জনভোগান্তির অশ্লীল আয়োজন ও বাণিজ্যমেলা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 29 Jan 2020, 11:43 AM
Updated : 29 Jan 2020, 11:43 AM

আমাদের প্রিয় রাজধানী বর্তমানে নরককুণ্ডে পরিণত হয়েছে। যানজট, মিছিল, গগণবিদারী মাইকের আওয়াজ, ধুলাবালি, পোস্টারের জঞ্জাল–সব মিলিয়ে রাজধানীবাসীর ত্রাহি দশা। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে ঘিরে পুরো রাজধানী পোস্টারের জঞ্জালে ভরে গেছে। পোস্টার ছাপানো এবং লাগানোর ক্ষেত্রে যেহেতু কোনো বিধিনিষেধ নেই, তাই অসংখ্য পোস্টারে পুরো ঢাকা শহরকে ঢেকে ফেলা হয়েছে। এর আগে প্রার্থীরা পলিথিনে মুড়িয়ে পোস্টার ঝুলিয়ে দিয়েছিল। হাইকোর্টের এক নির্দেশনার পর পলিথিনযুক্ত পোস্টারগুলো মূল সড়ক থেকে সড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তবে অলি-গলিতে অনিয়মের উদাহরণ হয়ে এখনও তা টিকে আছে।

দেশ ডিজিটাইজেশনের দিকে এগিয়ে গেলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা এখনও সনাতন কায়দাতেই প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিভিন্ন দলের কমিশনার ও মেয়র প্রার্থীরা রেকর্ডিং করা গান-স্লোগান-বক্তৃতা মাইকে বাজিয়ে ভোট-ভিক্ষা করছেন। গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি অলিগলি-রাজপথ জুড়ে লাগাতার কেবল মাইকের অসহনীয় আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মানুষের শান্তি-স্বস্তি-আরামকে হারাম করে দিয়ে মাইকের আওয়াজের সঙ্গে চলছে মিছিলের পর মিছিল আর স্লোগান। রাস্তাঘাট বন্ধ করে একই গলিতে কিছুক্ষণ পর পর বিভিন্ন প্রার্থীর প্রচারমিছিলের জ্বালায় মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। মিছিলের নামে, প্রচারের নামে, নির্বাচনের নামে পৃথিবীর আর কোনো দেশে রাজধানী শহরে এমন 'খাণ্ডবদাহন' চলে কি না কে জানে!

রোগী, শিক্ষার্থী, বয়স্ক ব্যক্তি, কাজের মানুষ–সবার ভোগান্তি সৃষ্টি করে, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ ঘটিয়ে, কাড়ি কাড়ি টাকার শ্রাদ্ধ করে ঢাকা শহরের জন্য কোন 'দেবসন্তান'কে আমরা নির্বাচিত করতে যাচ্ছি? পরিবেশ দূষণে নিয়োজিত এই প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে, পরিবেশ নির্মল রাখবেন কিভাবে? নিজেদের পকেট ভারী করা ছাড়া তারা আমাদের কী উপকারে লাগবেন? কোন সমস্যাটার সমাধান করবেন? আর কিছুই যদি না হয়, তাহলে কেন এই অশ্লীল আয়োজন?

সিটি নির্বাচন নামে এই 'মৌসুমী আজাবের' পাশাপাশি আরও নানাভাবে চলছে নাগরিক-দলন। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে মেট্রোরেলের কাজের জন্য পুরো রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোকে গর্ত করে 'কবরখানা' বানিয়ে রাখা হয়েছে। আর মেট্রোরেল নামের এই 'হাতি'টি গদাইলস্কর চালে চলছে। কবে যে গন্তব্যে পৌঁছবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এদিকে মানুষের দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই। লাখ লাখ মানুষকে বছরের পর বছর নির্মম কষ্ট দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এমন নির্মাণকাজ চলে পৃথিবীর আর কোনো দেশে? এই কাজ দ্রুত শেষ করার কোনো তাগাদা কারও মধ্যে আছে বলেও মনে হয় না।

রাজধানীবাসীকে লাগাতার দুর্ভোগক্লিষ্ট করতে, অপমান করতেই যেন অপরিকল্পিতভাবে অনেক সড়কে অত্যন্ত ধীর গতিতে চালানো হচ্ছে খোঁড়াখুড়ির কাজ। এই কাজেরও শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই! আর এর সার্বিক ফলাফল হচ্ছে যানজটে রাজধানী অচল হয়ে পড়া। রাজধানীতে যানজট নতুন বিষয় নয়। পথে নেমে ভোগান্তি নগরবাসীরা নিয়তির লিখন হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। তবে সম্প্রতি তা যেন সীমা ছাড়িয়ে গেছে। রাজধানীতে দিন দিন বেড়েই চলছে যানজটের তীব্রতা। অসহনীয় যানজটে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। কর্মক্ষেত্রে যাওয়া এবং কর্মক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরার মধ্যেই নাগরিকদের সব শক্তি ও সময় নিঃশেষ হতে চলেছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আগে মহাখালী থেকে মোহাম্মদপুর আসতে যেখানে সময় লাগত ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা, এখন লাগছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। ঢাকা শহর হয়ে উঠেছে বসবাসের একদম অযোগ্য শহর। পরিবহনে গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের সাধের রাজধানী পরিণত হয়েছে এখন মৃতপ্রায় এক নগরী। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফসল হচ্ছে ঢাকা শহরের এই যানজট, এই স্থবিরতা!

কিন্তু কেন এমন অসহনীয় যানজট? পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং ট্রাফিক পুলিশ বলছেন, বর্তমানের এই যানজটের অন্যতম কারণ বাণিজ্যমেলা। এই মেলার কারণে আগারগাঁও, শ্যামলী লিংক রোড, মিরপুর রোড, আসাদগেট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, তেজগাঁও প্রভৃতি সড়কে স্বাভাবিক যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় এক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর যৌথ উদ্যোগে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শেরেবাংলা নগর এলাকায় গত ২৪ বছর ধরে পুরো জানুয়ারি মাস ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্থানীয় উৎপাদকদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি, বিভিন্ন পণ্যকে গ্রাহকের কাছে সরাসরি তুলে ধরা, রফতানি আয় বাড়ানো ইত্যাদি এ মেলার প্রধান উদ্দেশ্য বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু এই উদ্দেশ্য এখন আর অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। বাণিজ্যমেলায় বিদেশি ক্রেতাদের সরাসরি পণ্যের অর্ডার দেয়ার পরিমাণ মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। মেলায় এখন যা পাওয়া যায়, নিউমার্কেট, চাঁদনিচকসহ রাজধানীর বেশিরভাগ মার্কেটেই তা পাওয়া যায়। অনেকে তো এ মেলাকে 'প্লাস্টিক মেলা' বলেও অভিহিত করে থাকেন। মেলায় একে তো নিম্নমানের পণ্য, তার উপর প্রায় সব পণ্যের দামই বেশি, এমনকি খুচরা বাজারের চেয়েও। তাহলে কী লাভ প্রতিবছর হাঁকডাক করে ফি বছর এ রকম একটি মেলার গতানুগতিক আয়োজনে? কিছু ব্যবসায়ীর 'বার্ষিক পিকনিকের' জন্য মাসব্যাপী এমন দুর্ভোগের আয়োজন কি চলতেই থাকবে?

সবচেয়ে বড় কথা যে মেলার কারণে এক মাস ধরে অসহনীয় অবর্ণনীয় যানজট ও জনজট লেগে থাকে, লাখ লাখ মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে নিশ্চল-স্থবির বসে থাকতে হয়, সে মেলা যদি আর্থিক ভাবে কিছু উপকারীও হয়, তবু তা বন্ধ করে দেয়া কী উচিত নয়? লাখ লাখ মানুষের এক মাসের ভোগান্তির মূল্য একশ কিংবা দেড়শ কোটি দিয়ে কী বিবেচনা করা যাবে?

তার মানে এই নয়, যে বাণিজ্যমেলা আয়োজন করা যাবে না। বাণিজ্য মেলা, আমদানি মেলা, রপ্তানি মেলা, বৃক্ষ-পাতা-ফল-ফুল-পাখি মেলা, খেলা, যাত্রা, সার্কাস যা খুশি তাই আয়োজন করা যেতে পারে এবং তা করাও উচিত। সে সব এক মাস, দুই মাস এমনকি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগও চলতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ফেলে এমন কোনো আয়োজনই কাম্য নয়। এমনকি তা যদি কোনো মহৎ আয়োজন হয় তবু নয়! বাণিজ্যমেলাকে অবশ্যই রাজধানীর বাইরে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিবছর ঘোষণা দেওয়া হয় যে সামনের বছর এই মেলা পূর্বাচলে সরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু সেই 'সামনের বছর'টি আর আসে না!

ইতিমধ্যে বাণিজ্যমেলার সময় আরও চারদিন বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এর কোনো মানে আছে বলে মনে হয় না। সময় না বাড়িয়ে অবিলম্বে রাজধানীবাসীর জন্য চরম দুর্ভোগের এই তথাকথিত বাণিজ্যমেলা বন্ধ করে দেয়া দরকার। শুধু বাণিজ্যমেলাই নয়, যানজট সৃষ্টি হয় বা সৃষ্টি হতে পারে, জনদুর্ভোগের কারণ হয়–এমন সব কিছুই সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। যানজট কমাতে ভিআইপিদের চলাফেরাও নিয়ন্ত্রিত হওয়া চাই। প্রয়োজনে ঘরে বসে, ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটিয়ে ভিআইপিরা কাজ করুন। সারাদিন ঘুমিয়ে রাত এগারোটার পর যত খুশি ছুটোছুটি করুন। একটি শহরের হাজার-হাজার লাখ লাখ মানুষ দিনের পর দিন রাজপথে দুর্বিষহ জীবন কাটাবেন, আর কর্তাব্যক্তিরা সবাইকে, সব কিছুকে যতক্ষণ খুশি 'থামিয়ে রেখে' উন্নয়নের গান শোনাবেন-তা মেনে নেয়া যায় না। এর প্রতিবিধান করা উচিত।

রাজধানীর যানজট নিয়ে আলাপ-আলোচনা, উদ্যোগ-আয়োজন কিছু কম হয়নি। কিন্তু এসবের নিট ফলাফল হচ্ছে-আরও যানজট, অধিকতর যানজট! এই ধারা চলতে থাকলে পুরো শহর, পুরো দেশ অচল হয়ে পড়তে বাধ্য। রাজধানীকে, দেশকে অচল-স্থবির বানিয়ে রখে নিশ্চিন্তে ক্ষমতার কাবাব-পরোটা খাওয়া খুব বেশিদিন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। প্রতিকারহীন যানজটে অতিষ্ঠ ক্ষুব্ধ-বিরক্ত মানুষ যদি ঢিল ছোঁড়া শুরু করে, র‌্যাব-পুলিশ তো দূরের কথা কামান দিয়েও তা ঠেকানো যাবে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা মনে রাখলে ভালো করবেন।

সরকারের যদি রাজধানীর প্রতি, রাজধানীর মানুষের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধ থাকে, তাহলে ঢাকা শহরকে যত শিগগির সম্ভব যানজটমুক্ত করা এক নম্বর এজেন্ডা হওয়া উচিত।