‘বাছুর সাংবাদিকতা’ ও বইমেলার খবর

আনিসুর রহমান
Published : 14 Feb 2020, 12:28 PM
Updated : 14 Feb 2020, 12:28 PM

ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জুড়ে বইমেলার আগে ও পরে এই আয়োজন ঘিরে গণমাধ্যমের খবর পরিবেশনার ধরন ও ধারণ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই। তার পূর্বে আমার মনে কতগুলো প্রশ্ন খেলে যায়। তার একটা খতিয়ান দিব। আমি আশা করে থাকি বইমেলা বিষয়ে প্রতিবেদন করতে আসা একজন গণমাধ্যমকর্মী একজন লেখককে- সে নবীন হোক প্রবীণ হোক, বিখ্যাত আর অখ্যাত হোক- সব মিলিয়ে এই প্রশ্নগুলো করবেন:

১.  আপনি লেখেন কেন?

২.  আপনি না লিখলে বাংলা ভাষা সাহিত্যের এমন কী লাভ বা ক্ষতি হত?

৩.  আপনার লেখা একজন পাঠক কেন পড়বেন?

৪.  একজন পাঠক আপনার বই কেন কিনবেন? জনপ্রিয় লেখকের ক্ষেত্রে প্রশ্ন হতে পারে- আপনার লেখালেখি থেকে স্বচ্ছ এবং অস্বচ্ছ আয় কত?

৫.  আপনি লেখালেখির আয় থেকে নিয়মিত কর পরিশোধ করেন কি?

৬.  গত অর্থ বছরে আপনার আয়কর বিবরণী কী?

৭.  আপনার সম্পর্কে বা আপনার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কিছু কথা অসমর্থিত সূত্রে চালু আছে। বিষয়টি কি আপনি খোলাসা করতে চান?

৮. এই যে চারদিকে সামাজিক ও জাতিগত মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির অবক্ষয়। একজন ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এর দায় আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মেলার এক পর্যায়ে আমি এই প্রশ্নগুলো গণমাধ্যম কর্মীর কাছে শোনার অপেক্ষায় থাকি। তারা লেখককে ধরে ধরে প্রশ্ন করবেন:

কী কী বই কিনলেন? কোন ধরনের বই কিনলেন? কেন কিনলেন?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নানা পর্যায়ে লেখকেরা কিভাবে দিবেন তাদের ব্যাপার। তবে পাঠক হিসেবে আমি আগ্রহে থাকি পত্রিকার পাতা আর দূরদর্শনের পর্দা ছাপিয়ে এরকম প্রশ্ন উপজীব্য করে প্রতিবেদন ও সংলাপ পরিবেশন। কিন্তু তা আর হয় না। এমন অবস্থায় একটি প্রশ্ন মাথায় চেপে বসে। কবি হুমায়ুন আজাদ সাংবাদিককের প্ররোচিত করে একটি কথা বলতেন 'বাছুর সাংবাদিকতা'। কথাটি তিনি কেন বলতেন? এ নিয়ে গণমাধ্যমের কাউকে আপত্তি করতেও শুনিনি।

হুমায়ুন আজাদ শামসুর রাহমানকে প্ররোচিত করে একটি কথা বলেছিলেন। এই কথার পক্ষে বা বিপক্ষে আমার অবস্থান জাহির করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার কেবলই একটি প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন, হুমায়ুন আজাদ এরকম একটি কথা কেন বললেন? আমরাই বা তা চুপ থেকে সুবোধ মানবের মত মেনে নিলাম? এর উত্তর আমার জানা নাই। আমার আছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এবার হুমায়ুন আজাদের উক্তিটি উল্লেখ করা যাক- শামসুর রাহমান জানে না কার সঙ্গে পর্দায় যেতে হয় আর কার সঙ্গে বিছানায় যেতে হয়।

হুমায়ুন আজাদ গণমাধ্যমকর্মীদের অপরিপক্ক, অপেশাদারী আর প্রস্তুতির ঘাটতিকে কটাক্ষ করতেই এরকম পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছেন। তিনি বিগত হয়েছেন দীর্ঘ কয়েক বছর হয়ে গেল। আমরা হুমায়ুন আজাদের সেই বাছুর সাংবাদিকতার যুগেই কি রয়ে গেলাম? না কি আমাদের উন্নতি অবনতি কিছু একটা হয়েছে?

এবার একজন গণমাধ্যম কর্মীর মুখে একজন প্রকাশককে করা যে প্রশ্নগুলো শুনতে চাই, তা তুলে ধরি:

১.  আপনি প্রকাশক না হলে বাংলাদেশের বইয়ের জগতের এমন কি ক্ষতিবৃদ্ধি হত?

২.  বই বিক্রি না হলে আপনি এখনো টিকে আছেন কোন রহস্যের জোরে?

৩.  আর বিক্রি হলে প্রতি বছর কত টাকা লেখক সম্মানী  বাবদ দেন?

৪.  কত টাকা আয়কর পরিশোধ করেছেন?

৫.  বই প্রকাশের সঙ্গে জড়িত বই বাঁধাই থেকে শুরু করে বিক্রি ও বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি কর্মীকে যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায়সঙ্গত মজুরি প্রদান করেন কি না?

৬.  লেখক ও প্রচ্ছদশিল্পীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনা করেন কি না?

এগুলো নিতান্তই আমার আগ্রহ, একজন পাঠক হিসেবে। দিন যায়, মাস যায় বইমেলা শেষ হয়। আবার বছর ঘুরে বইমেলা আসে। এভাবে দীর্ঘ দশকের পর দশক যায়। আমি এই প্রশ্নগুলো ওনাদের মুখে শুনি না। তাহলে আমরা কী শুনি?

তার একটা তালিকা করা যাক-

লেখকের উদ্দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনপ্রিয় বা লেখালেখি কিংবা পদ ও পদবীর ভারে কোন মান্যবর বা মহামান্য লেখকের উদ্দেশে কতিপয় প্রশ্নগুলো এরকম:

১.  স্যার এবারের মেলা নিয়ে আপনার অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া কি?

২.  আপনার কয়টা বই বেরোল?

৩.  আমাদের বা পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলবেন স্যার?

৪.  নবীন লেখকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন স্যার?

৫.  একটা অটোগ্রাফ দিবেন স্যার?

৬.  আপনি কখন লিখেন স্যার?

৭.  আপনি কখন ঘুমান স্যার?

৮.  একজন লেখকের সমাজের প্রতি দায়িত্ব কি স্যার?

৯.  আপনি কি প্রতিদিনই মেলায় আসেন স্যার?

এরকই তো প্রশ্নগুলো কিছু একটু এদিক সেদিক করে। এখন আমার একটা মামুলি প্রশ্ন, এরকম প্রশ্নের বিপরীতে প্রদত্ত উত্তরে একজন পাঠক হিসেবে আমার কি যায় বা আসে?

এবার আসা যাক একজন প্রকাশককে একজন গণমাধ্যমকর্মী যে প্রশ্নগুলো সাধারণত করে থাকেন –

১.  আপনি কতগুলো বই প্রকাশ করলেন?

২.  জনপ্রিয় লেখকের কোন বই? উনি কি নিয়মিত আপনার স্টলে বসেন?

৩.  এবার মেলায় বিক্রি কেমন?

৪.  কার বই বেশি চলছে?

৫.  এবারের মেলা নিয়ে আপনার অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া কি?

৬.  বিক্রির দিক দিয়ে কে শীর্ষে? এরকমভাবে গৎবাঁধা ছকে গৎবাঁধা বাঁকে আমাদের বইমেলার প্রতিবেদন চলছে।

পাঠক হিসেবে আমরা মার খাচ্ছি ভাল বই আবিষ্কার, নতুন বা পুরাতন ভাল লেখক বা তার লেখাকে পাঠকের গোচরে আশানুরূপভাবে আনা হচ্ছে না। বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণধর্মী বা অনুসদ্ধানধর্মী লেখালেখি হচ্ছে না কেন?

অনুবাদের বই কী প্রকাশ পেল? কোন বইয়ের ভেতরে কী আছে? এমনতরভাবে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রবন্ধ, গবেষণা, শিশু  ও কিশোর উপযোগী বই নিয়ে প্রতিনিয়ত কতরকম লেখা আমরা পেতে পারি। আমার কেবলই মনে হয় একটা ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে প্রতিবেদনগুলোতে মেধা ও আন্তরিকতার যে ছোঁয়া আমরা পাই, বইমেলার প্রতিবেদনে সে ছোঁয়া কেন পাই না?

প্রসঙ্গক্রমে আরো একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই। আমাদের খেলার পাতাগুলোর লেখালেখিতে যে সাহিত্যমান থাকে শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকীগুলোর লেখালেখিতে সে সাহিত্যমান নাই কেন?

আমাদের গণমাধ্যমের বন্ধুরা কেন এত বেশি পদ ও পদবীধারীদের পেছনে দৌঁড়ান। তাদের বইয়ের ছবি, তাদের ছবি ও কথা এত বেশি বেশি কেন ছাপেন? ইদানিং যোগ হয়েছে কর্পোরেট আপদ। কর্পোরেট অন্দরের লেনদেনে কোন কোন কর্পোরেট লেখকদের অখাদ্যা লেখার প্রচারও প্রসারে পাঠকের উপর নির্যাতনের এরকম নিলর্জ্জ মাত্রা দুনিয়ার কোথাও কী আছে? বড় বড় কয়েকটি কাগজ আবার সিন্ডিকেটভুক্ত প্রকাশক ও লেখকদের মাত্রাতিরিক্ত প্রাধান্য দিয়ে পাঠকের দরবারে বিরক্তি ফেরি করতেছেন। এরকম উদাহরণও কম নয়। তারপর অখাদ্য বইয়ের আলোচনা ছাপানোর জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় তেলপানি খরচের উদাহরণও কম নয়। এই ধারা একে একে পুরস্কার পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। ভোটে তাৎপর্য না থাকলে ভোটার যেমন ভোট দিতে যান না, তেমনি এরকম পুরস্কারের লহর ও প্রকাশনার বহরেও পাঠকের কিচ্ছু যায় আসে না। কেবল বিরক্তিই সার।

তারপরও কত যে সামন্তবাদী চিত্র বইমেলা ঘিরে আমরা দেখি। প্রশ্ন আরো আছে- বইমেলায় রাজনৈতিক দলের জন্যে স্টল বরাদ্দ কোন নীতিমালা অনুসারে? হ্যা এবার যেহেতু 'মুজিবশতবর্ষ' তাই নির্দিষ্ট কর্নার করে নির্র্দিষ্ট নাম দিয়ে সেখানে আগ্রহী রাজনৈতিক দল বা সংগঠন স্টল বরাদ্দ নিতে পারে। কেবল আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা স্বেচ্চাসেবক লীগ নয়। এর জন্যে নির্দিষ্ট ঘোষণা ও ব্যাখ্যা থাকতে হবে। গণমাধ্যমের বন্ধুরা এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন বা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে কেন ব্যর্থ হলেন?

একজন মন্ত্রী, একজন তারকা বইমেলায় আসলে সেটা কেন খবর হবে? তার সংবাদ গুরুত্ব কী? সে দিকটা কি আমাদের গণমাধ্যমের বন্ধুরা খতিয়ে দেখেন? একজন আমলা কোন বিবেচনায় বইমেলায় প্রটোকল নিয়ে ঘুরেন?

একজন ক্রিকেটার বইমেলায় এলে খবরের বন্ধুদের নড়চড় কেন বাড়বে? এরকম হাজারও প্রশ্ন, হাজারও অসঙ্গতি। তারপর আবার অতিরিক্ত মাত্রায় সংখ্যানির্ভর প্রতিবেদন। বইমেলার আয়তন বাড়ল বা কমল, স্টলের সংখ্যা, বই প্রকাশের সংখ্যা- সংখ্যার এত এত উপস্থিতি। তাতে পাঠকের কী লাভ হয়? আর সংখ্যা নিয়ে টানাটানিটা বইমেলা শুরুর প্রায় এক মাস আগে থেকেই আরম্ভ হয়। এবার অন্যান্য দেশে যে সবক্ষেত্রে প্রশংসনীয়ভাবে বইমেলা নিয়ে গণমাধ্যম দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করে তার একটা চিত্র দেওয়া যাক।

বইমেলায় মূলধারার প্রতিটি কাগজ বা দূরদর্শন বা বেতার নিজস্ব স্টল বরাদ্দ নিয়ে নিজস্ব মঞ্চ নির্মাণ করে সেখান থেকে লেখকদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ ও সাক্ষাৎকার প্রচার করে। সেখানে কী নিজ নিজ গণমাধ্যমের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রায় পুরো কর্মী দল বইমেলা ঘিরে দায়িত্বপালন করে, সেই সঙ্গে একদল অতিথি লেখকও তাদের সঙ্গে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি।

ধরুন, বইমেলার ভেতরে বাংলাদেশ বেতারের একটা নিজস্ব মঞ্চ থাকল। সেই মঞ্চ থেকে কবি নির্মলেন্দু গুণ মহাদেব সাহার নতুন বই নিয়ে একটি সংলাপ করলেন। সামনে একদল তরুণ কবিও প্যানেলভূক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন। এটা সরাসরি বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হল। পরের দিন দুই একটা কাগজে তার বিস্তারিত ছাপা হল। ব্যাপারটা কেমন হবে? আমরা তো কল্পনা করতেই পারি। একইভাবে কবি আলফ্রেড খোকন, কবি টোকন ঠাকুরের সঙ্গে তাদের নতুন বই নিয়ে সংলাপ করলেন। ব্যাপারটা কি দারুণ হবে না? আমাদের গণমাধ্যমের বন্ধুরা কী ভাবেন?

একটি পশ্ন উত্থাপন করে লেখাটি শেষ করছি। হুমায়ুন আজাদ আমাদের সাংবাদিকতার আর খবর প্রচারের নানা অসঙ্গতি, অপরিপক্কতার বাড়াবাড়ি আর উদ্ভাবন ক্ষমতার ঘাটতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই 'বাছুর সাংবাদিকতা' বলেছিলেন। আমরা এখন কিীবলব?