মাতৃভাষায় শিক্ষা: কল্পলোকের গল্প নয়

মেহেরুন্নাহার স্বপ্না
Published : 21 Feb 2020, 03:13 PM
Updated : 21 Feb 2020, 03:13 PM

পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু ক্যামিলি চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় বাবা-মায়ের সাথে থাকে। ক্যামিলির পৃথিবী পাহাড়ের সবুজ পাখির কলতান, ঝর্ণার নির্মল ধারা আর প্রাণপ্রিয় চাকমা ভাষার ঐশ্বর্য্যে লালিত। যেখানে সে স্বপ্ন দেখে মাতৃভাষায়, ঘুম থেকে জেগে মাকে ডাকে তার মাতৃভাষায়। বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি খেলে আর খুশিতে লুটোপুটি খায়। আবেগের প্রকাশ ঘটে তার মাতৃভাষায়। কিন্তু ৫ বছর বয়সে যখন সে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হলো তখন যেন জীবনের সবচেয়ে বড় হোঁচট খেল। এ আমি কোথায় এলাম! দিদিমনি তো চাকমা ভাষায় কথা বলে না! বইগুলোর ভাষাও তো চাকমা নয়। কিছুই বোঝে না সে। না দিদিমনির নির্দেশনা; না বইয়ের কথা! স্কুল আর তার ভালো লাগে না। সবকিছু কেমন যেন দুর্বোধ্য! তবে কি ক্যামিলি আর কখনও স্কুলে যাবে না? না, ক্যামিলি এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

এই স্কুলের পরিবেশ তার কাছে অপরিচিত নয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের সহায়তায় জাবারাং কল্যাণ সমিতি বাস্তবায়িত মাতৃভাষা ভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে যায় যেখানে দিদিমনি হচ্ছে তার পাড়ার এবং চাকমা ভাষায় কথা বলে। ছড়া ও গল্প বইও চাকমা ভাষায়, বন্ধুরাও চাকমা ভাষায় কথা বলে।  যেখানে চাকমা পড়শোনা শিখতে শিখতে সে বাংলায় পরিচিত হচ্ছে। ক্যামিলি স্কুলের পরিবেশ এখন আর ভয় পায় না। ওর মনে হয় স্কুলে যদি আরও সময় কাটাতে পারতাম! গল্প শুনতাম, ছড়া বলতাম, বন্ধুদের সাথে অনেক ধরনের খেলা খেলতাম। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার সুযোগের জন্য। দিদিমনির ভাষা চাকমা হওয়ায় সহজেই সে সবকিছু বুঝতে পারে এবং এতে তার ভয়ও কেটে গেছে। আমরা আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুকে এভাবেই দেখতে চাই। যেখানে সে নিজের ভাষায় ছড়া বলতে বলতে গান গাইতে গাইতে গল্প বলতে বলতে তার পাঠের বিষয়টি শিখবে এবং বিদ্যালয় সংস্কৃতি ও পরিবেশের  সাথে পরিচিত হবে।

মাতৃভাষার শিক্ষার বিষয়টি একসময় মনে হতো অনেক দূরূহ কিছু। কিভাবে সম্ভব? প্রতিটি ভাষায় শিক্ষা উপকরণ তৈরি কিভাবে হবে? এসব ভাষার বিশেষজ্ঞদের কোথায় পাওয়া যাবে? কারা বই লেখালেখির কাজ করবে? কিন্তু পার্বত্য ও সমতল এলাকায় বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত 'মাতৃভাষায় শিক্ষা' কর্মসূচিগুলো প্রমাণ করেছে এটা সম্ভব। মাতৃভাষায় শিক্ষা এখন আর কল্পলোকের গল্প নয়।

বাংলাদেশের সেভ দ্য চিলড্রেন, জাবারাং কল্যাণ সমিতি, রাখাইন ডেভলপমেন্ট ফাউন্ডেশেন, কোডেক, আশিকা, ব্র্যাক এর মতো আরও অনেক সংস্থা মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার কাজ করছে। পার্বত্য ও সমতল এলাকার বিভিন্ন ভাষার জনগোষ্ঠীর শিশু উপযোগী ছড়া, গল্প, বর্ণ শেখার বই তৈরি হয়েছে এবং এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে পাহাড় ও সমতল দু এলাকাতেই পরিচালিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ৫ টি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত উপকরণ তৈরি করেছেন। কিন্তু এখনও প্রয়োজন মাতৃভাষায় শিক্ষা বিষয়টিকে নীতি নির্ধারক পর্যায়ের পদ সঞ্চালনকে দ্রুততর করা। তার জন্য প্রয়োজন:

১. আদিবাসী শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত স্ব স্ব ভাষায় শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

২. টেক্সট বইয়ের পাশাপাশি স্ব স্ব ভাষায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যা PTI কর্তিক প্রদান করা যেতে পারে।

৩. স্ব স্ব কমিউনিটি থেকে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

৪. মাতৃভাষায় শিক্ষা বিষয়টিকে জাতীয় শিক্ষানীতি ১০ এ অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। যদিও মাতৃভাষা না 'মাতৃভাষায়' এ নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে তবুও আমি মনে করি এটা 'টাইপের' ভুল কারন বিভিন্ন সভায় মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ 'মাতৃভাষায়' মাতৃভাষা নয় তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমি মনে করি সরকার তার স্বপক্ষেই কাজ করছেন কারণ যে সব সংস্থা 'মাতৃভাষায় শিক্ষা' নিয়ে কাজ করছে সে সব সংস্থা এবং পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন ভাষার জনগোষ্ঠির প্রতিনিধি ও ভাষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গত ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারীতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সভায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত একটি ব্রিজিং পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। এই ব্রিজিং পরিকল্পনাটি মূলত শিশুরা কিভাবে মাতৃভাষার মাধ্যমে বাংলা শিক্ষার সাথে সেতু রচনা করবে যেন তারা অনায়াসে বাংলা ভাষায় দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে তা নিয়ে। এর ফলে ভাষা শেখার সাথে সাথে বিষয়ভিত্তিক পাঠেও তারা দক্ষতা অর্জন করবে ।

৫. সরকারীভাবে কোন জরিপ আজ পর্যন্ত হয়নি তবে বেসরকারীভাবে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ৪৫/৫০টি ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। সুতরাং কোন ভাষার কত জনগোষ্ঠী রয়েছে সরকারি পর্যায়ে করা জরিপ অত্যন্ত জরুরী ।

৬. আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি, পিইডিপি-৪, সবার জন্য শিক্ষা এবং জাতীয় পরিকল্পনাতে যে স্বীকৃতি দেয়া ও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা কার্যকরীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

৭. আদিবাসী ভাষা একাডেমি তৈরি করা যেতে পারে। যেখানে আদিবাসীর ভাষার গবেষণা, ভাষার মানদণ্ড এবং ভাষার বিভিন্ন বই প্রকাশ করা যাবে।

৮. যে সকল ভাষাভাষীর স্বল্পসংখ্যক জনগোষ্ঠীর এখনও জীবিত রয়েছে তাদের ভাষা সংরক্ষণ করা।

৯. পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় এবং জেলা পরিষদের মধ্যে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং সমন্বয় সাধন।

১০. স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেন তারা তাদের সংস্কৃতিকে লালন করতে পারে এবং পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছানোর জন্য বাহক হতে পারে।

১১. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ।

বিশ্বের  অন্যান্য  দেশের মতো বাংলাদেশেও আদিবাসী শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষা বাস্তবায়ন এগিয়ে যাচ্ছে। আশাকরি ক্রমান্নয়ে টেকসই উন্নয়ন ২০৩০ এর লক্ষ্য-৪ 'সকলের জন্য অন্তর্ভূক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা' বাস্তবায়নে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে ।