ধর্ষকামী এক মৃত সমাজে আমার বাস

Published : 27 Jan 2020, 01:44 PM
Updated : 27 Jan 2020, 01:44 PM
গাজীপুরে চারটি কিশোর মিলে ধর্ষণ করেছে সহপাঠী এক কিশোরীকে। সেই ধর্ষণের বীরত্বের নিদর্শন স্বরূপ ফেইসবুক লাইভে এসে উল্লাস করেছে! ঘটনাটা জেনে রাগ নয়, ঘৃণা নয়, হতাশা আর বিতৃষ্ণায় মনটা ভরে গেল। যতোই মন খারাপ হোক, এটাই আজকের বাস্তবতা। আমার সমাজের বাস্তবতা। এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাস্তবতা।
কতোটা অবক্ষয় হলে, মগজটা কতোটা অন্ধকারে ডুবে গেলে, মাত্র কিশোর বয়সেই কোনও কিশোর ধর্ষক হয়ে উঠে? এর বিপরীতে, ধর্ষণকে কতোটা আনন্দের, কতোটা বীরত্বের, কতোটা রোমাঞ্চকর হিসাবে চিত্রিত করলে একটি সমাজের সদ্য কিশোরেরা বুক ফুলিয়ে, দল বেঁধে পরিকল্পনা করে ধর্ষণে মেতে উঠে? আমি ভাবতে পারি না। আমার অন্তরাত্মা ভয়ে, আতঙ্কে মূক ও বধির হয়ে উঠে।
এই চার কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারও করেছে। তাই বলে এই কিশোরদের অসহায় ভাবার কিংবা তারা শুধরে যাবে, লজ্জিত হবে, এমন ভাবার কোন কারণ নাই। এই চার কিশোর শুরু থেকেই জানতো তারা অপরাধ করছে। তারা জেলে যেতে পারে। তবুও তারা ঠাণ্ডা মাথায় ধর্ষণের পরিকল্পনা করেছে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে এবং সেটা ঘটা করে মানুষকে জানিয়েছে। তারা ধরা পড়ার ভয়ে ভীত নয়, তারা সামাজিক লজ্জার কারণে শংকিত নয়। পরিবার জানলে কী হবে, সেটা নিয়েও তারা চিন্তিত নয়। তারা নিশ্চিত জানতো তাদের পরিবার তাদের পাশে দাঁড়াবে এবং সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়েছে। এমনকি পরিবারের সদস্যরা ভিকটিমের পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে সদর্পে।
এক চরম দুর্যোগময় মানবিক ও নৈতিক অবক্ষয় ঘটে গেছে আমাদের সন্তানদের মাঝে। এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আজ আমরা। এই বিপর্যয় অনাকাঙ্খিত হলেও অবধারিতই ছিলো। যে সমাজে কিশোরেরা সব কিছু ভুলে গিয়ে ধর্ষণকে আনন্দের উৎস হিসাবে বেছে নেয়, সেই সমাজ এক মৃত সমাজ। ধর্ষকামী এক মৃত সমাজে আমার বাস।
এই সমাজ ধর্ষণের প্রতিবাদ করে না, সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলে না। শুধু গুটিকয় মানুষ একটু আহা, উহু করে। একটু ঘৃণা জানায়। একটু দোষারোপ করে পরক্ষণেই আবার ভুলে যায়। যে সমাজ তার কিশোরদের মনে কোন স্বপ্ন তৈরি করতে পারে না, অপরাধীকে আগলে রাখে, যে সমাজের গা থেকে শুধুই পুঁতিগন্ধময় ধর্ষকামিতার ঘাম ঝরে, সেই সমাজ অন্তঃসারশূন্য, মগজহীন, মনুষ্যত্বহীন এক মৃত সমাজ।
এই দেশে প্রতিদিন ঘরে ঘরে তৈরি হয় ধর্ষক। পরিবারের প্রশ্রয়ে, সমাজের নিরাপত্তাবেষ্টনীর ভিতর এবং রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। আজ হয়তো চারটি কিশোরের কথা জানা গেল, এমন অসংখ্য কিশোর বড় হচ্ছে আমাদেরই ঘরে৷ আমরা তা জানি, কিন্তু মানি না।
এই কিশোরেরা সারাজীবন কিশোর থাকবে না। বড় হতে হতে জীবনের প্রতিটি ধাপে রেখে যাবে তাদের ধর্ষকামিতার চিহ্ন। শিকারী কুকুরের মতো খুঁজে নেবে শিকার। কেমন করে আটকাবেন তাদের? শুধু আইন আর বিচার দিয়ে? পারবেন না। পুরো অস্তিত্ব জুড়ে যখন ধর্ষকামিতার শেকড় গেড়ে বসে, তখন শাস্তির ভয় কেউ করে না। যেমন করে নাই এই চার কিশোর। সদর্পে, হাসিমুখে জানিয়েছে জেলে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা।
আমাদের নিষ্ক্রিয়তা, আমাদের দায় এড়িয়ে চলার মানসিকতা, আমাদের জবাবদিতার অভাব এবং সর্বোপরি,  কোনও না কোনও অজুহাতে ধর্ষণকে সমর্থন জোগানোর সংস্কৃতি আজ আমাদের কিশোরদের এই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এক ভয়াবহ ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। আসুন সম্মিলিতভাবে আমরা সেই ভবিষ্যতের অপেক্ষা করি।
কোনও প্রতিবাদের দরকার নাই। আক্রোশে ফেটে পড়ার দরকার নাই। কোনরকম যদি, কিন্তু, ইত্যাদি ছাড়া বিনাবাক্য ব্যয়ে ধর্ষণকে 'না' বলার দরকার নাই। আমাদের ছেলেরা দিনে দিনে ধর্ষক হয়ে উঠুক আর আমাদের মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হওয়ার আতঙ্ক নিয়ে বড় হোক। আর আপনারা না হয় বড়জোর কন্যাদের সাত কাপড়ে পেঁচিয়ে বা ঘরে আটকে রেখে সান্তনা খুঁজে নেবেন।