীতিবিদ সবাই আছেন। হঠাৎ খুলে যাওয়া মিডিয়া আর সামাজিক মিডিয়ার হাত ধরে ঢুকে পড়েছে নানা উপকরণ। আগে যা আড়ালে আবদালে হতো তার প্রকাশ্য এক রূপের নাম পাপিয়া। আমি কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনীকে অভিনন্দন জানাতে চাই। তারা যেভাবেই হোক রাজনীতি বড় মানুষের চাপ বা দম্ভ ও ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাপিয়াকে ধরেছে। আর সে কারণেই  আমরা জানতে পেরেছি।

ভয় হয় আগামী প্রজন্মকে নিয়ে। ভয় আমাদের সামাজিক দিকটায়। এভাবে যদি যৌনতা আর পাপ আমাদের মজ্জাগত হতে থাকে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যত? তখন  অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি অকেজো  ও ঠুনকো মনে হবে না? আমরা নিশ্চয়ই থাইল্যান্ডের কথা মনে রাখবো। মনে রাখবো সেসব সমাজের কথা যেখানে আয় উন্নতি থাকলেও মূল্যবোধ আর নৈতিকতার অভাব  প্রকট। আমাদের বড় শক্তি পরিবার সমাজ আর নৈতিকতা। সে পাপ-পূণ্য বোধ যদি এভাবে আক্রান্ত হয় আর তার পাহারাদার হিসেবে থাকে ঢাল হিসবে ব্যবহার  হয় রাজনীতি সমাজ কি আদৌ ঠিক থাকবে?

পাপিয়া রহস্যের বেড়াজাল ভেদ হোক। মানুষ জানুক কারা এর পেছনে। তাহলেই গড়ে উঠবে প্রতিকার। তা কি হবে আদৌ?