করোনাভাইরাস থেকে কবে মুক্তি পাব?

দানেশ মিয়া
Published : 23 Feb 2020, 04:01 PM
Updated : 23 Feb 2020, 04:01 PM

নভেল করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমিত হওয়ার প্রেক্ষিতে বেশ আতঙ্ক বিরাজ করছে বিশ্বব্যাপী। যদিও করোনা ভাইরাসের গোত্রের আরও ভাইরাস আছে। এমনকি আগেও এই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উহান প্রদেশের এই ভাইরাসটি নতুন বিধায় তাকে নোভেল বলা হয়েছে। ভাইরাসকে কখনোই কোষ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তবে তাতে জিনোম  আছে, যেখানে ডিনএ বা আরএনএ  থাকে। তার চারদিকে কিছু আমিষের আবরণ আছে। এটি ডাবল স্ট্র্যান্ডেড বা সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড হতে পারে। এরা তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে, কিন্তু তারা জীবিত না মৃত তা নিয়ে ধূম্রজাল আছে। এজন্য এদেরকে জীবন্মৃত বলা হয়।

করোনাভাইরাসগুলোর নামের সাথে 'করোনা' শব্দটি থাকার কারণ হলো, সূর্যের পৃষ্ঠদেশে যে আলোকচ্ছটা দেখা যায়, সেরকম ছটার মতো কিছু আকৃতি (Spike) এই ভাইরাসের বর্হিভাগে দেখা যায়। আর সূর্যের পৃষ্ঠদেশকে আমরা ইংরেজিতে 'করোনা' বলি। এই করোনার সাথে এই ভাইরাসের কিছু অংশ মিল আছে বলে, এর নামের সাথে করোনা শব্দটি যোগ করা হয়েছে। করোনা ভাইরাসগুলো বড় একটি ভাইরাস পরিবারের সদস্য। এরা সিঙ্গেল  স্ট্যান্ডার্ড আরএনএ ভাইরাস। এদেরকে আরো চারটি গণ (genera) তে ফেলে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়।

বর্তমান করোনাভাইরাস ২০০২ সালে মহামারি আকার ধারন করা সার্স ভাইরাসের মতো লক্ষণ প্রকাশ করেছে। ভাইরাস যখন কোন বাহক বা গ্রহিতার শরীরে সংক্রমিত হয়, তখন তারা রিসেপ্টর ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে ভাইরাসটি একই প্রজাতির অন্য গ্রহিতার শরীরে অথবা অন্য কোন প্রাণী বা মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতে পারে। অতি সম্প্রতি 2019-nCoV ভাইরাসটির জিনোম নিয়ে দুটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি কর্তৃক প্রকাশিত জার্নাল অব ভাইরোলজি এবং এলসেভিয়ের লি. কর্তৃক প্রকাশিত দ্য ল্যানসেট জার্নালে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, SARS-CoVএবং 2019-nCoV ভাইরাসটি একই রিসেপ্টর, ACE2, ব্যবহার করছে সংক্রমিত হওয়ার জন্য। আর এটাও নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই ভাইরাসটি বাঁদুরকেই প্রাথমিক বাহক (Host) হিসেবে বেছে নেয়। তবে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হওয়ার আগে আরো কোন বাহকের শরীর সে বেঁছে নিয়েছিল কিনা, তা জানা যায়নি। এটা জানা গেছে যে, এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতেও সক্ষম।

২০০২-২০০৩ সালে উত্থিত হওয়া SARS-CoVপ্রায় ৮ হাজার মানুষকে আক্রমণ করেছিল এবং ৮০০ মানুষের নিশ্চিত মৃত্যু রেকর্ড করা গেছে মোট ৩৭টি দেশে। এই ভাইরাসটিও চীনের গুয়াংডং এ সংক্রমিত হয়েছিল।

মার্স ভাইরাস নামের আরেকটি করোনা ভাইরাস ২০১২ সনে সৌদি আরবে সংক্রমিত হয়েছিল। এই ভাইরাসটি মোট দুই হাজার ৪৯৪ জন মানুষকে আক্রমণ করেছিল এবং মোট ৩৮ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। এই ভাইরাসটি উটের মাধ্যমে মানুষের শরীরে সংক্রমিত হয়েছে বলে গবেষণায় পাওয়া যায়।

বর্তমান ভাইরাসটি আগের সার্স এবং মার্স ভাইরাসের রেকর্ড ভঙ্গ করে ইতিমধ্যে অসংখ্য মানুষে সংক্রমিত হয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই হাজারের কাছাকাছি। এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে মহামারীর আকার ধারণ করে কিনা সে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভাইরাস সবসময়ই একটি রিসেপ্টর খোঁজে, যার মাধ্যমে তারা উদ্ভিদ বা প্রাণীর শরীরে ঢুকে পড়তে পারে। কারণ জীবিত কোনও বাহক বা গ্রহীতা না পেলে তারা টিকে থাকে না। তারা যখন রিসেপ্টরের মাধ্যমে দেহকোষে ঢুকে পড়ে, তখন তারা হাইজ্যাকারের মতো ভূমিকা পালন করে। দেহকোষগুলোকে তারা তখন সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং দেহকোষের কার্যপ্রণালীকে সম্পূর্ণ বদলিয়ে দেয়। এতে দেহকোষগুলো হয়ত মারা পড়ে, অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাতে দেহকোষগুলো আর তাদের নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে পারে না। এতে বাহক বা গ্রহীতা অসুস্থ হয়ে পড়ে, কখনো কখনো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে আক্রান্ত জীব যতক্ষণ না তার শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত সংক্রমণ বাড়তেই থাকে এবং সুবিধাজনক বাহক বা গ্রহিতার শরীরে প্রবাহিত হতে থাকে। এভাবে ভাইরাস তাদের স্বকীয়তা ও উপস্থিতি বজায় রাখে।

ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসা বলতে সাধারণত সংক্রমণের ফলে যে লক্ষণগুলো দেখা দেয়, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এখনো পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক ভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেক ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে বাজারে এখন কার্যকরী কিছু অ্যান্টিবায়োটিক আছে। কিন্তু এরকম কোন ব্যবস্থা বেশিরভাগ ভাইরাসের বিরুদ্ধে নেই। ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক ভ্যাক্সিন বের করা হয়েছে। তবে ভ্যাক্সিন বের করার প্রক্রিয়া অনেক জটিল যা অনেক সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ ব্যাপার।

উহানের নভেল করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমিত হওয়ার প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, তা কবে নাগাদ প্রশমিত হবে, তা বলা খুবই মুশকিল। কারণ, এই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন তৈরি করতে কমপক্ষে এক-দুই বছর লাগবে। এর মধ্যে ব্যাপকভাবে আক্রান্তদের মৃত্যু আমাদের সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। শুধু তাই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতেও তার প্রভাব হবে ভয়াবহ। ইতিমধ্যে তার অর্থনৈতিক প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে।

পৃথিবীতে অসংখ্যবার বিভিন্ন ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণে মহামারী হয়েছে। অসংখ্য মানুষ মারা পড়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অযাচিত মন্তব্য না করে, এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে এবং এর সমাধান বের করেছে। এসব রোগ-শোক থেকে দূরে থাকার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তার পরামর্শ দিয়েছে।

একেক সংস্কৃতির খাদ্যাভ্যাস একক রকম। এখানে কাউকে দোষারোপ করার কিছু নেই। একেকটা সংস্কৃতিতে একেকটা খাদ্যাভ্যাস তৈরি হতে হাজার হাজার বছর লাগে। খাদ্যাভ্যাস পরিত্যাগ করা অনেক কঠিন কাজ। বড় ধরনের খাদ্যাভাসের পরিবর্তন হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয় এবং তা সংস্কৃতির নিজশ্ব কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। সৌদি আরবে যখন মার্স করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে, তখন কিন্তু পৃথিবীর সভ্যদেশের মানুষেরা সৌদিআরবের লোকদের খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত সংস্কৃতির দোষ ধরেননি। গরুতে যখন ম্যাডকাউ রোগ ধরা পড়েছিল, তখন কিন্তু সভ্য মানুষরা গরুর মাংস খাওয়া সংস্কৃতির দোষ ধরেননি। আমাদের দেশে বাঁদুরের মাধ্যমে নিপা ভাইরাসের আক্রমণেও কিন্তু মানুষ মারা যায়, তাই বলে খেঁজুরের রস খাওয়া কেউ বন্ধ করেনি। তবে হ্যাঁ, কোনও সংস্কৃতির খাদ্যাভ্যাস যদি বিরল প্রজাতির কোনও বন্য জীবজন্তুর অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে ফেলে, তাহলে সেই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের জন্য সম্মানের সাথে কথা বলা যেতেই পারে। এতে আশা করি কেউ খাদ্যাভ্যাসজনিত অনুভূতিতে আঘাত পাবেন না।

বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও আবেগ-প্রবণ দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণ হলে কি যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে, তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। বাংলাদেশে একবার কোথাও এর সংক্রমণ শুরু হলে, তার নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে। এজন্য যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে সতর্কাবস্থা অবলম্বন না করলে, আমরা সত্যি সত্যি মহামারিতে আক্রান্ত হবো এবং অগুণতি মানুষের মৃত্যু ঘটবে।

বিজ্ঞানচিন্তাই আমাদেরকে এসব সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় বের করতে সহায়তা করতে পারে। বর্তমান করোনা ভাইরাস নিয়েও জরুরি গবেষণা চলছে। সমাধান অবশ্যই মিলবে- এই প্রত্যাশা করি।