মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আত্মসংবরণের গূঢ় রহস্য

আনিসুর রহমান
Published : 22 Feb 2020, 12:08 PM
Updated : 22 Feb 2020, 12:08 PM

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি নাই সে বিষয়ে একটি কথাও বলব না। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী লোকজন বলবেন, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই। প্রচারমন্ত্রীসহ সরকারি দলের মুখপাত্র উদাহরণ দিয়ে বলবেন, হ্যা দেশে তো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিব্যি রয়ে গেছে; অনেক অংশে পশ্চিমা দেশের চেয়েও বেশি।

ধরে নিলাম, সরকারের এবং সরকারের বিরোধী উভয় পক্ষের লোকজনের বক্তব্যই সত্য। আবার এও হতে পারে উভয় দলের বক্তব্যই মিথ্যা। এখানে প্রশ্ন- এটা আবার কিভাবে? এ প্রসঙ্গে আমার বাবার কাছ থেকে শোনা একটি গল্প আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চাই।

এক ব্যক্তি তার গ্রামেরই আরেক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছে, অই মিয়া তুমি এখন কেমনে চল?
দ্বিতীয় ব্যক্তি: নিজেও চলি, আল্লাহও চালায়।
প্রথম ব্যক্তি: সেটা আবার কেমনে?
দ্বিতীয় ব্যক্তি: আল্লাহ যখন চালায়, তখন খাইয়া থাকি। আর নিজে যখন চলি, তখন না খাইয়া থাকি।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কী, সেটার মাত্রা কত গভীর ও বিস্তৃত তা বোঝানোর জন্যে আধুনিক ইতিহাসের পুরনোতম আর সর্বোত্তম আইনটি হচ্ছে সুইডেনের।

সেই আইনটি উল্লেখ করতে চাই- ১৭৭৬ সালে সুইডেনের জাতীয় সংসদে ছাপার স্বাধীনতা আইনটি পাস হয়। এই আইনটিকেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে আধুনিক ও আদি আইন মনে করা হয়। এই আইন সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, আইনটির রক্ষাকবচে একজন কারো শস্যখতেে নাচতে পারার স্বাধীনতাও থাকবে, তবে খেতের এবং শস্যের বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করে।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, দেশের পত্রিকাগুলো আর সামাজিক গণমাধ্যমে যা ইচ্ছে তাই প্রকাশ হচ্ছে সেটাই  মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাই মোট কথা এটা নয়। এর সঙ্গে দায়বোধও থাকতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যম যথেষ্ট নিয়মনীতি ও দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করে। নতুন যোগ হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশনস (জিডিপিআর)।

এই আইনের আওতায় ব্যক্তির লিখিত অনুমতি ছাড়া তার ব্যক্তিগত তথ্য এবং ছবি প্রকাশ করা যাবে না। এই আইনটি ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বানায়। ২০১৮ সাল থেকে এটি কার্যকর হয়।

এই বাস্তবতায় এসব দেশের কোনও গণমাধ্যম এমন কি কোনও কর্তৃপক্ষ আদালত কর্তৃক প্রমাণিত হবার আগ র্পযন্ত কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম, ঠিকানা ও ছবি প্রকাশ করতে পারবে না। এর বিপরীতে আমরা কী দেখছি? সরকারের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ধরে একবারে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করে দিচ্ছেন, তার নাড়ি নক্ষত্র (!) ফাঁস করে দিচ্ছেন। আর আমাদের সম্পাদক বাহাদুররাও তা ছেপে দিচ্ছেন। এর ব্যাখ্যা কী? এর শেষ কবে? এই প্রবণতায় উৎসাহিত হয়ে গ্রাম্য মোড়লরা বিচার ও স্বাধীনতা হাতে তুলে নিয়ে অভিযুক্ত এবং অভিযুক্ত নয় এমন মানুষকে ধরে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলছেন। এমনকি এমন ঘটনা তো খোদ রাজধানীর বাড্ডাতেই ঘটে গেল। কে বলে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই?

এখানেই শেষ নয়, কথায় কথায় মুরতাদ ঘোষণার স্বাধীনতাও কি একদল লোক ভোগ করছে না? এমনকি তালিকা করে ইসলামের শত্রু হিসেবেও ঘোষণা দিচ্ছে । তারা তো এই দেশেরই!

এমন কি এক সম্পাদক যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখার খবর ছেপে দিলেন। তিনি কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়েই বের হয়েছিলেন।

এবার অন্য একটি বিষয় উল্লখে করব। বিগত বছরগুলোতে একদল ব্লগার এবং ব্লগার নামধারী কতিপয় প্রকাশক, এমনকি কয়েকজন লেখক সাংবাদিকও বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। পশ্চিমা নানা সংস্থা আর সংগঠনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই।

আমি শুরুতেই বলেছি, আমাদের দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি নাই- এ বিষয়ে একটি কথাও বলব না। আমি বরং একটি প্রশ্ন উত্থাপন করব। আমাদের যেসব স্বদেশি ভাই ও বোনেরা বিভিন্ন সংস্থার হয়ে দেশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, ওই সব দেশের কোন একটা বিষয়ে ওই দেশের মূলধারার গণমাধ্যমের সমালোচনামূলক একটা লেখা প্রকাশ করে দেখিয়ে দেন তো কতটুকু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে!

হ্যা পশ্চিমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তবে মতপ্রকাশের উপযুক্ত জায়গা নাই। ব্যাপারটা এরকম শেয়ালের বাড়িতে বককে নিমন্ত্রণ করে চ্যাপ্টা পাত্রে স্যুপ খেতে দেওয়া।

সরকারবিরোধী রাজপথের কর্মকাণ্ডে আলোকচিত্রী শহীদুল আলম যেভাবে ফেইসবুকে লাইভ হয়ে গেলেন, আর আল জাজিরা তা লুফে নিল- সেটাও একটা উদাহরণ হতে পারে।  কাতার সরকারের বিরুদ্ধে বা কাতারে যে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নাই সেটা আমাদের মতপ্রকাশের বীরেরা আল-জাজিরায়  প্রকাশ করে দেখিয়ে দিতে পারবেন কি?

তবে হ্যা ব্যক্তির নিরাপত্তা, ব্যক্তির কোনও একটা বিষয়ে প্রকাশের স্বাধীনতার অভাবকে, গোটা দেশের নিরাপত্তাহীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই- তা তো ঢালাওভাবে বলা যাবে না। এমন কি সুইডেনের চিত্রশিল্পী লার্স ভিকস রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ছাড়া চলতে পারে না। তাই বলে কি সুইডেনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, সুইডেনে শিল্পীদের নিরাপত্তা নাই?

আমাদের এক স্বদেশী বোন দিল্লিতে যার নির্বাসন। তিনি কথায় কথায় বাংলাদেশেকে কাঠগাড়ায় দাঁড় করান। তিনি এই সময়ে  ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সমালোচনা করে দেখান তো দিল্লি কয়দিন থাকতে পারেন! তাই বলি ব্যক্তির নিরাপত্তার সঙ্গে বা ব্যক্তির স্বাধীনতার অভাবকে সারাদেশের সামগ্রিক চিত্র বলে ঢালাওভাবে সাধারণীকরণরে কারণ নাই।

অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনাও আলোচনার দাবি রাখে, জামাতের মুখপাত্র বলে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকাটি কাদের মোল্লাকে 'শহীদ' উল্লখে করে খবর ছেপেছে। এটা অপরাধ সন্দেহ নাই। কিন্তু তার জন্য মামলা হবে, তারপর বিচারক সদ্ধিান্ত দেবেন, অপরাধের মাত্রা নির্ধারণ করবেন। কিন্তু তার আগেই পত্রিকা অফিসে হামলা, ভাঙচুর। এর ব্যাখ্যা কী? নরওয়ের মত জায়গায় এথিকস কাউন্সিল বা নীতি পরিষদ রয়েছে। বাংলাদেশেও প্রেস কাউন্সিল বলে একটা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ কী বা দরকারটা কী? যুদ্ধাপরাধীকে শহীদ বলা যেমন আপত্তিকর, তাহলে সক্রিয় যোদ্ধাকে রাজাকারের তালিকায় ঢোকানোও তো অপরাধ। তাহলে এ অপরাধে মামলা কেন নয়? এ ব্যাপারে আমাদের সম্পাদক পরিষদ বা সংবাদপত্র মালিক সমিতি অথবা নবগঠিত এডিটরস গিল্ডের কি কিছুই বলার ছিল না? উদ্ভূত এই ঘটনা নিয়ে নিরাপদ অবস্থান, না কি এটাও সেল্ফ সেন্সনশিপ বা 'আত্মসংবরণ'?

আত্মসংবরণ নিয়ে বিশদ কিছু বলার আগে দিনেমার দার্শনিক সৌরেন কিয়ের্কেগার্ডের একটি উক্তির শরণ নেব-

"আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই বলে আমরা লড়াই করছি। অথচ যেটা আমাদের আছে তার সদ্ব্যবহার করছি না; তা হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা। চিন্তার স্বাধীনতার ব্যবহার নাই বলেই আমরা একটা আত্মসংবরণকারী জনগোষ্ঠিতে পরিণত হচ্ছি। এই আত্মসংবরণের বিষয়টা ব্যাপকভাবেই আমাদেরকে পেয়ে বসেছে।"

বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর পাতাসহ বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে তার প্রতিফলন। চিত্র একই রকম, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও। অধ্যাপক জাফর ইকবাল যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মোগল সম্রাটদের সঙ্গে তুলনা করেছেন সেদেশে 'আত্মসংবরণ' যে ব্যাপক আকারেই থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। ঘটনা এখানেই শেষ নয়- সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিঙ্গাড়া ভাষণের উপাচার্য আমলেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে 'হিজাব দিবস' উদযাপিত হয়ে গেল। দুর্দান্ত!

একটি সত্য হচ্ছে, লেখালেখির সময় লেখক যদি পাঠকের কথা মাথায় রাখে, তাহলে সর্বনাশ।

উদাহরণ দিয়ে বলি, আপনি যদি প্রেমের কবিতা লেখার সময় মনে করেন, আপনার বাবা বা আপনার শ্বশুর এই কবিতাটা পড়লে কী ভাববেন, তাহলে কবিতার কপাল পুড়ছে। একই অবস্থা আমাদের সম্পাদক, লেখক, সাংবাদিক আর বুদ্ধিজীবীদের যদি হয়। তারা হয়তো অনেকেই ভাবেন- এই লেখা রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী পড়লে কী ভাববেন, এই লেখা আবার সেনাপ্রধান বা পুলিশপ্রধানের চোখে পড়বে না তো, আমি আজকে যদি আমেরিকার সমালোচনা করে একটা কথা বলি, কালকেই তো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় আমার দাওয়াত, আমি যদি ভারতের সমালোচনা করি তাহলে তো আমাকে ভারতীয় ভিসা আর দিবে না… ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সমস্ত অনুসঙ্গও আমাদের সময়ের মানুষদের আত্মসংবরণ আক্রান্ত এক সময় উপহার দিচ্ছে। কথা আরও আছে, লেখার সময় বা বক্তৃতার সময় কারও মাথায় যদি থাকে আহা আমি যদি 'এই' কথাটা প্রকাশ করি তাহলে তো পুরস্কারও পাব না। সরকার বা অমুক তমুক দল বা কর্পোরেট মুঘলের ইফতারের দাওয়াতটাও পাব না। এরকম বাস্তবতাই আমাদেরকে আত্মসংবরণকারী রোবটে পরিণত করছে।

যে দেশে প্রশাসন এবং পুলিশ প্রেম করার অপরাধে তরুণ ছেলেমেয়েদের থানায় ধরে নিয়ে যায়- সেখানে আত্মসংবরণ আক্রান্ত কি আমরা হব না? এটা বিশেষ কোন সরকারের আমল বলে আলাদা করা যাবে না, সব সময়ের চিত্র প্রায় একই। একটা শহরের সৌন্দর্য আর নিরাপত্তার মাপকাঠি সেখানেই- প্রেমিক এবং প্রেমিকা প্রকাশ্য রাস্তায় একে অপরকে বিনাদ্বিধায় এবং নির্ভয়ে চুমু খেতে পারে কি না? আমাদের দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর আত্মসংবরণের নিগূঢ় রহস্য এই কথাতেই বলে দিলাম। যে যা বোঝার বুঝে নেন।