সংযমের সংস্কৃতি

মুহম্মদ নূরুল হুদামুহম্মদ নূরুল হুদা
Published : 19 August 2012, 02:34 AM
Updated : 19 August 2012, 02:34 AM

মানুষের জানা ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শব্দসমূহের একটি যদিও সংযম, সবচেয়ে চর্চিত ও আদরণীয় শব্দের একটি অবশ্যই অসংযম। তাই যুগে যুগে ধর্মবিদ, তত্ত্ববিদ, দর্শনবিদসহ মানবসমাজের জন্য তাবৎ হিতকর চিন্তকরা মানুষকে সংযমের কথা বলেছেন, আর তার চর্চার জন্যে নানাবিধ পদ্ধতি বাৎলে দিয়েছেন। স্বেচ্ছাধীন মানুষ সেগুলো শুনেছে, পড়েছে, চর্চা করেছে, কিন্তু প্রায়ক্ষেত্রে অমান্য বা অগ্রাহ্য করাটাকেই বীরত্বের কাজ মনে করেছে। ফলে সংযম নয়, অসংযমই মানুষের চিত্তবৃত্তির প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে তাই বলে মানুষ যে সংযম চর্চার প্রদর্শিত নানা পদ্ধতিকে সর্বাংশে পরিত্যাগ করেছে এমন নয়। বরং তা থেকে আপন আপন ফায়দা আদায়ের নানা কৌশল রপ্ত করেছে তারা; আর এইসব কৌশল প্রয়োগ করে সমাজে লোকদেখানো বাহবা কুড়ানোর কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। যতই দিন যাচ্ছে, স্বেচ্ছাচারে তৃপ্ত মানবমানবী ততই এই পদ্ধতিকে অপপ্রয়োগের নতুন নতুন ছলাকলা আবিষ্কার করছে। বলা বাহুল্য, তেমন একটি পদ্ধতির নাম ইসলাম ধর্মের আওতায় প্রবর্তিত রোজা বা সিয়াম সাধনা। বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা এটি একদিকে যেমন চর্চা করে, অন্যদিকে তেমনি সমান তালে অপ্রয়োগও করে।

স্বীকার্য, পুরো রমজান মাস জুড়ে সারা বিশ্বের মুসলমানরা এই সিয়াম সাধনার সঙ্গে কোনো-নাকোনোভাবে যুক্ততা প্রদর্শন করে; তারপর তারা রোজার শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে ঈদের আনন্দোৎসবে মিলিত হয়। আনন্দোৎসবের মধ্যে নতুন জামাকাপড় পরিধান করা, ফিতরা আদায় করা, সুগন্ধিযুক্ত খুশবু-আতর মাখা, পরম শানশওকতের সঙ্গে ঈদগাহে গিয়ে ঈদ-উল-ফিতরের নামাজ আদায় করা, জাকাত আদায় করা, পরস্পর কোলাকুলি করা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

আর সমাজের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্তরে, যেমন দলীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঈদের রিসেপশন বা অভ্যর্থনামূলক সম্মিলনীর ব্যবস্থা করাও একটি জনসংযোগমূলক আচারে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি আরেকটি বিশেষ সামাজিক রীতি হচ্ছে, বন্ধুবান্ধবী এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে শত্রুকেও ঈদের শুভেচ্ছা পাঠানো। যেমন, আমাদের দেশে সরকার ও বিরোধী দলীয় প্রধানের মধ্যেও এই শুভেচ্ছা বিনিময়ের একটি ইতিবাচক রীতি প্রচলিত হয়েছে, যদিও বছরের প্রায় ৩৬৫ দিন তারা ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ বা বাক্যবিনিময় না করার সংযম (?) প্রদর্শন করে থাকেন। এই শুভেচ্ছা বিনিময়ের খবর দেশের সব প্রচার মাধ্যমে অতি গুরুত্বের সঙ্গে, কখনো কখনো ব্রেকিং নিউজ আকারে প্রচারিত হতে দেখা যায়। এতে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষ যেমন তৃপ্ত হয়, তেমন মজাও পায়। হঠাৎ মনে হয়, দেশে তাহলে সুবাতাস বইবে। আহা, যদি প্রতিদিন ঈদের দিন হতো, প্রতিদিন যদি এই ধরনের শুভেচ্ছা বিনিময় হতো, প্রতিদিন যদি …। না, আর এই যদি-টদি বাড়িয়ে লাভ নেই। আসলে লাভ যে আমাদের কিসে সেটি আমাদের কারো কাছে এখনো খুব স্পষ্ট নয়।

ফিরে আসা যাক সংযমের সংস্কৃতি হিসেবে সিয়াম সাধনার কথায়। এই সাধনার প্রধান রূপ দুটি: একটি শারীরিক, অপরটি আত্মিক। শারীরিক দিকটি হলো পুরো রমজান মাস জুড়ে সেহরীর সময় থেকে (ফজরের আজানের পূর্বমুহূর্ত থেকে) সূর্যাস্তের পর ইফতারের সময় (মাগরেবের নামাজের পূর্বক্ষণ) পানাহার, যৌন সংশ্রব, ভোগলীলাসহ যাবতীয় শরীরী অজাচার থেকে বিরত থাকা। আর আত্মিক দিকটি হলো, ধর্ম-নির্দেশিত নামাজ-দোয়া ইত্যাদি আদায় করা, সর্বক্ষণ পাক-পবিত্র থাকা, অবাঞ্চিত ও অহেতুক কথাবার্তা না বলা, নিজের মনকে সকল প্রকার পাপাচার থেকে বিযুক্ত রাখা ইত্যাদি। চিকিৎসা, বিদেশ ভ্রমণ, অতিবার্ধক্য ইত্যাকার ব্যতিক্রম বাদে প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মুসলমানকেই এই শারীরিক ও আত্মিক সংযম পালন করতে হবে। এটি তার জন্য ফরজ, অর্থাৎ বাধ্যতামূলক। বোঝা যাচ্ছে, মানুষ যে মূলত অসংযমী সেই যুক্তিটি গ্রাহ্য করেই মানুষকে সংযমের মধ্যে নিয়ে আসার জন্যে এই ধর্মীয় রিচুয়াল বা আচারের প্রবর্তনা। বলা হয়েছে, এই রিচুয়াল পরিপূর্ণভাবে যে ব্যক্তি পালন করে না, তার জীবনে ঈদের আনন্দপূর্ণ তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয় না। এটি কোথাও কোথাও চরম কঠোরতার সঙ্গেও পালিত হয়ে থাকে। আমি শৈশবে দেখেছি আমাদের পাড়ার ঈদের জামাত থেকে বে-রোজদারদের শনাক্ত করে ধরে ধরে বের করে দেয়া হচ্ছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অপরাধীর মতো ঘাড় কাৎ করে বিনা প্রতিবাদে বের হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সংযমের সাধনা না করে সংযমোত্তর আনন্দের অংশিদার হওয়ার অধিকার কারো নেই।

তবে কালে কালে আধুনিক শিক্ষা ও প্রতীচ্যের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে এই কঠোরতা হ্রাস পেয়েছে। এখন শহরে বন্দরে, এমনকি গ্রামেও রোজা রাখা না-রাখা আর ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করা নিয়ে কেউ আর তেমন মাথা ঘামায় না। বলা যেতে পারে, অসংযমী মানুষের মুক্ত জীবনাদর্শের কাছে ধর্মের আচার-বাহিত সংযম সাধনা মার খেতে শুরু করেছে। এটি ভালো কি মন্দ সে-ও এক প্রয়োজনীয় তর্ক বটে।

কিন্তু এর তো কারণ আছে অবশ্যই। তবে সে কারণ এক নয়, একাধিক। আর প্রধান কারণ এই যে, ধর্ম আর স্থির কোনো আচার-আচরণে বন্দী নেই, বরং সেই আচার-অচরণকে নিজের মতো করে পুনর্বিন্যাস করাই নতুন যুগের নতুন মানুষের সাধনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাইতো রোজার দিনে প্রকাশ্যে খাবার দোকান বন্ধ থাকলেও, অন্যদিকে পর্দার আড়ালে আলবৎ পানাহার চলে। আর সবচেয়ে গ্রাহ্য আচার হচ্ছে ইফতারের সংস্কৃতি। রোজা রাখি বা না-রাখি ইফতার করা চাই। ঘরে, কর্মস্থলে বা যানবাহনে, যিনি যেখানেই থাকুন না কেন, মাগরেবের আজানের পর ইফতার করা একটি প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রত্যেক অফিসে সকলের জন্যে বিনামূল্যে বা ভর্তুকি দিয়ে ইফতারের ব্যবস্থাও প্রচলিত হচ্ছে। এটিকে সংযমের সংস্কৃতির চেয়ে বরং সম্প্রীতির সংস্কৃতির বলাই ভালো। সংযম ও সম্প্রীতি খুবই নিকট সম্পর্কযুক্ত। সম্প্রীতির এই ব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সারা বছর চালু থাকলে লাভ প্রায় সকলেরই। তবে মালিক পক্ষ এত রাজি হলেই হয়।

আগেই বলেছি, যে সংযমের শিক্ষা ইসলাম দিয়েছে, তা আর হুবহু গ্রাহ্য হচ্ছে না। গ্রাহ্য হচ্ছে না ইসলামের অন্য সব বিধানও। ধর্মাচার ও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিথিলায়ন বেড়েই চলেছে। এই বাংলাদেশে বা বিশ্বজুড়ে যারা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে জন্মসূত্রে মুসলমান নামে অভিহিত, তাদের অধিকাংশই ইসলামের আবশ্যকীয় শর্তাদি পালন করে না। কেবল জন্ম, বিবাহ, তালাক, জানাজা, আর কাফন-দাফনের সময়েই অধিকাংশ ধর্মীয় রীতিনীতি সীমবিদ্ধ থাকছে। সারাজীবন ধর্মের বিরোধিতাকারী নিরীশ্বর বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রেও সচরাচর এর ব্যতিক্রম ঘটছে না ।

আবার যারা ধর্মের সব ফরজ আদায়ে বাহ্যিকভাবে তৎপর, কিন্তু ধর্মের হিতকর আচরণ থেকে বিযুক্ত, তাদেরকেও যথাযথ ধর্মাচারী বলা যাবে না। যারা ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছে, তারাই মূলত এই গোত্রভুক্ত। এখন বিশ্বব্যাপী ক্ষমতারোহণের এক অবিকল্প পদ্ধতি রাজনীতি। আমাদের মতো দেশে রাজনীতি মূলত স্বার্থবাহিত কূটনীতি, মিথ্যাচার, বাগাড়ম্বর, অসহিষ্ণুতা, ষড়যন্ত্র ইত্যাকার নানাবিধ কূটচাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে যারা একদিকে ধর্মাচারী তথা ধর্মের লেবাসধারী, আবার ক্ষমতারোহণের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত, তারা ধর্মাচারের সঙ্গে রাজনীতির অজাচারকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক পরিচয়ে ধর্মের ইতিবাচক সাধনা থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়েছে। তারাও এখন ধর্মদ্রোহীদের মতো সমান অধর্মাচারী। আর তেমন অধর্মাচারীদের মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর আততায়ী স্বদেশী দোসর বা স্বাধীন বাংলাদেশে তাদেরই উত্তরসূরী ঘাতকচক্র। এরাও ধর্মের অপরাপর আচারের পাশাপাশি সিয়ামের সংযমী আচরণ থেকে আত্মিকভাবে বিযুক্ত। সংযমের শর্তে যারা শারীরিক আচার থেকে বিযুক্ত, তাদের সঙ্গে যারা আত্মিক আচরণ থেকে বিযুক্ত, তাদের কোনো গুণগত তফাৎ নেই। এই ফ্যালাসি থেকে মুক্তির একমাত্র পথ যথাসম্ভব কর্মে ও ধর্মে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কেবল রোজার মাসে ওমরাহ পালন বা মোরাকাবাহ করেই আমাদের সমাজপতি আর রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা নিজের জীবনে ও জাতির জীবনে এই সংযমের বাস্তবায়ন করতে পারবেন না; তার জন্যে চাই পাস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার আমূল পরিবর্তন।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিবর্তন কি আমরা চাই? আমরা যারা ধর্মের আশ্রয়ে স্বস্থ নই, কিংবা যারা স্বস্থ, আমরা যারা রাজনীতি করি কিংবা করি না, আমাদের সকলকেই তো এক ধরনের সদাচারী সংযম ও সম্প্রীতির সংস্কৃতির মধ্যে প্রবেশ ও বসবাস করতে হবে। অবিশ্বাস ও অসংযম নয়, সেই সংযম ও সম্প্রীতির সংস্কৃতিই হবে আমাদের আরাধ্য গণতন্ত্রেরও অন্তর্নিহিত শক্তি। ধর্মাচারে যা-ই হোক, অন্তত বাঙালির কর্মাচারে প্রতিফলিত হোক এই শুদ্ধাচারী ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সংযম।
১৮.০৮.২০১২

মুহম্মদ নূরুল হুদা: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।