গত বছর কলকাতায় গিয়ে রাস্তায় একটা দৃশ্য দেখে ভিরমি খেয়ে গেলাম! করপোরেশনের গাড়ি প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পিচের রাস্তায় পানি ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে আর গাড়ি দিয়ে মই বেয়ে গাছগুলোতে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। গাছগুলো প্রচণ্ড তাপ থেকে যেন একটু স্বস্তি পাচ্ছে। আমি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দেখলাম আর ভাবলাম এটি কি আমাদের দেশে সম্ভব? সম্ভব কে করবে! আগে তো বৃক্ষকে ভালবাসতে হবে। তার যে প্রাণ আছে তা মানতে হবে, জানতে হবে। যে দেশে পাখি গাছে বসে আর গায়ে হাগু করে দেয় অজুহাতে একজন ভিসি গাছ কেটে ফেলে, সে দেশে গাছের জন্য তো নয়ই, মানুষের জন্যও পানি পাওয়াটাই কঠিন। আমার ভাড়া বাসার ৬ তলায় ফুল গাছগুলোতে পানি দেই, পানি দেই পাতাগুলোতেও । প্রতিদিনই প্রচণ্ড কাদা ময়লা (কালচে রং) বের হয় গাছগুলোর পাতা থেকে। পাতার রং কেমন যেন ফ্যাকাসে। যেদিন বৃষ্টির পানি এসে পড়ে কেবল সেদিন একটু সবুজ আর ঝরঝরে লাগে ওদের। এই নগরে একটি বৃক্ষপল্লব কতটা কষ্টে থাকে তা আমার বারান্দায় দাঁড়ালেই টের পাওয়া যায়। আমাদের নগরে বৃক্ষরা ধুঁকছে আর মানুষের কথা তো সবাই জানে। প্রায় বৃক্ষহীন এই নগরে তাই আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নেবার কেউ নেই। না সরকার, না জনগণ না আর কেউ। প্রতিদিনই আমরা দৌড়াই হাসপাতাল, ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স। আর কতদিন!
আজ অফিসের পথে হাঁটছিলাম, আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক তার হাতের পেডেল লাগানো রিকশা নিয়ে। আমি বার কয়েক তার দিকে তাকিয়ে রিকশা নিলাম, তার মুখে স্পষ্টতই বিরক্তি। এটা মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নং রাস্তার চিত্র বললাম। এছাড়া আশেপাশের সকল হাউজিং-এর রাস্তা কাটা, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার রাস্তাটাও হয়ে গেছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিটি বাসাবাড়ি ও দোকানে পড়ে গেছে ধুলার স্তর। এই দৃশ্যটি কেবল ঢাকা শহরের নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় নয় পুরো ঢাকা জুড়েই চলছে এক বিশাল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর খোঁড়াখুঁড়ি । ঢাকার রাস্তায় হঠাৎ করেই ধুলার পরিমাণ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে ধুলাবাহিত রোগের প্রাদূর্ভাব।
একদিকে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ঢাকায় মাস্কের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে, অনেক এলাকায় আবার খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। দাম হয়ে গেছে আকাশচুম্বী। অন্যদিকে ধুলা থেকে বাঁচারও কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না নগরবাসী। দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সম্প্রতি ড্রেনেজ তৈরির কাজ শুরু হবার পরেই এই চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে। কোনোরকম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে এই কাজ করার কথা থাকলেও এর কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। রাস্তা এমন ভাবে কাটা হচ্ছে যে মানুষ বিকল্প রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছে না। অন্যদিকে মাইকিং করে বা বিজ্ঞাপন দিয়ে কোন দিন কোন এলাকার রাস্তা কাটা হবে আর এজন্য জনগণকে কি ধরণের বিকল্প রাস্তা বা সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে সেটাও জানানো হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)'র চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ঢাকা শহরের ধুলা দূষণের প্রধান কারণ হলো এই যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি আর অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ। আমরা এটাও জানি, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে ২ শতাংশ পরিবেশ ব্যয় ধরা হলেও তা কোনো অর্থেই ব্যয় করা হয় না। অন্যদিকে তাদের খেয়াল খুশি মতোই তারা পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। জনদুর্ভোগ কমানোর বদলে দিনদিন এই দুর্ভোগ বাড়িয়েই চলছে। আমরা কোনোভাবেই উন্নয়নবিরোধী নই কিন্তু উন্নয়নটা জনগণের কম ভোগান্তি করে করতে হবে। আর সমন্বিত উন্নয়ন কৌশলটাও জরুরি। এখন পানির পাইপ তো তখন গ্যাসের লাইন আর তারপর টিএন্ডটি এভাবে নাগরিকদের কষ্ট দেয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই।
ধুলা দূষণে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে ধুলাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ। রাস্তার পাশে দোকানের খাবার ধুলায় বিষাক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ জীবাণুমিশ্রিত ধুলা ফুসফুসে প্রবেশ করে সর্দি, কাশি, ফুসফুস ক্যান্সার, ব্রংকাইটিস, শ্বাসজনিত কষ্টসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। ধুলার কারণে দোকানের জিনিসপত্র, কম্পিউটারসহ নানা ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘরবাড়ি আসবাবপত্রসহ কাপড়-চোপড়ে ধুলা জমে যেভাবে প্রতিদিন নগর জীবনকে নোংরা করছে, তা পরিচ্ছন্ন রাখতেও নগরবাসীকে নষ্ট করতে হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমঘণ্টা ও বিপুল পরিমাণ পানি এবং ডিটারজেন্ট। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই খোঁড়াখুঁড়িতে যে হারে ধুলাময়লা বেড়ে চলেছে তাতে করে হঠাৎ করেই বেড়ে চলেছে নানান শারীরিক সমস্যা। বিশেষ করে ঠান্ডা জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, হঠাৎ করেই ধুলাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। পৃথিবীর মধ্যে আমরা এখন অন্যতম বায়ু দূষিত নগরী। এখন এই খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বায়ু দূষণ আরো বেড়ে গেছে। গত সপ্তাহে শীর্ষে ছিলাম আমরা দিল্লিকে আবারও ছাড়িয়ে। ঢাকার বাতাসে ভাসমান দূষিত কণা (পিএম) বেশি। ক্ষতিকর গ্যাসও বেশি। এর সাথে ধুলিকণা বেড়ে বায়ু দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। এসময় শ্বাসতন্ত্রের রোগ অ্যাজমা, হাপাঁনি বেড়ে গেছে। এর কারণে যক্ষাও বেড়ে যায়। বেড়ে যায় এলার্জি । এই ধুলাদূষণ ও বায়দুষণের ফলে জনস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আর তারই প্রভাব পড়ছে অর্থনীতির উপর।
লেলিন বলেন, আমাদের প্রথম কাজ হলো জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে ঢাকাকে বাসযোগ্য করা। রোগমুক্ত মানবসম্পদ তৈরি করা। উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাও (Environment management plan) থাকে। কিন্তু আমাদের ঠিকাদার ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়টিতে নানা কারণেই নজর দেন না। দূষণ নিয়ন্ত্রণে থাকে চরম অবহেলা। এটার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯১টি দেশের ১৬০০ শহরের মধ্যে বায়ু দূষণের দিক থেকে সবচেয়ে দূষিত ২৫টি নগরীর মধ্যে বাংলাদেশের তিনটি নগরী (ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ) রয়েছে। পরিষেবার অবকাঠামো তৈরি, সম্প্রসারণ ও মেরামত করার সময় খননকৃত মাটি ও অন্যান্য সামগ্রী রাস্তায় ফেলে না রেখে বিধি মোতাবেক দ্রুত অপসারণ করা। এ কাজে ব্যর্থ হলে তহবিল তছরুপের জন্য দুর্নীতি মামলা করা ও দায়ী কর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে সব পরিষেবা কার্যক্রমের জন্য রাস্তা একবার খনন করা। রাস্তাঘাট ও ফুটপাত নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা। ভবন নির্মাণ ও মেরামত বা অন্য যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণের সময় নির্মাণ সামগ্রী রাস্তার ওপর বা রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় না রাখা। ধুলা সৃষ্টি করে এমন কোনো সামগ্রী (বালু, মাটি, ইট, পাথর) বহনের সময় সঠিক আচ্ছাদন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া ইত্যাদি।
এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ রোধে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আমরা চাই যে কমিটি গঠন করা হবে সেই কমিটি ঘুমিয়ে পড়বে না, তারা ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে জনভোগান্তি দেখবেন এবং তরিৎ ব্যবস্থা নেবেন।