আলিফ-লাইলা ১৮: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এ আসতে কী করণীয়?

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 7 Jan 2012, 12:55 PM
Updated : 15 Feb 2020, 12:20 PM

[পূর্বকথা: তথাকথিত চরিত্রহীনা এক বেগমের পরকীয়ার যারপরনাই নারাজ হয়ে হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করবেন এবং ভোর হলেই কতল করবেন এক রাতের সেই বেগমকে। কয়েক বৎসরে শত শত যুবতী বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালে ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি করুণাপরবশ হয়ে বোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে নিজে থেকেই বাদশা শাহরিয়ারকে নিকাহ করেন। জীবনের শেষ রাতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক দিনারজাদি শেরজাদিকে এক সওয়াল পুছেন: 'দিদি, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং-এ বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হয় না কেন?' শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না করে একের পর এক, কমবেশি ত্রিশটি কারণ বাৎলাতে শুরু করে দেন কিন্তু ভোরের আজান হওয়া মাত্র জওয়াব বন্ধ করে শুয়ে পড়েন। বাদশাহ যেহেতু বাকি কারণগুলো জানতে আগ্রহী, সেহেতু সপ্তদশ দিনের মতো মৃত্যুদণ্ড বাতিল হয় শেহেরজাদির। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের অষ্টাদশ এবং সর্বশেষ রাত্রি]

বিদেশিদের নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসারে আমরা কেন নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং বিচার করবো?- এমন প্রশ্নও উঠতে পারে দিদি।

অবশ্যই পারে দিনারজাদি। কিন্তু সেক্ষেত্রে র‌্যাংকিং-এর একটা মানদণ্ড বাঙালিদের নিজেদেরই নির্ধারণ করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যেরা গর্ব করে বলা থাকেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 'ঐতিহাসিক' ('অতি হাসিক' নয়) বিশ্ববিদ্যালয়, কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে যাবতীয় আন্দোলন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়েছে এবং পৃথিবীতে এটিই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেটি একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। সাধু সাধু! কিন্তু রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া কোনো বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে কি? মেডিকেলের পরীক্ষায় ফেল করে কোনো ডাক্তার যদি এই অজুহাত দেন যে, পরীক্ষাকেন্দ্রে আসার সময় রাস্তায় তিনি এক গর্ভবতী রমণীর সন্তান প্রসব করিয়েছেন, তবে সেই সুকৃতির জন্যে তাঁকে নিশ্চয়ই পাশ করিয়ে দেওয়া হবে না!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকপ্রতি ছাত্রসংখ্যা অত্যন্ত বেশি। অনেক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বসারই জায়গা হয় না। মাইক্রোফোন যত শক্তিশালীই হোক, শিক্ষকের গলা যত জোরালো হোক, এত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীকে মানসম্পন্ন শিক্ষাদান করা কি সম্ভব? কিন্তু এটাও ঠিক যে জনসংখ্যাই বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ এবং বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করার গুরুদায়িত্ব পড়েছে বাঙালি শিক্ষকদের উপর। সেক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষের পরিসর বাড়াতে হবে, বিদেশের অ্যামফিথিয়েটারের আকার দিতে হবে একেকটি শ্রেণিকক্ষকে।

আপাতত শুধু উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়তো যাবে না, একটা ভর্তিপরীক্ষা লাগবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রবাসে সিটসংখ্যার বেশি শিক্ষার্থী রাখা ঠিক হবে না, যদি আমরা চাই যে ছাত্রাবাসে প্রতিটি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করুক। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি বিছানা, একটি পড়ার টেবিল, চেয়ার ও বুকশেলফ অন্তত নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশে ছাত্রবেতন হতে হবে পরিবারের আয় অনুযায়ী। গরীব ও ধনী পরিবার এক অংকের বেতন দেবে না। ভর্তুকি তাকেই দিতে হবে ভর্তুকি যার দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে ভর্তি করতে পিতা, মাতা কিংবা অভিভাবকের টিন নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। কারিকুলামও বদলানো দরকার। প্রতিটি কোর্সের জন্যে আলাদা বেতন হতে পারে, আমেরিকার মতো। সব সেমিস্টারে সব সাবজেক্ট নাও থাকতে পারে। শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো বিভিন্ন সেমিস্টারে বিভিন্ন কোর্স পাশ করে ক্রেডিট সংগ্রহ করবে এবং প্রয়োজনীয় ক্রেডিট অর্জিত হলে ডিগ্রির জন্যে আবেদন করবে। সম্ভব হলে একজন শিক্ষার্থী একই সঙ্গে একাধিক ডিগ্রি করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ-মার্কা সিস্টেমে এটা চিন্তাও করা যায় না। এর কারণ কী? বলা হয়ে থাকে যে সেক্ষেত্রে ছাত্রনেতারা একের পর এক বিষয়ে ভর্তি হতে থাকবে। কখনও বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়বে না। শোভন-রব্বানী কি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছে? ষাটের দশকের নেতারাও কি একই আচরণ করতেন না?

বিশ্ববিদ্যালয় কাকে বলে? এটি মধ্যযুগের ইওরোপে সৃষ্টি হওয়া এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (রবীন্দ্রনাথের ভাষায়) 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির; জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি; পৌরুষেরে করে নাই শতধা… '- এ রকম একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে বাঙালি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু নয়, ভয় কখনই কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা উন্নয়নের ভিত্তি হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে প্রশ্নের জায়গা, সওয়াল-জওয়াব হবে। যতদিন সওয়াল-জওয়াব চলবে, ঠিক ততদিন পর্যন্ত আলিফ-লাইলার শেহেরজাদির মতো এর মৃত্যুদণ্ড স্থগিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্ন যারা করে, সবাই তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকায় সবাই। র‌্যাংকিং সংক্রান্ত পোস্টে কে লাইক দিচ্ছে বা মন্তব্য করছে সবকিছু ভালো করে খেয়াল করছেন আমাদের পূজ্যপাদ শিক্ষকেরা। হ্যাঁ, সরকার নয়, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা নয়, শিক্ষকেরা যারা ইতিমধ্যে সেল্ফ-সেন্সরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তারা। কোনো তরুণ শিক্ষক র‌্যাংকিং সংক্রান্ত কোনো পোস্টে লাইক দিলে বা মন্তব্য করলে তাকে শাসানো হচ্ছে: 'তোমার চাকরির কনফার্মেশন কিন্তু এখনও হয়নি, সাবধান!'

কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে অর্থ লেনদেনের অভিযোগও উঠেছে। অর্থের বিনিময়ে নাকি অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মান ও মন মানসিকতা মোটের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি বিশাল অংশ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, যুক্তিবিমুখ। একটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ফেসবুকে সম্প্রতি পোস্ট দিয়েছেন, "একটি বিশেষ ধর্মের প্রার্থনার আহ্বানের শব্দে নাকি একটি বিশেষ ফুল ফোটে। তিনি এও প্রচার করেন, মানবজাতির একমাত্র পিতা হচ্ছেন আদম এবং শ্রীলংকায় এক পাহাড়ে এখনও তাঁর পদচিহ্ন আছে।" এমন ধারা আচরণের সঙ্গে চাঁদে সাইদীর ছবি দেখা যাওয়া কিংবা তরমুজের উপর সৃষ্টিকর্তার নাম লেখা আছে দেখার তফাৎ কী?

এই পরিবেশ কি বদলাতে পারে না দিদি? জিগ্যেস করে দিনারজাদি। শেহেরজাদি উত্তর দেয়: না, পারে না। কারণ সরকার ও জনগণ চায় না এই পরিবেশ বদলাক। জনগণ মানে শিক্ষক, ছাত্র, আমরা সবাই। ছাত্রেরা রাজনীতি করে, কারণ তারা ক্ষমতা ও অর্থ চায়। ডাকসু নির্বাচন করার জন্যে ছাত্রনেতারা বার বার পরীক্ষায় ফেল করে, আবার ভর্তি হয়। স্বপ্ন: কোনো একদিন একেকজন ছাত্রনেতা জননেতা ফাটাকেষ্ট হবে। সরকার তাদের দিয়ে রাজনীতি করায়, কারণ সরকার নিজেকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। সরকারের সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার সব আছে, তবু ছাত্রদের দিয়ে গুণ্ডামি করানো অপরিহার্য সরকারের জন্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং ও বুলিং অর্থাৎ ক্ষমতার জোরে, প্রশাসনের প্রশ্রয়ে অসহায় শিক্ষার্থীদের শারিরীক ও মানসিকভাবে হেনস্থা করা নিত্যদিনের ঘটনা। যারা র‌্যাগিং ও বুলিং করে তাদের জিগ্যেস করলে তারা বলে: 'আমরাতো র‌্যাগিং করছি না, মজা করছি। এ রকমতো হয়। সবাই করে!' হায়! 'যাহা তোমার জন্যে খেলা, তাহা আমার জন্যে মৃত্যু!' অনেকে বলে, আমাদের সঙ্গেও সিনিয়ররা এসব করেছে। আমরা যখন সিনিয়র হবো, তখন আমরাও জুনিয়রদের এক হাত দেখে নেবো। চোখের জল শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের সাথী। অভিভাবকেরা অসহায়। অভিযোগ, প্রতিবাদ করতেও ভয়। কখন কী না কী হয়! অত্যাচারী শিক্ষার্থীদের একেকজনের চেহারা দেখলে মনে হবে, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এরা প্রত্যেকে ধর্ষকামী। শাস্তির গ্যারান্টি না থাকলে খুন করতেও এরা দ্বিধা করবে না, এবং তাও বিনা প্ররোচনায়, আবরারের খুনিদের মতো। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে দিনারজাদি, আবরারকে মেরে ফেলার পর খুনিরা জমিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখেছিল। কারও ইচ্ছা হয়নি, একটু ডাক্তার ডাকি, কিংবা বেচারাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই, এতটাই অমানুষে পরিণত হয়েছে এরা।

আবরারের যে জনাবিশেক খুনী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের অপেক্ষায় জেলে পচে মরছে, তাদের স্কুল ও কলেজ-শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, এই ছেলেগুলোর একজনও এমন অমানুষ ছিল না, বছর দুয়েক আগেও। বুয়েটে মাত্র দুই বছরে কী এমন হলো যে এরা একেক জন ভয়ঙ্কর খুনিতে পরিণত হলো? কে তাদের এই আশ্বাস দিল যে তারা যা খুশি করতে পারে, সাত খুন মাপ তাদের? নিজ নিজ গ্রামে এরা প্রত্যেকেই হিরো ছিল। এদের উদাহরণ দিয়ে বাবা-মায়েরা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতো। এখন রীতিমত নায়ক-সংকটে ভুগছে উত্তরবঙ্গের ওই গ্রামগুলো। 'সরকারী দল কিংবা সরকারকেই কি আপনি এর জন্যে দায়ী করেন?' বুয়েটের আবরার হত্যার তদন্তকারী দলের সদস্য যে শিক্ষককে আমি প্রশ্নটা করেছিলাম, তিনি কিছু না বলে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন হিরন্ময় নীরবতায়। লক্ষ্য করে দেখলাম, সেই শিক্ষকের ঘাড়ে সাকুল্যে একটাই মাথা।

বাঙালিদের মধ্যে একজনও কি নিজের স্বার্থ এক চুল ছাড়তে রাজি আছে? যদি না থাকে, তবে সরকারই বা তার স্বার্থ ছাড়বে কেন? সবই ক্রীড়া বইতো নয়। দাবা খেলার কথাই ধরো কেন, দিনারজাদি। কিস্তি কি কখনও বলতে পারবে যে আমি কোনাকুনি চলবো, কিংবা ঘোটক কি বলতে পারবে, আমি আড়াই ঘর যাবো না? তাহলেতো খেলাই বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারও 'রাষ্ট্র' নামক সতরঞ্জের একটি ঘুঁটি ছাড়া আর কিছু নয়, যদিও ভুল করে কদাচিৎ নিজেকে সে খিলাড়ি মনে করতেও পারে। সরকার চাইলেই কি সব অব্যবস্থার অবসান হতে পারে না? না পারে না। বাংলাদেশের সরকার প্রধান একবার মুখে ফুটে বলে ফেলেছেন: 'আমি চাই, সব গাড়ি ট্রাফিক লাইট মেনে চলবে!' কিন্তু গাড়ি চলে না, চলে না রে! গাড়ি ট্রাফিক লাইট মেনে না চলাতে যাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে, তারা সরকারের চেয়েও শক্তিশালী। কী জানি, কখন কে কোথায় কী করে বসে- এই অজানা ভয়ও ক্ষমতাকে তাড়িত করে বৈকি।

'নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।' ও বঙ্গেও অবস্থা তথৈবচ। দিনারজাদি, অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য সম্প্রতি এক কনফারেন্সে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। সেখানে গণ্ডায় গণ্ডায় উপাচার্য, ভবিষ্যতে উপাচার্য হবেন, হতে পারেন এমন অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত ছিলেন উভয় বাংলার। সেখানে কারও বক্তব্যে, বিশ্বভারতীর উপাচার্য, বিশেষত উভয় বঙ্গের দুই নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বক্তব্যে যুক্তি, জ্ঞান বা ভিশনতো দূর কী বাত, কাণ্ডজ্ঞানের ছাপও আছে বলে নাকি মনে হচ্ছিল না তাঁর কাছে। এমনকি দেবেশ রায়ের মতো সুলেখকও আবোল-তাবোল বকছিলেন। এক মিনিট বলার কথা, কিন্তু বক্তৃতার শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস চেইন টেনে থামাতে হলো। সেই সম্মেলনে মনে হচ্ছিল, যেন একেক জন অপোগণ্ড বালক কথা বলছে! এর অন্যতম কারণ, দলীয় নিয়োগ, কোটাভিত্তিক নিয়োগ। কথাটা অনেকেই বলছিল সেখানে। যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ পাচ্ছেন না দুই বাংলার কোথাও, দলীয় আনুগত্যের অভাবে।

না, হতাশাবাদী হবো না আমরা, দিনারজাদি। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মানতে হবে, তাদের ভিশন নেই, চিন্তার ক্ষমতা নেই এবং তারা মানসিকভাবে অসুস্থ, পশ্চাৎপদ, স্বার্থপর। তাদের একেকটি শিশুতোষ বক্তব্যেই এই অসুস্থতা ও পশ্চাৎপদতার প্রমাণ রয়েছে। কেউ সুস্থ হতে হলে তাকে আগে স্বীকার করতে হবে যে সে অসুস্থ। তারপরই তার চিকিৎসার প্রশ্ন আসবে, তার আগে নয়। অস্বীকার করি না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই এক দিন না এক দিন র‌্যাংকিং-এ স্থান পেতে হবে। র‌্যাংকিং অবশ্য এখানে মূল লক্ষ্য নয়। র‌্যাংকিং-এ স্থান পাওয়া মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান অব্যবস্থাগুলো দূর হওয়া। যদি আমরা চাই, তবে যে কারণগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং-এ স্থান পেতে বাধা, সেগুলো একে একে নয়- একবারে দূর করতে হবে।

এক বারে দূর করা সম্ভব এবং কাজটা সরকারকেই করতে হবে। বেড়ালটা অন্য কেউ নয়, জামাইকেই মারতে হবে, বিয়ের রাতে বা অন্য কোনো রাতে। জামাই মানে সরকার। রোমান স্থাপত্যে গম্বুজ তৈরি করা হয় পাথরের পাশে পাথর সাজিয়ে (সে যুগে লোহার কাঠামো ব্যবহার করা হতো না)। এর মধ্যে প্রধান একটি পাথরের নাম (ফরাসিতে) 'ক্লে দ্য ভুউত' বা 'গম্বুজের চাবি'। এই পাথরটি খুলে নিলে গম্বুজ ভেঙে পড়ে। আমাদের সমাজে সরকার হচ্ছে সেই গম্বুজের চাবি। প্রয়োজনে এই সরকারকেও যিনি 'না' বলার সাহস রাখেন, স্বার্থলীগ/স্বার্থদল, ধান্দাবাজ শিক্ষক-মোশাইদের 'খামোশ' বলার মতো মনোবল যাঁর আছে, এমন কোনো মেরুদণ্ডী উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ রকম ভদ্রলোক এখনও দুর্লভ নন, যারা কমবেশি লেখাপড়া জানেন, দলদাস নন, আবার সরকারি দলের জন্যে বিপদজনকও নন। একজন 'চির উন্নত মম শির' উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে সরকারপ্রধান তাকে এই শপথবাক্যটি পাঠ করাবেন: সকল গাড়ি ট্রাফিক আইন মানিয়া চলিবে- সবুজে চলিবে, হলুদে থামিবার প্রস্তুতি নিবে, লালে থামিয়া যাইবে। আইনভঙ্গকারী যেই হোক, আইন মোতাবেক তাহার শাস্তি হইবে।'

আমি নিশ্চিত, আইন নিজস্ব গতিতে চলতে শুরু করলেই অবস্থা অনেকটাই পাল্টাতে শুরু করবে। যে উপাচার্য নিজে মন-মুখ-ব্যবহারে দুই নম্বর নন, তাঁর সঙ্গে কেউ দুই নম্বরী করতে আসবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি একবার 'সুস্থ' হয়ে যায়, সারা দেশও হয়তো সুস্থ হতে শুরু করবে। মধ্যযুগের ইওরোপে তাই হয়েছিল। ঝিকে মারলেই বৌ শিখে যাওয়ার কথা। প্রিয় দিনারজাদি, আমার ব্যবস্থাপত্রটি আহামরি কিংবা অভূতপূর্ব কিছু নয়। যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আজ আমরা পৃথিবীর কোনো কোনো রাষ্ট্রে চর্চিত হতে দেখি, সেটি মধ্যযুগে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে চর্চিত হতো। এদিকে পুরো সমাজ নিমজ্জিত ছিল অন্ধকারে, রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল স্বৈরাচার, অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। মধ্যযুগের ইওরোপে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গণতান্ত্রিক সুশাসন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গিয়েছিল সমাজ ও রাষ্ট্রের আনাচে কানাচে। মাননীয় জননেত্রীর পাবারও কিছু নেই, হারানোরও কিছু নেই। তিনি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন, যদিও ব্যষ্টি যত শক্তিশালীই হোন না কেন, সমষ্টিকে বদলে দেয়া তার পক্ষেও যে কত কঠিন- সেটাও আমরা বুঝি বৈকি।

সরকারসহ সকল পক্ষের সদিচ্ছায় আলিফ-লাইলায় ইতিমধ্যে উল্লেখিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্রিশাধিক সমস্যা রাতারাতি সমাধান করা যে যাবে না সেটা পাগলেও বোঝে। শিক্ষার মান উন্নত করা সম্ভব হলেও গবেষণার মান কিন্তু সহজে বাড়ানো যাবে না। একটি জাতিকে গবেষণামনস্ক করে গড়ে তুলতে কয়েক শতকের সাধনার প্রয়োজন। এসব একদিনে হবে না। 'তিন তি বিনা নাহি গতি। সরস্বতী, প্রস্তুতি, গুরুভক্তি।' জ্ঞান হবে কি হবে না, সেটা সারস্বত ভাগ্যের ব্যাপার। তবে প্রস্তুতিটা আমরা ঠিকঠাকমতো নিতে পারি। দীর্ঘ সময়ের প্রস্তুতির ফলে একদল গুরু বা মেন্টর সৃষ্টি হলেও হতে পারে এই পোড়া বদ্বীপে। সেই সব গুরুর সঙ্গে একেকজন কমপ্যাটিবল শিষ্যের যুগলবন্দীর উপর নির্ভর করবে এতদাঞ্চলে জ্ঞান সৃষ্টি হবে কি হবে না।

যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন 'পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মতো' জ্ঞানচর্চা ছাড়া বাঙালিদের গত্যন্তর নেই। তবে কোথাও কোনো কাজ হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। বাংলা একাডেমির পুস্তককেন্দ্রে গিয়ে দেখো, দিনারজাদি, বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও সামাজিক বিজ্ঞানের হেন কোনো বিষয় নেই যে বিষয়ে বাংলাভাষায় লেখেননি বাংলাভাষী অনুবাদক-পণ্ডিতেরা। এই সব কাজের সঙ্গে একাডেমিয়ার যোগাযোগ ঠিকঠাকমতো হলে গবেষণা ও মননের সঙ্গে বাংলাভাষার অনেকখানি আত্মীকরণ ঘটতে পারতো।

[ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠলে এবং ভোরের আজান শোনা গেলে শেহেরজাদি কথা থামিয়ে দিলেন। ফজরের নামাজ পড়ে নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন দুই বোন প্রতিদিনের মতো, কিন্তু বাদশা শাহরিয়ার থামালেন তাদের। আঠারো রাত্রি ধরে বাদশা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং নিয়ে বেগম শেহেরজাদি ও শ্যালিকা দিনারজাদির সওয়াল-জওয়াব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এ স্থান না পাবার কারণ বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার জন্যে একজন শাসক হিসেবে ধন্যবাদ দিলেন তিনি বেগম শেহেরজাদিকে এবং সেইসঙ্গে শ্যালিকা দিনারজাদিকেও। র‌্যাংকিং নিয়ে আলোচনায় আর কিছু না হোক, শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড স্থগিত হলো, পরের দিন সকাল পর্যন্ত নয়, সারা জীবনের জন্যে। বাদশা শাহরিয়ার এবং বেগম শেহেরজাদি চুম্বনালিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিনারজাদি লজ্জায় রক্তিমানন হয়ে আনতমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশে। বাদশা তার গালটা একটু টিপে দিলেন। শ্যালিকা হিসেবে এটুকু আদর কিশোরী দিনারজাদির পাওনাই ছিল।]