নতুন করোনাভাইরাস কতটা বিপজ্জনক?

রজিউদ্দীন রতন
Published : 29 Jan 2020, 12:48 PM
Updated : 29 Jan 2020, 12:48 PM

সবার আগে নামের বিভ্রান্তি দূর করা প্রয়োজন। "নোভেল" অথবা "নভেল" কোনটাই আলোচিত করোনাভাইরাইস-টির নাম নয়। ইংরেজি novel শব্দটি "অনন্য" অথবা "নতুন ধরন" বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত এই ভাইরাসের একটি গ্রহণযোগ্য নাম স্বীকৃত না হচ্ছে ততদিন এটার পরিচয় "২০১৯ সালে উহানে প্রথম সংক্রামিত হওয়া নতুন ধরনের করোনাভাইরাস"। আগে ভাইরাসের (এবং ভাইরাসজনিত রোগের) নাম সেটি প্রথম সংক্রমণের অথবা আবিষ্কারের স্থানের নামে রেখে দেয়ার প্রচলন ছিল (যেমন ইবোলা ভাইরাস)। এরকম এখন অনুৎসাহিত করা হয়। সেইজন্য ভাইরাসটির নাম উহান ভাইরাস অথবা উহান করোনাভাইরাসও নয়।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, "2019-nCoV" এই ভাইরাসের অন্য একটি নাম নয়। বরং আপাতত চালিয়ে নেওয়া নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। সাল তো দেখে বোঝাই যাচ্ছে, n = নভেল, আর CoV হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্ষিপ্ত রূপ। ভাইরাসের নাম এরকম সংক্ষিপ্ত করে ফেলার প্রচলন রয়েছে। বিশেষত লম্বা নামের ভাইরাসের ক্ষেত্রে। যেমন নরোভাইরাস হচ্ছে NoV, হেপাটাইটিস এ ভাইরাস হচ্ছে HAV আর হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস হচ্ছে HIV ।

গত ২০ বছরে মূল পোষক প্রজাতি থেকে অন্য পোষকে ছড়িয়ে পড়া এটি তৃতীয় করোনাভাইরাস। প্রথম দুটি সকলের জানা, সার্স এবং মার্স করোনাভাইরাস। এই বিষয়টি আলাদা করে বলার কারণ হচ্ছে, ভাইরাস সাধারণভাবে পোষক নির্দিষ্ট। তারমানে, যে ভাইরাস পাখির রোগ বাধায় সে মাছের রোগ বাধায় না। আবার যে ভাইরাস কুকুরের রোগ বাধায় সে বিড়ালের কোন ক্ষতি করেনা। অন্যদিকে ভাইরাসের অসাধারণ ক্ষমতাগুলোর একটি হচ্ছে তারা দ্রুত নিজেকে বদলে নিতে পারে। সেইজন্য এক প্রাণীকে আক্রমণ করা ভাইরাস নিজেকে বদলে নিয়ে অন্য প্রাণীতে সংক্রামিত হতে পারে।

ভাইরাস যেমন নিজেকে বদলে নিয়ে এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে সংক্রমিত হতে পারে, তেমনি একটি কম সংক্রামক ভাইরাস নিজেকে বদলে নিয়ে বেশি সংক্রামক হয়েও উঠতে পারে। ভাইরাস যত বেশি সংক্রামিত হয়, তার নিজেকে বদলে নেওয়ার সম্ভাবনাও তত বেড়ে যায়। ২০০৩-০৪ সালে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়া সার্স করোনাভাইরাস যেমন নিজেকে বদলে নিয়ে বেশি সংক্রামক হয়ে উঠেছিল। বর্তমানের নতুন করোনাভাইরাসের ভেতর এরকম পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব বেশি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, করোনাভাইরাস একটি আরএনএ ভাইরাস। আরএনএ ভাইরাসের মিউটেশন বেশি হয়।

সার্স এবং মার্স করোনাভাইরাসের প্রধান বাহক বাদুড়। যদিও সরাসরি বাদুড় থেকে ভাইরাস দুটি মানুষে সংক্রামিত হয়নি। মানুষের মাঝে সার্স করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে গন্ধনকুল বা ভোঁদড়-জাতীয় প্রাণী থেকে। মার্স করোনাভাইরাস মানুষে সংক্রামিত হয়েছে উট থেকে। উহানের নতুন করোনাভাইরাসটির সঙ্গে বাদুড়ের করোনা ভাইরাসের অনেকটা মিল রয়েছে। সেইজন্য এখন পর্যন্ত ধারণা করা হচ্ছে ভাইরাসটি মানুষে সংক্রামিত হয়েছে বাদুড় থেকে অন্য কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাধ্যমে।

ভাইরাস কতটা সংক্রামক তা প্রকাশ করা হয় তার R0 (আরনট) সংখ্যা দিয়ে। কোন ভাইরাস যদি একজন ব্যক্তি থেকে গড়ে ২ জন সুস্থ ব্যক্তির ভেতর ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাহলে সেই ভাইরাসের R0 হবে ২। যেসব ভাইরাস ক্রমশ বেশি ছড়িয়ে পড়ে সেসব ভাইরাসের R0 হয় একের থেকে বেশি। আর যেসব ভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমশ কমে (বা থেমে) যায় সেসব ভাইরাসের R0 একের থেকে কম। আবার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভাইরাসের R0 বদলে যেতে পারে। ২০১২ সালে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া মার্স করোনাভাইরাসের R0 ছিল একের থেকে কম। আবার হাসপাতাল থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণের সম্ভাবনা (nosocomial infection) একের থেকে বেশি (R0 = ২-৫)। সেজন্য মার্স করোনাভাইরাসের মহামারীর মূল কারণ ছিল হাসপাতাল-কেন্দ্রিক সংক্রমণ। সেই ছাড়া, মার্স করোনাভাইরাস ভাইরাস বিলুপ্ত না হলেও এটি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েনা।

অতি সংক্রামক হামের R0 হচ্ছে ১২-১৮, ইবোলা ভাইরাসের ১-২, গুটি বসন্তের ৩.৫-৬, আর সাধারণ সর্দি জ্বরের (ইনফ্লুয়েঞ্জা) ১.২-১.৪। সার্স করোনা ভাইরাসের R0 ছিল ২-৫, আর উহানের নতুন করোনাভাইরাসটির R0 ১.৪-৪ এর মধ্যে। বলে রাখা ভালো, ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত তিনটি আলাদা গবেষণায় সার্স করোনা ভাইরাসের R0 -এর আলাদা হিসেব প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও সবসময়ই সংখ্যাটি ১.৪ থেকে ৪ এর ভেতর। দুর্ভাগ্যবশত নতুন এই করোনাভাইরাসটির সংক্রমণ এবং বিস্তার সম্পর্কে জ্ঞাত তথ্যে প্রায়ই খানিকটা বিভ্রান্তিকর। যেমন ইউরোপিয়ান রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্র (ECDC) বলছে, নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ গবেষণাগারে নিশ্চিত করা হয়েছে ৪৫৮৭ জনের মধ্যে, এতে মৃত্যু হয়েছে ১০৬ জনের। অথচ বাস্তবে সংক্রমণ এবং রোগের মূল সংখ্যা অনেক বেশি। হংকংয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল লিউঙ জানুয়ারির ২৭ তারিখে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, গত ২৫ তারিখ পর্যন্ত রোগের উপসর্গ বিবেচনায় অন্তত ২৬ হাজার জন এই নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

আরও আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, রোগের উপসর্গ দেখা যায়নি এরকম সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা অন্তত ৭৪ হাজার। আশঙ্কা হচ্ছে যে এই সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়বে এবং বিশ্বব্যপী এটি মহামারী হয়ে উঠবে। এই তথ্যের হিসেবে নতুন করোনা ভাইরাসের R0 ও বদলে যাবে। ঠিক যেমন ২৭ তারিখে একটি গবেষণাপত্রে হিসেব করা হয়েছে নতুন করোনা ভাইরাসের R0 = ৬.৫। তারমানে নতুন করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছে এমন একজন ব্যক্তি গড়ে ৬.৫ জন সুস্থ ব্যক্তির ভেতর ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারে। একইসঙ্গে নতুন করোনাভাইরাসের যে মৃত্যুহারের হিসেব করা হচ্ছে (প্রায় ৪%), সেটিও আংশিকভাবে সত্যি। আরো খানিকটা সময় না গেলে সঠিক মৃত্যুহার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

শরীরে রোগের জীবাণু প্রবেশ করার পর থেকে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়ার আগে পর্যন্ত সময়টিকে বলা হয় "ইনকিউবেশন পিরিয়ড"। এই সময়ে রোগের উপসর্গ দেখা যায় না বলে (গবেষণাগারে পরীক্ষা না করে) সুস্থ ব্যক্তি এবং ভাইরাসে সংক্রামিত ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য করা যায়না। অথচ ইনকিউবেশন পিরিয়ডে ভাইরাসের সংক্রমণ থেমে থাকেনা। তারমানে হচ্ছে, যে লোকটির ভেতর ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে, রোগের উপসর্গ দেখা না দিলেও তার থেকে অন্যদের মাঝে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। নতুন করোনাভাইরাসের এই ইনকিউবেশন পিরিয়ড বিভিন্ন হিসেবে ২ দিন থেকে ১৪ দিন। সেইজন্য দেশে দেশে যে নৌ বা বিমান বন্দরে সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা সেসব প্রায়শই কোন কাজে আসবে না। রোগের লক্ষণ যাদের ভেতর প্রকাশ পায়নি নৌ-বিমানবন্দরে তাদেরকে চিহ্নিত করার উপায় নেই। যেসব ব্যক্তির ভেতর নতুন করোনাভাইরাস সংক্রামিত হয়েছে, অথচ রোগের উপসর্গ দেখা যায়নি (২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৭৪ হাজার), তারা ভাইরাসটির অধিকতর সংক্রমণে সবচে বড় ভূমিকা রাখবে।

এখন পর্যন্ত ১৮টি দেশে (ম্যাকাও এবং হংকং-কে আলাদা দেশ ধরে) নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ECDC বলছে, এশিয়ার দেশগুলোতে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার এবং বড় রকমের মহামারী সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের বেশি চীন ভ্রমণ এটির কারণ। বস্তুতই, যে ১৮টি দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে সেগুলোর মধ্যে ১৩ টি এশিয়ার দেশ।

বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সেই মহামারী সামাল দেয়ার সক্ষমতা আমাদের আছে কিনা সেটি নিয়ে আমি সন্দিহান। সেইজন্য মহামারী শুরুর আগেই প্রতিরোধ করা জরুরি। বিদেশে ভ্রমণ করে এসেছেন এমন ব্যক্তিদের নজরদারিতে রাখা যেতে পারে। পত্রিকায় পড়েছি বিদেশ ফেরতদের ২ সপ্তাহ পর্যন্ত ঘর থেকে না বেরোনোর পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের বিশেষজ্ঞরা। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করলে এই পরামর্শটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। খুব বেশি সম্ভাবনা হচ্ছে, হাঁচি, কাশি এবং সরাসরি সংস্পর্শ থেকে ভাইরাসটি একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায়। সেইজন্য ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ। অপরিচ্ছন্ন হাত নাকে, মুখে বা চোখে স্পর্শ করার অভ্যাস কমালে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমতে পারে। সংক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সংক্রামিত ব্যক্তির নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নির্গত কোন তরল, সে হাঁচি বা কাশিতে ছড়ানো অতিক্ষুদ্র জলকণা হলেও, সুস্থ ব্যক্তির বিশেষত চোখ এবং নাক ও মুখের ভেতরের অংশের ত্বকের সংস্পর্শে না আসে।

একটি পত্রিকায় পড়েছি যে বাংলাদেশের পরিবেশ ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির জন্য সহায়ক। এই তথ্যটি আংশিক সত্য। ভাইরাস নিজে বংশবৃদ্ধি করেনা। ভাইরাসের জন্য পোষক প্রাণীর প্রয়োজন হয়। সেইজন্য পোষক প্রাণী যেখানে থাকে সেখানেই ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি করতে পারে। তবে পরিবেশের এবং সামাজিক আচরণ ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সেটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসকে রুখে দেয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, সেটি আশাব্যঞ্জক। কিন্তু একই সঙ্গে এই সময়টিতে হয়ত সংক্রামক রোগ গবেষণায় আরো বেশি মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন। বিশেষত যখন বাংলাদেশ এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে কয়েকটি প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক রয়েছে। কোন একটি নতুন সংক্রামক ভাইরাসের বিস্তার বাংলাদেশে শুরু হলে আমাদের যেন তথ্যের জন্যে অপেক্ষা করতে না হয়, সেজন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে।