কেন উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে বই লিখলাম?

মোহাম্মদ আব্দুল বাছিত
Published : 22 Feb 2020, 01:12 PM
Updated : 22 Feb 2020, 01:12 PM

দার্শনিক সক্রেটিসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, দেশপ্রেম কী? জবাবে সক্রেটিস বলেছিলেন, নিজের কাজ সর্বোত্তমভাবে করে যাওয়াই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম। দেড় যুগ সময় ধরে শিক্ষকতা এবং গবেষণা পেশায় জড়িত রয়েছি। দেশপ্রেমিক হলে নিষ্ঠার সাথে শিক্ষকতা এবং গবেষণাকর্মে ব্রত থাকাই আমার উচিত। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে- আমি কেন লিখছি?

গত কয়েক বছরে পরীক্ষক হিসেবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স এবং পিএইচডি লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের থিসিস দেখার সুযোগ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি থিসিস পড়ার পর মনে হয়েছে, খুব অপ্রতুল গবেষণা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমাদের ছেলে-মেয়েদের একটি অংশ বেশ ভালো মানের গবেষণা করছে। তবে তাদের থিসিসগুলো পড়ে আমার উপলব্ধি হলো যে বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী জানে না কীভাবে একটি থিসিস লিখতে হয়। একটি মানসম্পন্ন থিসিস লেখার জন্য কিছু জরুরি বিষয় জেনে-বুঝে তা সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি নোট লিখেছিলাম। এই নোট পড়ার পর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, শিক্ষানুরাগীর ইতিবাচক আলোচনা, পরামর্শ এবং অনুরোধ আমাকে আরও কিছু লেখার ভাবনায় ফেলে দিল। শিক্ষকতা এবং গবেষণা পেশায় আমার বয়স এমন আহামরি কিছু না। তবে সময় অল্প হলেও একটি গবেষণা ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা, বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীর গবেষণা তত্ত্বাবধান, ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মানের একটি কনফারেন্স আয়োজন, দেশ-বিদেশের অর্থায়নে কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প সম্পাদন, ন্যাশনাল ইয়াং অ্যাকাডেমি অব বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন, বুয়েটের একটি আবাসিক হলের প্রভোস্ট, বুয়েট ক্যারিয়ার ক্লাবের একজন অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে কিছু অভিজ্ঞতা সরাসরি অর্জনের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির আলোকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রচলিত ধারণা, বাস্তবতা , সংকট এবং করণীয় সম্পর্কে কিছু লেখার তাগিদ এবং দায়িত্ব অনুভব করলাম।

লিখতে হলে ভালো করে অর্থবহ কিছু লেখা উচিত। আমার মতো অপেশাদার লেখকের বেলা এ কথা অনস্বীকার্য যে সাহিত্যের মান কিংবা ভাষাশৈলীকে সম্পূূর্ণ প্রাঞ্জল রেখে হোক কিংবা না রেখে হোক আপন ভাবনার সব শাখা-প্রশাখাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে লেখা উচিত। ভালো লেখা কী? এ প্রসঙ্গে লাতিন আমেরিকান লেখক গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেসকে প্রশ্ন করা হলে তার উত্তর ছিল, 'কেবল নির্ভুল ও চমৎকার লেখাটাই একজন লেখকের কাজ নয়, ভালো লেখাটাও তার দায়িত্ব। ভালো লেখা বলতে বলছি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লেখার কথা।' দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মানুষ তখনই লিখতে পারে যখন তার চিন্তার স্বাধীনতা থাকে সীমাহীন।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জে বি বিউরির (১৮৬১-১৯২৭) কথায়, 'বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা অগ্রগতির পূর্বশর্ত।' চিন্তার স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে দেশে দেশে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন সক্রেটিস, প্রিসিলিয়ান, ব্রুনোসহ অনেকেই। এই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষজন। কিন্তু ইদানিং প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক থেকে শুরু করে আমার মতো খুব সাধারণ পর্যায়ের অনেকেই দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কিছু লিখতে পারছেন বলে মনে হয় না। স্বাধীনভাবে ভিন্নমত প্রকাশের কারণে সন্ত্রাসীদের হাতে, জঙ্গিদের হাতে নিহত হয়েছেন একাধিক লেখক ও ব্লগার। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সামাজিক মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশের কারণে হত্যা, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনাও আছে অসংখ্য। স্বভাবতই, স্বাধীনভাবে লিখতে না পারার এই বেদনা ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে গ্রাস করে, দেশে চিন্তার অবাধ স্বাধীনতাকে হুমকিতে ফেলে। তবে এর ভয়াবহ পরিণাম শুধু ব্যক্তিগত কিংবা রাষ্ট্রীয় ক্ষতিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, ভৌগোলিক সীমাও অতিক্রম করে।

আমার খুব পছন্দের একজন লেখক লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের কিংবদন্তি হোর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬), শৈশব থেকেই যিনি অন্ধ ছিলেন, তবে এই অন্ধত্ব কোনো দিন তাঁর জ্ঞানচর্চায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তুখোড় অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বোর্হেসের রচনা ছিল সত্যিকার অর্থে বিশ্বজনীন বা কসমোপলিটান সাহিত্য। বোর্হেসের কয়েকটি লেখার অসাধারণ নির্মাণশৈলী, বিশেষ করে The Aleph and Other Stories-আমাকে প্রচণ্ড আকৃষ্ট করেছিল সাহিত্য নিয়ে অল্পবিস্তর পড়ালেখা করতে।

ফরাসি সাহিত্যিক অনরে দ্য বালজাক (১৭৯৯-১৮৫০) লেখালেখির বিষয়ে কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন, শতভাগ তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনো লেখা প্রকাশ করতেন না। তার ছিল তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তি এবং প্রখর অনুধাবনক্ষমতা। ফরাসি ভাষার ওপর ছিল চমৎকার দখল, তথাপি তিনি নাকি একই লেখা বারবার নতুন করে লিখতেন। তাই নিজের সময়ের সঠিক রূপায়ণ এবং চারপাশের পরিবেশের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তাঁর রচনাবলিতে স্পষ্ট করে ফুটে উঠত। এই কথাশিল্পীর 'Old Father Goriot' উপন্যাসটি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। সায়েন্টিফিক জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করার বিষয়ে আমি খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের, সম্ভবত এখানে বালজাকের কিছুটা প্রভাব রয়েছে।

একসময় পড়েছিলাম ইতালিয়ান সাহিত্যিক গ্রেজিয়া দেলেদ্দার ১৯২০ সালে প্রকাশিত উপন্যাস La-Madre (The Mother)। উল্লেখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ গ্রেজিয়ার জীবনে হয়ে ওঠেনি, তবে La-Madre উপন্যাসে তার চিন্তাধারার বলিষ্ঠতা, অসাধারণ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, বিশেষ করে মায়ের চরিত্র চিত্রণের উৎকর্ষ ইতালির ছোট সাদিনিয়া দ্বীপের এক দ্বীপবাসিনীকে শুধু বিশ্বজোড়া খ্যাতিই এনে দেয়নি, এনে দিয়েছিল ১৯২৬ সালে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার।

গ্রেজিয়ার গল্প শুনেছিলাম আমার এক ইতালিয়ান বন্ধুর কাছ থেকে। বিজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি থেকে শুরু করে জগতের নানাবিধ বিষয়ে ওই বন্ধুর আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, অকপটে সে স্বীকার করত মৃত্যুর প্রায় ছয় যুগ পরেও তার ওপর নাকি রয়েছে গ্রেজিয়ার প্রভাব। এভাবেই শতাব্দী থেকে শতাব্দী পৃথিবীর নানা প্রান্তের কিছু মানুষ বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন প্রজন্মের তরুণদের প্রভাবিত করে আসছেন। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বেগম সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯১১ সালের ২০ জুন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি প্রবন্ধ থেকে জানতে পেরেছিলাম, কবির জন্মের সাত মাস পার হতে না হতেই তার পিতা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তার বেড়ে ওঠা কখনোই মসৃণ ছিল না। তথাপি সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি কবি যুক্ত ছিলেন শিশু সংগঠন এবং পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে। নারী অধিকার আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সব জাতীয় সংকটের সময় কবি আমাদের প্রেরণার উৎস ছিলেন। আমার বেড়ে ওঠার সময়ে কবি বেগম সুফিয়া কামালের লেখা 'আজিকার শিশু' কবিতাটি, বিশেষ করে কবিতার শেষ দুটি চরণ, 'তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর, জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর' মন্ত্রমুগ্ধের মতো বারবার পড়তাম।

তরুণ বয়সে সবচেয়ে বেশি পড়েছি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ। দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা, সাহিত্যচর্চা এবং সাধনার মধ্য দিয়ে গত কয়েক যুগে তিনি পৌঁছে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। তার শিক্ষাবিষয়ক প্রবন্ধগুলো নানাবিধ তথ্য-উপাত্ত আর দিকনির্দেশনায় ভরপুর। আমার লেখালেখির অনেক কিছুই তার প্রবন্ধ থেকে শেখা এবং জানা। কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রবন্ধসমূহ এবং গবেষণাকর্ম দীর্ঘদিন থেকে লেখালেখিতে আমাকে প্রেরণা দিয়ে আসছে।

আমাদের দেশের সমস্যা এখনো সীমাহীন, সমস্যার ধরনও বেশ বিচিত্র। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ রকম সমস্যা এবং সংকটের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে পৃথিবীর আরও অনেক দেশ এবং জাতিকে। ইংল্যান্ড-আমেরিকার গৃহযুদ্ধ স্বল্পকালীন ছিল না, ফরাসি বিপ্লব কিংবা রুশ বিপ্লব সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, বিপ্লবের সময় কিংবা বিপ্লবের আগে-পরে কত মানুষ নিহত হয়েছে, কত পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে তার হিসেব নেই। তবে সবকিছুর পরেও দেশগুলো আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, আশা নিয়ে উন্নয়ন এবং উৎপাদনে জনগণ মনোনিবেশ করেছে, দেশগুলোতে সকল স্তরের শিক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধও হঠাৎ শুরু হয়নি, এক দীর্ঘ ধারাবাহিক পথ অতিক্রম করে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকালে কিছু ক্ষেত্রে (যেমন কৃষিক্ষেত্র) আমাদের উন্নয়ন ঈর্ষণীয়।

তবে অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা দিনে দিনে করুণ হচ্ছে। বিশ্বের কথা বাদ দিলাম, এশিয়ার ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথেই আমাদের অপেক্ষাকৃত পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনো ধরনের তুলনায় আসতে পারবে না। আমরা বলছি উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু এই উন্নতি অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে তুলনা করলে খুবই নগণ্য। দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে, বিশেষ করে ভারত এবং পাকিস্তানে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। দুটি দেশেই রাজনৈতিক হানাহানি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, দুর্নীতি কিংবা ধর্ষণের মতো সামাজিক ব্যাধি আমরা হরহামেশা খবরের কাগজে পড়ি। তবে এত কিছুর পরেও ওই দুটি দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা এবং গবেষণায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করছে। আমাদের দেশে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড় শতাধিক। র‌্যাঙ্কিং নিয়ে কিছু বলতে আমি আগ্রহী নই, শুধু বলতে চাই সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ধারণ করে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের নেই, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে! এই অধঃপতন থেকে উত্তরণের উপায় কী? সরকারকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে অন্তত কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। কিন্তু গত কয়েক যুগের শিক্ষা এবং গবেষণায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতির সামগ্রিক চিত্র বিবেচনায় নিলে আশাহত হতে হচ্ছে, মনে হচ্ছে নীতিনির্ধারকগণ সঠিক পরামর্শ এবং দিকনির্দেশনা পাচ্ছেন না।

আমি যখন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই প্রবন্ধটি লিখছি তখন কয়েকটি দৈনিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে অস্বচ্ছতা, অপরিকল্পনা এবং দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হচ্ছিল। আন্দোলনকারীদের প্রশাসনিক ভবন অবরোধের ফলে উপাচার্যের অফিসসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলো বন্ধ রয়েছে মর্মে খবর প্রকাশিত হচ্ছিল। মাসের শেষ দিকে উপাচার্যকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে কালো পতাকা প্রদর্শন করেছেন আন্দোলনকারী কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এমন ঘটনা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা স্বাভাবিকভাবে নিতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তবে সভ্য দেশে এইসব কল্পনাতীত।

প্রায় একই সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নির্দেশে পুলিশ প্রশাসন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে এবং ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ ও গ্রামবাসী মিলে হামলা করেছে মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্রদের রক্তমাখা ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো কিসের ইঙ্গিত, দিনে দিনে আমরা কোথায় যাচ্ছি! শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে, রাত থেকে তাদের আবাসিক হলে খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরদিন সকাল থেকে হলে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, 'আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ৩ অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।'

৭ অক্টোবর ২০১৯ বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ২০১৭ ব্যাচের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় বুয়েটের ২৫ জন ছাত্রকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে এবং বুয়েট থেকে ২৬ জনকে চিরতরে বহিষ্কার করা হয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বুয়েটসহ পুরো জাতি স্তম্ভিত, শোকাহত এবং গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ রকম নেতিবাচক এবং অগ্রহণযোগ্য খবর প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। শিগগিরই এর থেকে উত্তরণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, বরং দিনে দিনে দ্রুত অবনমন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু শিক্ষক রয়েছেন যারা শুধু শিক্ষা, গবেষণা এবং এসংক্রান্ত কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন এবং রাখতে চান, তাঁদের জন্য এই বিষয়গুলো মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর। তবে আশা রাখি, লেখালেখিসহ নানাবিধ সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে কোনো একদিন আমাদের দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় 'সেন্টার অব অ্যাক্সিলেন্স' হিসেবে গড়ে উঠবে। এমন একটি ভাবনা থেকেই একসময় নিজের অনুভূতি এবং উপলব্ধিগুলো লেখা শুরু করলাম।
আমার লেখালেখির আরও একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে বিশুদ্ধ গবেষণার একটি সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা। বর্তমানে অনেক গবেষক নিরলসভাবে তাত্ত্বিক এবং ব্যাবহারিক উভয় ক্ষেত্রে গবেষণা করছেন। বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সাহিত্যিক মানসিকতা, উন্নত দর্শন এবং সভ্য সংস্কৃতির লালন অনস্বীকার্য। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 'লেখকের কথা'য় উল্লেখ করেছেন, 'এ যুগে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে সাহিত্য লেখা অসম্ভব- তাতে শুধু পুরোনো কুসংস্কারকেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে। সাহিত্য বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক হলে, তিনি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হিংস্র মানুষের হাতে মারণাস্ত্রই তুলে দিবেন।' বিশুদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে, তবে কোনোভাবেই যেন কারও হাতে মারণাস্ত্র তুলে না দিই তাই আমার এই কিঞ্চিৎ সাহিত্যচর্চা।

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে আমার লেখা অনেকগুলো প্রবন্ধ একটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করেছে সংহতি প্রকাশন। 'উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা: সংকটের স্বরূপ এবং উত্তরণে করণীয়' শিরোনামের ওই গ্রন্থটির ভূমিকা লেখার জন্য পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে অনুরোধ করেছিলাম অধ্যাপক মো. কামরুল হাসানকে যিনি আমার প্রিয় শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং একজন অভিজ্ঞ গবেষক। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনায় মৌলিক গবেষণা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টির ধারণাটি বহুলাংশেই অনুপস্থিত-এই বাস্তবতারই সামগ্রিক বিশ্লেষণ এবং যৌক্তিক পথনির্দেশনা তৈরির একটি নির্মোহ প্রয়াস হিসেবেই গ্রন্থটিকে চিহ্নিত করেছেন অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান। বইটি প্রকাশের উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তার একটি সামগ্রিক চিত্র পাঠকের সামনে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে তিনি লিখেছেন:

বর্তমান গ্রন্থের প্রবন্ধসমূহ লেখকের নিজস্ব উপলব্ধি থেকে লেখা, বক্তব্য সুস্পষ্ট ও অকপট। লেখক যা করেছেন, দেখেছেন, বুঝেছেন সেভাবেই লিখেছেন। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আগ্রহী ছাত্র-শিক্ষক সবার জন্যই বইটি সহায়ক হবে। তবে বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিঘাত হবে পাঠকের মনে চিন্তা জাগিয়ে তোলা। প্রতিটি প্রবন্ধ পড়ার সাথে সাথে পাঠকের মনেও স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিভিন্ন চিন্তা আসবে। সেই চিন্তা থেকে আরও আলোচনা-বিতর্ক ইত্যাদি হবে এবং এসবের ভেতর থেকেই গঠনমূলক কিছু বের হয়ে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। গবেষণা কী, কীভাবে গবেষণা করতে হয়, কীভাবে গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে হয়, থিসিস রচনার নিয়ম কানুন কী, প্লেজিয়ারিজম কী এবং এটা যে অবশ্য বর্জনীয়, গবেষক হওয়ার সাথে যে সততা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ইত্যাদি নানা বিষয় বইটিতে এত পরিষ্কারভাবে লেখা হয়েছে যে, কেউ পড়লেই এসবের একটি স্পষ্ট ধারণা পাবেন। যোগ্য এবং দূরদর্শী একজন উপাচার্যের কর্তব্য, একজন শিক্ষার্থীকে গবেষক হিসেবে গড়ে তুলতে উপযুক্ত ও দক্ষ শিক্ষকের ভূমিকা এবং সর্বোপরি মানসম্পন্ন একটি বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় রূপান্তরে কী ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয়েও সম্যকভাবে অবহিত হবেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স আয়োজনে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কেন প্রয়োজন, বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং পদোন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন কেন অপরিহার্য, ভালো মানের গবেষণাগার এবং ভালো গবেষক তৈরি করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কী করণীয়, এই বইটিতে এ রকম আরও অনেক বিষয় প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে বিচিত্র সব প্রসঙ্গ নিয়ে একটি লজিক্যাল ফ্লো-তে লেখা এরকম কোনো বইয়ের কথা অন্তত আমার জানা নেই। সেই হিসেবে আগত সব সময়ের জন্য এটি একটি পথিকৃৎ গ্রন্থ হয়ে থাকবে, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সমস্যা চিহ্নিত করাই এই গ্রন্থের একমাত্র অর্জন নয়, বর্তমান বাস্তবতায় যোগ্য গবেষক ও শিক্ষকের করণীয় কী, সে বিষয়টিও বাছিত এড়িয়ে যাননি। এরকম একটি বই সত্যিই খুব দরকারি; বিশেষ করে সঠিকভাবে গবেষণা প্রজেক্ট লিখতে পারলে প্রয়োজনীয় অর্থপ্রাপ্তি যে অসম্ভব নয়, এটি এই বইয়ের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।

লেখক হিসেবে আমি চেষ্টা করেছি বিভিন্ন উদাহরণ, ঘটনা এবং আমার বাস্তব উপলব্ধির আলোকে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণায় আমাদের ত্রুটি, বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে স্পষ্ট আলোচনা করতে। শিক্ষা সংকটের স্বরূপ উন্মোচন করে সম্ভাব্য সমাধানের দিকনির্দেশনা এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের ধারণা প্রদান করেছি যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আরও খোলামেলা আলোচনার দাবি রাখে। অধ্যাপক কামরুল হাসান ভূমিকার শেষাংশে উল্লেখ করেছেন,
'মৌলিক গবেষণায় আগ্রহী তরুণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে এদেশের শিক্ষাকাঠামো বিষয়ে উৎসুক পাঠক এবং নীতি নির্ধারক সকলেরই কাজে আসবে 'উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা: সংকটের স্বরূপ এবং উত্তরণে করণীয়' গ্রন্থটি' ।

উক্ত গ্রন্থটি বর্তমানে অমর একুশে বইমেলায় সংহতি প্রকাশনের ৫২১-৫২২ নং স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বইটির বিষয়ে পাঠকরা যেভাবে ইতিবাচক গঠনমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা নিঃসন্দেহে আমাকে এবং প্রকাশককে অনুপ্রাণিত করেছে। তরুণ গবেষকবৃন্দের গবেষণা চিন্তায়, গবেষণাকর্ম সম্পাদন এবং সর্বোপরি দেশে একটি উন্নত গবেষণা সংস্কৃতি তৈরির জন্য নীতিনির্ধারণে 'উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা : সংকটের স্বরূপ এবং উত্তরণে করণীয়' বইটি যদি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে তাহলে লেখক হিসেবে আমার প্রয়াস সার্থক হয়েছে বলেই মনে করবো।