শেখ হাসিনার সত্যভাষণ ও ভূমি সন্তান কাহিনী

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 7 Jan 2012, 12:52 PM
Updated : 16 Feb 2020, 10:52 AM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সত্যভাষী। কড়া কথা বলতেও পিছপা নন তিনি। যে যাই বলুক এই কারণে সবাই ভয়ও পায় তাকে। এই যে তিনি ইতালী সফরে ছিলেন সেখানে বাঙালিদের সমাবেশে একটি খাঁটি কথা বলে দিয়েছেন মুখের ওপর। তার কথা কি অসত্য? না উড়িয়ে দেবার মতো? ভেবে দেখুন তো এদেশকে যারা দীর্ঘ সময় ধরে বা একটা সময় ধরে শাসন করেছিল তারা কি আসলেই আমাদের মাটির সন্তান? তিনি যে তিনজনের নাম বলেছেন তাদের শাসনকাল আর সময়কাল বিবেচনা করলেই আপনি বুঝে যাবেন শেখ হাসিনা কতটা প্রাজ্ঞ।

বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বেশি ও অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এদের আমলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর ঘাতক উন্মাদেরা বেশিদিন টিকতে পারেনি। আমার মতে সবচাইতে ঘৃণ্য মানুষদের একজন খন্দকার মোশতাক। যিনি বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে গদীতে বসে। এবং তার সহকর্মীদেরও রাজী না হওয়ায় হত্যার নির্দেশ দেয়। আওয়ামী লীগ যতই লুকাছাপা করুক ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মীরজাফর এই মোশতাক। আমি তাদেরও ধিক্কার দেই যারা রক্তসাগর পেরিয়ে স্বাধীন দেশের সরকারের মন্ত্রী হবার পরও নিজেদের জানের মায়া ছাড়তে পারেননি। সবাই বলে আওয়ামী লীগের এইসব সিনিয়র নেতারা নাকি প্রাণভয়ে মোশতাক সরকারে যোগ দিয়েছিলেন। যদি তাই হয় প্রশ্ন করি জাতীয় চার নেতা ও পলাতক নেতাদের কি প্রাণের মায়া ছিলো না? তারা যদি জান দিয়ে ইতিহাসে অমর হতে পারেন আপনারা কেন পারলেন না? সবাই জানেন এমন কিছু পেশা থাকে যেখানে যোগ দিতে হয় প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে। আপনি সেনাবাহিনীতে কাজ করবেন আর জানের ভয়ে লুকাবেন তা যেমন হবে না রাজনীতি করতে এসেও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারেন না। অথচ তা-ই ঘটেছিল সে সময়। আর সবার ওপরে তক্কে তক্কে বসে ছিলো জিয়াউর রহমান। ইতিহাস বলে জিয়া একা না। তার সাথে ছিলো পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনী আর পেট্রোডলারের দেশগুলো।

জিয়াউর রহমানই প্রথম বাংলাদেশকে পাকি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার পথ খুলে দেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী করে আমাদের দেশের বারোটা বাজানো আর ছায়া পাকিস্তান গঠনের ষড়যন্ত্র সফল হবার আগেই বিদায় ঘটে তার। এরপর গদীতে আসেন এরশাদ। সেনাপ্রধান এরশাদ বিষয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো। জাতির কাঁধে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাপানো ছাড়াও জিয়াউর রহমানের পথ ধরে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ঠিক রেখে জয় বাংলার বিদায় নিশ্চিত করেন। এরশাদের আমলে শুরু হয় প্রশাসনিক পদ দখল। আর জিয়ার মত ভোটবিহীন নির্বাচন। দুনিয়ার দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো এরশাদ আসলে কার মিত্র আর কার দুশমন ছিলেন কেউ বুঝতো না। আমৃত্যু আমাদের রাজনীতিতে ভাঁড়ামি আর কথার বরখেলাপের মূর্তিমান এক অভিনেতা ছিলেন এরশাদ।

এরপর খালেদা জিয়া। দেশব্যাপী ভারত ও সংখ্যালঘু নামে পরিচিত অমুসলিমদের বিরোধিতা আর পাকি প্রেম সম্বল করে একাধিকবার গদীতে আসেন তিনি। আজ যে খালেদা জিয়াকে আমরা কারাগারে দেখছি সেটা তার আসল চেহারা না। এখন যতই বিএনপি কাঁদুক আর চোখের পানি নাকের পানি এক করুক খালেদা জিয়ার আমলে প্রকাশ্য রাজপথে গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করার মতো ঘটনা হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রকাশ্য মদদ আর অস্ত্র সরবরাহে সারাদেশে গজিয়ে ওঠা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাস করার লাইসেন্স দিয়েছিল তারেক জিয়া। সে বাংলাদেশ জীবনেও আর্থিকভাবে এই জায়গায় আসার কথা ছিলো না। বুকে হাত দিয়ে বলুন খালেদা জিয়া কি আসলেই পররাষ্ট্র বা বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি বুঝতেন? চুপ থাকা একটা গুণ হতে পারে তবে বোবা থাকা কোনো গুণ না। যে কারণে সাংসদ সুরন্জিত সেনগুপ্ত সংসদে মজা করে তাকে বলেছিলেন: একটা কিছু ক গোলাপী একটা কিছু ক।

এই তিনজনকে যদি বিচার করেন দেখবেন আসলেই তারা দেশ ও জনগণ নিয়ে খুব একটা ভাবিত ছিলেন না। যতটা ভাবেন শেখ হাসিনা। আজকের আওয়ামী লীগে ত্যাগী বা বলিষ্ঠ নেতার অভাব। আদর্শের ঘাটতি প্রকাশ্য। কিন্তু যদি শেখ হাসিনা না থাকতেন তবে কি হতো একবার অনুমান করুন। তিনি যে বললেন এরা ভূমি সন্তান না বলেই দেশ নিয়ে তেমন ভাবনা ছিল না কথাটা কি মিথ্যা? ইতিহাস কি বলে? উপমহাদেশে দেশভাগের পাপের জন্য মানুষ গান্ধী ও জিন্নাহকে দোষারোপ করেন। গান্ধীর ব্যাপারে ভূমি সন্তানের অভিযোগ না থাকলেও ছিলো সরলতার নামে আপসের অভিযোগ। যে কারণে তাকে গুলি করা হত্যাও করা হয়। অপরদিকে জিন্নাহর বেলায় আপনি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবেন মাটির সন্তান ছিলেন না বলে তিনি দেশভাগ নিয়ে একটুও বিচলিত ছিলেন না। সাতচল্লিশে রেডক্লিফ মিশনে মানুষের ঘর-বাড়ি, নদী-নালার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া সীমান্ত বাংলা আর পান্জাবকে দু টুকরা করে ফেলা কিছুই জিন্নাহকে আক্রান্ত করেনি, করেনি গান্ধীকেও। তখনকার মুম্বাই শহরে জিন্নাহ সাহেব যে বাংলোয় থাকতেন দেশভাগের ঠিক আগে সেখানে দেখা করতে এসেছিল একদল মুসলিম নেতা-কর্মী। তারা জিন্নাহর কাছে জানতে চাইলেন আপনি তো কাল পাকিস্তানে চলে যাবেন। আপনার বাংলো পদ সব তৈরি। আমাদের কি হবে? আমরা যে এতদিন দাঙ্গা ফ্যাসাদে প্রাণ দিলাম, মারলাম-মরলাম এখন আমাদের কি হবে? জিন্নাহ সাহেবের চোখে তখন তার ঘর-বাড়ি পদ পদবীর স্বপ্ন। তিনি নাকি দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে বলেছিলেন কি আর হবে? তোমরা এখন ভালো ভারতীয় হয়ে বাঁচবে। সবাই জানেন তার একমাত্র সন্তান দীনা জিন্নাহ কোনোকালে পাকিস্তানে এসে বসতি করেননি। আজীবন ভারতেই থেকে গেছেন। এমন কাণ্ড তিনি আমাদের সাথেও করতে এসেছিলেন। বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ করে ঘোষণা দিলেন 'ঊর্দু একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানেরা রাষ্ট্রভাষা'। এরপরের কাহিনী ইতিহাস।

ভূমি সন্তান না বলে আগন্তুকরা আদিবাসীদের মেরে তাদের সন্তান ছিনিয়ে নিয়ে বহুদেশে বসতি গড়েছে। আমাদের উপমহাদেশে মোঘলেরা তাজমহল বানালেও শিল্প কারখানা বানাতে আগ্রহী ছিলেন না। মোট কথায় মাটির টান না থাকলে মায়ের মত দেশকে ভালো না বাসলে মানুষ যা খুশি তা করতে পারে। আধুনিক সময়ে রোহিঙ্গাদের দেখুন। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধরা দীর্ঘকাল একসাথে বসবাস করেও যা করেনি তাই তারা করে অনায়াসে। বাঙালি মুসলমানের রক্ত ঝরাতেও পিছপা না তারা। কাজেই আপনি শেখ হাসিনার কথা না মানলে ইতিহাসে তাকিয়ে দেখুন জিয়াউর রহমান, এরশাদ আর খালেদা জিয়ার আমলে রাষ্ট্র কতটা নৃশংস ছিল কতটা আগ্রাসী ছিল সরকার? সবচেয়ে বড় কথা এই দেশের আকাশ দেখে বড় না হওয়া এদেশের নদীর পানিতে স্নান না করা মানুষ কিভাবে জানবে কাকে বলে মায়া? যারা আমাদের চাঁদ দেখে প্রেমে পড়েনি, আমাদের গান কবিতা সংস্কৃতিতে মজেনি তারা শাসক হলেও আসলেই কি আমাদের নাড়ীর টান বোঝে না বুঝতো?

তারপরও এরাই আমাদের শাসন করেছিলেন। ভালো-মন্দের সেই দিনগুলো ইতিহাসের হাতে। কিন্তু ধন্যবাদ জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা এই মাটির সন্তান। মাটির সন্তান ছিলেন সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদও। তাই তারা বাঙালি। তারা আমাদের প্রাণপুরুষ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে বাংলা-বাঙালির আদি অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িকতা মুক্তিযুদ্ধের অনাদি চেতনা আর বাঙালি জীবনবোধ চাই আমরা। ভূমি সন্তান বলেই আশা রাখি আপনি আমাদের এসব কিছুর নিশ্চয়তা দেবেন। যা এখন প্রায়শই হয় আক্রান্ত নয়তো তোপের মুখে।