সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা: লাভ-ক্ষতির হিসেব নিকেশ

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 7 Jan 2012, 01:37 PM
Updated : 17 Feb 2020, 10:34 AM

বছর চারেক আগে যখন সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেছিলাম, সেই সময় বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অনেকেই ভেবেছিল, এই ধরনের ভর্তি পরীক্ষা আমাদের দেশে হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।

প্রশ্নফাঁসের আবহে সেই আলোচনায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাও ফাঁসের কবলে পড়ে হয় কি না সে বিষয়ে অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আর সেই ধারণা থেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে অনেকেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আবার কেউ কেউ সন্দিহান কিভাবে এই ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে তা নিয়ে।

নিন্দুকদের সেই সমালোচনার বেশকিছু জবাব ও ভর্তি পরীক্ষা কেমন হবে তার কাঠামোগত ধারণা নিয়ে ২০১৮ সালে ২৩ মে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কেন নয়? শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল।

খুব ভালো লেগেছে, আমাদের কাঠামোগত এই ধারণার কিছুটা হলেও বাস্তবিক প্রয়োগ দেখিয়েছে দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। গত শিক্ষাবর্ষে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ সাহসীকতার সাথে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করিয়েছে। আর সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগতে চাচ্ছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনুঘটকের ভূমিকা নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই সামিয়ানায় আনতে সক্ষম হয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে শুরু হতে যাওয়া সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা 'সম্ভবত' দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম কোনো দেশ যারা এমন দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারল।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষ নিয়ে আমরা যখন কথা বলছি, ঠিক তখনও এর বিপক্ষে বেশ আলোচনা চলছে। পত্র-পত্রিকায় বিশিষ্টজন এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কিংবা অনভিজ্ঞতার নিরিখে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন। কোথাও কোথাও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিলেরও ডাক এসেছে।

যারা এই আলোচনায় অংশ নিয়েছে তাদের একটি বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অন্যপক্ষ কিছুটা ভাসাভাসা ধারণা নিয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে মত দিচ্ছেন। আমি মূলত এই লেখাটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার হিসেব-নিকেশ কষতে পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।

প্রথমে আসা যাক, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে আসলে কোন কোন বিষয়টি আলোচনায় স্থান পাচ্ছে। সেই বিষয় নিয়ে যুক্তি খণ্ডন করা যাবে।

এক.

অনেকেই দাবি করছেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের '৭৩-এর অধ্যাদেশের পরিপন্থি। আর এই ধরনের ভর্তি পরীক্ষা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বেমানান।

– বিশ্ববিদ্যালয়ের '৭৩-এর অধ্যাদেশে ৪২ (১) বলা হয়েছে, Admission of students to the University in Honours Courses and Higher Degrees shall be made by an Admission Committee appointed for that purpose by the Academic Council.

একই ধারার ২ উপধারায় বলা আছে, The conditions under which students may be admitted to the diploma courses of the University shall be prescribed by the University Ordinances.অর্থাৎ একাডেমিক কাউন্সিলের প্রস্তাবনায় স্নাতক ভর্তি পরীক্ষা নেবে ভর্তি কমিটি। আর ভর্তির শর্তারোপ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ জারির মধ্য দিয়ে।

আর একাডেমিক কাউন্সিলের কাজ কি হবে তা এই অধ্যাদেশের ২৪তম ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, The Academic Council shall be the principal academic body of the University, and shall, subject to the provisions of this Act, the Statutes and the University Ordinances, have the control and general supervision over, and be responsible for maintenance of standards of, instruction, education and examination within the University, and shall exercise such other powers and perform such other duties as may be conferred or imposed upon it by the Statutes.

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের শিক্ষা ও পরীক্ষার মানদণ্ড নির্ণয় করতে পারবেন বলে একাডেমিক কাউন্সিলে বলা হয়েছে। সম্ভবত এই একটি লাইনের বাধ্যবাধকতায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্বতা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন অনেকে। কিন্তু আমরা হয়তো ভুলে গিয়েছি, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আমরা যতটা আলোচনা করেছি তার চেয়ে বেশি কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য উপাচার্যদের গত কয়েক বছর বেশ কয়েকবার তাগাদা মূলত তিনিই দিয়েছেন। আর তার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে অন্যরা।

যারা অধ্যাদেশ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাধিক ক্ষমতা কিন্তু আচার্যের হাতে রয়েছে। এই '৭৩-এর অধ্যাদেশের ১০ ধারার ২ ও ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, The Chancellor shall have such powers as may be conferred on him by this Act or the Statutes. Every proposal for the conferment of an honorary degree shall be subject to the confirmation of the Chancellor. সুতরাং রাষ্ট্রপতি চাইলে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছুই আইন হয়ে যেতে পারে তাতে 'সমন্বিত ভর্তি' পরীক্ষা একটি নজির হয়ে থাকবে। তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কখনোই '৭৩-এর অধ্যাদেশ পরিপন্থি হতে পারে না।

তাছাড়া বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসনের মুখ কখনো দেখেছে কিনা তা আমার জানা নেই। নিজেদের আয়ে নিজেরা চলতে পারে না। বেতন-ভাতাদি থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সব কিছুতেই সরকার ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো গতি নেই। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের সিদ্ধান্তে সরকারের একটি পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে। আর এই বৈশিষ্ট্যের কারণে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের সতীত্ব অনেক আগে খোয়া গেছে। আর আমাদের মত দরিদ্র দেশের মানুষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তান পড়িয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বেতন ভাতাদি দেবে তার মানসিকতা এখনো তৈরি হয়নি।

দুই.

অনেকেই বলছেন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে হয়তো কেউ কেউ অসুস্থ থাকার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে পারবে না যার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হারাতে হতে পারে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অসুস্থ হলে কেউ কেউ প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষায় পরবর্তীতে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে পারে। ফলে তার একটা সম্ভবনা থাকে।

এই আলোচনা অনেক দীর্ঘ হতে পারে। প্রতিটি জায়গায় অনিশ্চিয়তা তৈরি হতে পারে তাই বলে নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি না টেনে এর সমাধান দেয়া যেতে পারে। অসুস্থ থাকা দোষের কিছু নয়, তবে এই অসুস্থতার অজুহাতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি খারাপ তা বলার পক্ষপাতি আমি নই। দেখুন, সারা দেশে প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষাগুলো হচ্ছে, প্রতিদিন হয়তো কয়েকশ ছেলে-মেয়ে এই অসুস্থতার কারণে ২/১টি পরীক্ষা দিতে পারে না। যার ফলে তাকে পরের বছর পরীক্ষায় বসতে হয়। ঠিক একই নিয়ম, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় করা যায় কি না তার একটি আলোচনা হতে পারে। বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই তো দ্বিতীয় মেয়াদে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে না। এই নিয়মটি বজায় রেখেই যারা কেবল অসুস্থতার কারণে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারলো না, তারা পরের বছর ভর্তি পরীক্ষা দেবে। এক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় বসতে চাইবে। এই সমস্যার সমাধান নিমিষে মিলবে। অনেক সফটওয়্যার আছে, যারা কেবলমাত্র আইডেন্টিকাল বিষয় সহজে সনাক্ত করতে পারে। ধরুণ, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ইমরুল তুষার (ছদ্ম নাম) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করল। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার আগে হঠাৎ অসুস্থতা থাকার কারণে সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারল না। এখন ভর্তি পরীক্ষার দিন ইমরুল তুষারের একটি ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্স সফটওয়ারে জমা থাকল যে সে অনুপস্থিত। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে যখন সে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষায় আবেদন করবে তখন তার এইচ.এস.সি, এস.এস.সির সনদের তথ্য অনুযায়ী সফটওয়্যার দ্রুত তাকে শনাক্ত করবে যে সে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে অনুপস্থিত ছিল আর সেই তথ্যে তিনি চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাবেন। ঠিক একই পদ্ধতি অনুসরণ করে, প্রথমবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ভতিচ্ছুদের আবেদনের তথ্য সয়ংক্রিয় ক্রসচেকিং মাধ্যমে ধরে ফেলতে পারবে। আর এসব সফটওয়্যার তৈরি করা খুব একটা কষ্টকর হবে বলে আমি মনে করি না। আমার বিশ্বাস, এই পদ্ধতি যদি আমরা বিবেচনায় আনতে পারি তাহলে অসুস্থতার অজুহাত নিয়ে কেউ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিপক্ষে দাঁড়াতে পারবে না।

তিন.

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের মান নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ধাচের প্রশ্নপত্র করে সেখানে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেটা নাও করতে পারে। প্রশ্নপত্রের মান বিবেচনায় শিক্ষার্থীর মান বিবেচনা করা হয় বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

এই প্রশ্নের সঠিক জবাব হচ্ছে, যে শিক্ষার্থী রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় দেবে আর যে শিক্ষার্থী বুয়েটে দেবে তার উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসের তারতম্য আছে কি? যদি না থাকে তাহলে আমরা কেন বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য একই কাঠামোর প্রশ্ন করতে পারব না? কঠিন প্রশ্নের উত্তর যদি এক ঘণ্টার একটি পরীক্ষায় সমাধানের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠের জন্য মেধা যাচাই করা হয়, তাহলে আমি বলবো সেটা ভুল। প্রকৌশলে যারা ভর্তি পরীক্ষায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা গাণিতিক সমাধানের দিকে বেশি ঝুঁকলেও স্নাতকে ভর্তি হওয়ার পর ভর্তি পরীক্ষার এসব প্রশ্নের কাছে বাস্তবতা পরিবর্তন হয়ে যায়। পদার্থ, রসায়ন, গণিত নিয়ে কিছুটা কৌশলগত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রশ্নপত্রের মান নির্ণয় করতে চাইলেও সেটা স্নাতকে আদৌও কখনো কাজে আসে না। স্নাতকের পড়াশুনায় সেই এইচএসসির জ্ঞানটুকুই প্রয়োগ হয়। সুতরাং আপনি কতটা কৌশলগত প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণ ক্ষমতা নির্ণয় করলেন, সেটা মুখ্য বিষয় হতে পারে না। কারণ, স্নাতকে একজন শিক্ষার্থী কতটা মেধার বিকাশ করতে পারলো সেটাই মুখ্য বিষয়।  স্নাতক পড়াশুনা করার পর ভর্তি পরীক্ষার সেই বিষয়গুলোই তো ভুলতে বসি। গণিত-পদার্থ ভিত্তিক ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করে ফেলা শিক্ষার্থী রসায়নের সাধারণ সংকেতটুকু ভুলে যাই। অথচ ভর্তি পরীক্ষায় রসায়ন তাকে সমাধান করতে হয়েছিল।

তাছাড়া, যারা এই বিষয়ে কথা বলছেন তারা কি জানেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাশের হার কেমন? অনেক সময় তো দেখি, ভর্তির জন্য নির্দিষ্টি আসনের যোগ্যতার শর্তের চেয়ে পাশকৃতদের সংখ্যাই কম। অনেক সময় তো বিভাগগুলোতে আসন শূন্য থেকে যায়। সুতরাং ভর্তি পরীক্ষায় কাঠিন্য দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ে কণ্টকাকীর্ণ পথ অনুসরণ করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই।

চার.

ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সন্দেহ কারও কারও মনে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শঙ্কার কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের উৎসবের এই দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এত বড় আয়োজন হয়তো কিছুটা ম্লান করে দিতে পারে। এই আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। আমাদের অতীত ইতিহাস বলছে, এই দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় রয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের সদিচ্ছায় পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের রুটটাকে মনে হয় গলা চেপে ধরা হয়েছে। যে কারণে, বছর দুয়েক ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মিছিল রহিত হয়েছে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর প্রায় চার/পাঁচলাখ বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য যদি নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মিছিলের বাহিরে থেকে সফলতার সাথে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয় তাহলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় কেন সম্ভব নয়? কোন পথ দিয়ে প্রশ্নপত্র বের হয়, সেই পথটি যদি সরকার আগে থেকে বন্ধ করে দেয় তাহলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা এই ঝুঁকির আওতার বাইরে থাকবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর এই সফলতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করবে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকার ওপর।

পাঁচ

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার মত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে নেই বলে দাবি করা হলেও আমরা যে সেই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবো না তা কিন্তু নয়। এটা পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়। অভিন্ন প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য ব্যাপক অভিজ্ঞতা থাকতে হবে কিংবা ব্যাপক গবেষণা করতে হবে তা কতটা যৌক্তিক তা আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। দেখুন, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিশ্বে কেবল বাংলাদেশ একাই নিচ্ছে না। অনেক দেশ কেন্দ্রীয় পরীক্ষার মাধ্যমে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র ভর্তি করাচ্ছে। গেল বছর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একত্রে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। সুতারাং আমাদের অভিজ্ঞতা নেই  কিংবা আমরা পারব না বিষয়টি কিন্তু সেটা নয়। ছুতো দেখানোর অভ্যাস আমাদের রক্তে মিশে গেছে। মাঠে খেলতে না নেমেই পা ভাঙ্গার ভয়ে শোকাতুর হওয়ার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। এক ধাপে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম চালু রয়েছে চীন, জর্জিয়া, ইরান,  ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, আয়ারল্যান্ড ও মিশরে। বিশ্ব ব্যাংকের করা এক প্রতিবেদনে এমন কথাই বলা হয়েছে। এছাড়া উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল ও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোরের উপর ভিত্তি করে তানজিনিয়া এবং ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই কেবল উচ্চ মাধ্যমিক পাশকৃতদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ দেয় কানাডা, নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়। জাপানেও রয়েছে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা ও পাশকৃতদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। তাই টেকনিক্যাল বিষয়ে সহায়তা নেয়ার জন্য এই দেশগুলোর সাথে আমরা কোলাবোরেশন করতে পারি।

ছয়

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো, ভর্তি পরীক্ষায় অর্থোপার্জনে কিছুটা ভাটা পড়া। প্রতি বছর এই ভর্তি পরীক্ষার মৌসুমে অনেক শিক্ষক আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে মূল্যায়ন ও পরীক্ষার হলে দায়িত্ব গ্রহণে আর্থিক সুবিধায় টান পড়বে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতিতে। প্রতিবছর ভর্তি পরীক্ষার আয় থেকে শতকরা ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমার পর ৬০ ভাগই চলে যাচ্ছে শিক্ষকদের ঘরে। মূলত এই ভর্তি বাণিজ্যের প্রলোভন থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বের হতে পারছিল না। আমি জানি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে কেন তারা শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির কথা মাথাতেই রাখছে না। আজকে যারা শিক্ষকতা করছেন তারা কিন্তু সেই ভোগান্তির বেড়াজালের মধ্য দিয়েই ভর্তি হয়েছেন। সুতরাং তাদের যে সেই সময়ের খারাপ লাগা এখন কেন জাগে না তা তারাই বলতে পারবেন। তবে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার লাভ-ক্ষতির হিসেব কষলে আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তাতে কোনো সন্দেহ। একটি বৃহত্তর সার্থে আমরা অন্তত এক হই। ভর্তি পরীক্ষার সাথে বাণিজ্যিকরণের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। আপনাদের বেতন কিন্তু সরকারই দিচ্ছে। আর সেই বেতন কিন্তু জনগণের করের টাকায়। সুতারাং ভতিচ্ছুদের ভোগান্তি কমাতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার মত লাভজনক সিদ্ধান্ত আর দ্বিতীয় কোনোটি নেই।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা কেমন হবে, তার আউটলাইন নিয়ে আমরা আলোচনা করতেই পারি। আমার আগের লেখায় বেশ কিছু প্রস্তবনা তুলে ধরেছিলাম। সেগুলো নিয়ে আলোচনা আর করতে চাই না। তবে এক ধাপে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে হলে আমাদের কিছু নিয়মাবলীর 'অম্ল পরীক্ষা' করা যেতে পারে। আর সেজন্য দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সাথে বসা যেতে পারে। সব প্রস্তবনার সমন্বয় ঘটিয়ে একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার উপর নির্ভর করবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সফলতা-ব্যর্থতা। আমরা চাইব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি কার্যকরী রোডম্যাপ করাবে, যার এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে। সমস্যা থাকবে, সেটার সমাধান নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক নতুন যুগের সূচনা করবে। যার মধ্যে দিয়ে ভোগান্তি কেটে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্বস্ত্বির নিঃশ্বাস ফেলবেন।