রোহিঙ্গাস আউট চায়না ইন

স্বদেশ রায়
Published : 22 Jan 2020, 02:15 PM
Updated : 22 Jan 2020, 02:15 PM

আমার বন্ধু লেখক ও সাংবাদিক গাজালক্সমী প্রেমাশিবম, তার এক আর্টিকেলের শিরোনাম দিয়েছেন 'তামিলস আউট অ্যান্ড চায়না ইন'। গাজালক্সমী প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকা বা ব্লগে শ্রীলংকার তামিলদের দুর্দশা নিয়ে লেখেন। এই শতাব্দীর সব থেকে বড় গণহত্যা তামিল গণহত্যার অনেক বর্ণণা পাওয়া যায় গাজালক্সমীর 'ন্যান অস্ট্রেলিয়ান' বইয়ে। তামিল গণহত্যা নিয়ে সব থেকে ভালো কাজ যিনি করেছেন, কাজের সূত্রে তিনিও লেখক ও সাংবাদিক বন্ধু ফ্রান্সিস হ্যারিসন। তার অনবদ্য কাজ 'স্টিল ডেথ কাউন্টিং' পড়ার আগে ভাবতে পারিনি গণহত্যা নিয়ে এত ডিটেইলেস কাজ করা যায়। কাকতালীয়ভাবে এরা দুইজনেই নারী। কিন্তু সাহসিকতায় তারা কোন জেন্ডার মানেননি। ফ্রান্সিস হ্যারিসনের কাজটি নির্মোহভাবে একটি গণহত্যার ছবি তুলে আনা। গাজালক্সমী  নিজে তামিল। এজন্য তার লেখা কিছুটা 'বায়াসড' মনে হতে পারে। কিন্তু দু'জনের কাজ মিলিয়ে পড়লে বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক  স্বার্থে কত নির্মমভাবে মানুষকে হত্যা ও উদ্বাস্তু করা হয়!

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর ১৭ জানুয়ারির মায়ানমারে আসার পরে মনে হলো তাকে নিয়ে একটি কলাম লিখি। যার শিরোনাম হবে 'রোহিঙ্গাস আউট চায়না ইন', কিন্তু গাজালক্সমীর শিরোনামটি অনুকরণ করতে বা চুরি করতে বিবেকে বাধা দিচ্ছে এই ভেবে যে আমরা সমবয়সী, সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে প্রায় একই সময়ে এসেছি, ওদের দু'জনের থেকে হয়তো আমার লেখাপড়া একটু কম, কিন্তু দায়বোধ কম হলো কেন? আরাকান রাজ্যের সীমানায় বঙ্গোপসাগরে 'ক্যাফিউ ডিপ সি পোর্ট' তৈরির জন্য চীন এবং মায়ানমারের মধ্যে এমওইউ সাইন হয় ২০০৯ সালে এবং 'ক্যাফিউ ইকোনমিক জোন' তৈরির সমঝোতা স্মারক সই হয় একই সময়ে। চায়না এর বেশ আগে থেকেই 'নিউ সিল্ক রুট বা টোয়েন্টি সেঞ্চুরি সিল্ক রুট' নিয়ে কথা বলে আসছে। তারা কথা বলছে চীন-মায়ানমার ইকোনমিক করিডোর নিয়ে। পেশাগত কারণে এগুলোর ওপর সবসময়ই চোখ রেখেছি। চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট' নিয়ে কমবেশি পড়ার চেষ্টা করি। বাস্তবে এটা জটিল বিষয়। ভারতের অর্থনীতিবিদ ও স্ট্র্যাটেজিশিয়ানদের অনেকের ভিন্নমত অছে। চীনের ভেতরেও এ রুট বাস্তবায়নের পথ নিয়েও নানান মত আছে। এইসব মিলিয়ে  চীন এবং ভারতের নিজ নিজ বক্তব্যের বাইরে এসে মেলাতে চেষ্টা করেছি যে এই শতকের শেষের দিকে এশিয়া যে অর্থনীতির মূল নিয়মক হবে সেখানে এই সিল্ক রুটের প্রয়োজনীয়তা কতখানি? মনে হয়েছে, চীন যদি আরেকটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না হয়ে এশিয়ার বহুকেন্দ্রিক অর্থনীতি বিনির্মাণের সহায়ক হিসেবে আবির্ভুত হতে চায় এবং সেক্ষেত্রে একটি সিল্ক রুটের কথা ভাবে, তাহলে তা মন্দ কিছু নয়। বরং ভালোই হতে হবে। কিন্তু শ্রীলংকা ও মায়ানমারে (যেহেতু শুধু এশিয়ার কথা বলা হচ্ছে তাই আফ্রিকার উদাহরণ এখানে টানার দরকার নেই) হাম্বানটোটা এবং মায়ানমারের 'ক্যাফিউ ডিপ সি পোর্ট ও ইকোনমিক জোন' করার ক্ষেত্রে যে মানুষ হত্যা ও মানুষকে উদ্বাস্তু শ্রীলংকার সরকার ও মায়ানমার সরকার করলো, তা শুধু মানবাধিকারের একটি কালো ক্ষত নয়, আগ্রাসী অর্থনীতির এক বর্বর রূপ। একবিংশ শতাব্দীতে বিশেষ করে প্রযুক্তির এই শতাব্দীতে অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য নিরীহ মানুষের উপর এই বর্বরতা কোনক্রমেই ঘটতে পারে না।

গাজালক্সমী  ঠিক যে বিচারে 'তামিলস আউট অ্যান্ড চায়না ইন' লিখেছেন, ঠিক একই বিচারে বলা যায় 'ক্যাফিউ ইকোনমি জোন ও ডিপ সি পোর্ট'-কে সামনে রেখে মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে যা ঘটলো, তা 'রোহিঙ্গাস আউট চায়না ইন'।

কিন্তু এখানে আমিসহ আমাদের লেখক ও সাংবাদিকদের বড় ব্যর্থতা হলো, এই অর্থনৈতিক আগ্রাসনের দিকটি নিয়ে কোনও ডিটেইলস কাজ আমরা করিনি। এমনকি হ্যারিসন যেমন তামিল গণহত্যা নিয়ে কাজ করেছে, তেমনি রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে কেউ ডিটেইলস কাজ করেনি। এখানে একেবারে প্রফেশনাল গবেষকদের যে খুব দরকার ছিল তা নয়; গাজালক্সমী বা ফ্রান্সিস হ্যারিসনের মত সাংবাদিকতার চোখ নিয়ে কাজটা করলে বিষয়টা স্পষ্ট হতো। কারণ, এখানে 'ক্যাফিউ ইকোনমি জোনে' চীনের বিনিয়োগ এবং তা থেকে ভবিষ্যতের বাণিজ্যরেখা কোন কোন দিকে যাবে তার তথ্যগুলো তুলে ধরলেই অনেক বিষয় বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে লিখেছি এবং টকশোতে বলেছি এই 'ডিপ সি পোর্ট'ই রোহিঙ্গা উচ্ছেদের মূল কারণ। যেহেতু এ গভীর সমুদ্রবন্দর যেমন ভারতীয় বন্দর থেকে মালামাল চীনে নেওয়ার দূরত্ব পাঁচ হাজার কিলোমিটার কমিয়ে দেবে, তেমনি বঙ্গোপসাগরে চীনের স্থায়ী আধিপত্যও নিশ্চিত করবে। আবার এই সমুদ্রবন্দরের কাছেই বঙ্গোপসাগরের তলদেশে চীন বিশাল তেল রক্ষণাগার তৈরি করছে। সেখান থেকে তারা পাইপলাইনে নিজ দেশে জ্বালানি তেল নিয়ে যাবে। হাম্বানটোটার অভিজ্ঞতা যা বলে তাতে মায়ানমারও এক সময় এই বন্দর, তেল রক্ষণাগার ও ইকোনমি জোন মিলিয়ে গোটা এলাকা চীনকে লিজ দিতে বাধ্য হবে। মায়ানমার কোনক্রমেই এই বন্দর থেকে লাভ করে বিনিয়োগের অর্থ চীনকে ফেরত দিতে পারবে না। চীনের এই 'অবকাঠামো গড় এবং আধিপত্য নাও' নীতি এর আগে শ্রীলংকা, লাওসে এবং আফ্রিকার অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। তাই মায়ানমারেও তারা সফলই হবে। চীনের অর্থনৈতিক বিস্তারের আরেকটি দিক হলো তারা যেখানেই বিনিয়োগ করে সেখানেই ধীরে ধীরে চীনা নাগরিকদের বসতি স্থাপন করে। যার ফলে তাদের বিনিয়োগে যে কর্মসংস্থান হয় তার সিংহভাগই তাদের নাগরিকরা ভোগ করতে পারে। আরাকানেও ভবিষ্যতে চীনা নাগরিকরাই আসবে। আর তারই প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের সেনাবাহিনীর মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছে।

হয়তো এ মুহূর্তে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, তবে এ কাজে মায়ানমারের সেনাবাহিনীকে একটি অজুহাত খুঁজতে পথ করে দিয়েছে চীনের বিশ্বস্ত বন্ধু পাকিস্তান। মায়ানমার সেনাবাহিনী  যাতে রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে তার প্রেক্ষাপটটি চীনের বিশ্বস্ত বন্ধু পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই করে দেয়। এ গোয়েন্দা সংস্থাটি আরাকানের রোহিঙ্গাদের ভেতর 'আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি'(আরসা) নামে একটা অতি উগ্র জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলে। আরসা নামের এ সংগঠনটি দিয়ে তারা পুলিশের ওপর একটি বা দুটি হামলা ঘটায়। সেটাকেই অজুহাত করে মায়ানমারের সেনাবাহিনী  নির্বিচারে গণহত্যা, নারী  ধর্ষণ সবই শুরু করে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শ্রীলংকার তামিল নিধন করে যেমন শুধু ফাঁকা মাটি বের করা হয়েছে এখানেও একই কাজ করা। বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনা যদি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সীমান্ত খুলে না দিতেন তাহলে কমপক্ষে দশ লাখ রোহিঙ্গা গণহত্যার শিকার হতো।

এ অর্থনৈতিক আগ্রাসনের সঙ্গে যে আরো বড় বড় শক্তি জড়িত তার প্রমাণ- জাতিসংঘসহ সকলেই বাংলাদেশে চলে আসা এই শরণার্থীদের মুসলিম শরণার্থী  হিসেবে আখ্যায়িত করলো। এটা পশ্চিমাদের একটি নতুন কৌশল। গত  কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত। এ অশান্তি পশ্চিমারাই সৃষ্টি করেছে। এ অশান্তির ফলে যে লাখ লাখ লিবীয়, লেবানিজ, সিরিয়ান ও ইরাকি মানুষ পশ্চিমে শরণার্থী হচ্ছে তাদেরকে তারা দেশ বা জাতির নামে যেমন- ইরাকি বা সিরিয়ান শরণার্থী  বলছে না। বলছে মুসলিম শরণার্থী। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সেটাই ঘটেছে। এরও কারণ একটু দৃষ্টি মেলে দেখলেই অতি সোজা। যখনই মায়ানমারের শরণার্থী বা ইরাকি শরণার্থী বলা হবে তখনই তারা সাধারণ মানুষের কাছে শরণার্থী  হিসেবে পূর্ণ সিম্প্যাথি পাবে। অন্যদিকে, সোভিয়েতের পতনের পরে মুসলিম জনগোষ্ঠিকে পশ্চিমারা এমনভাবে সারা পৃথিবীতে উপস্থাপন করেছে যে মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী। তাই যখনই মুসলিম শরণার্থী বলা হবে তখনই সাধারণ মানুষ ধরে নেবে এরা ততটা সিম্প্যাথি পাওয়ার যোগ্য নয়। কারণ, এরা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের মুসলিম শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করে একই কাতারে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তারা এখানে আসার আগে 'আরসা'র মাধ্যমে পাকিস্তান তাদেরকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। রোহিঙ্গা শিবিরে এখন ঘুরলে এবং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে 'আরসা'র খোঁজ আর পাওয়া যায় না। এখন যা পাওয়া যায় তা হলো- নানান গোষ্ঠির মাধ্যমে তাদেরকে নানান ধরণের জঙ্গি বানানো হচ্ছে। আর এ কাজেও সহায়তা করছে চীনের বিশ্বস্ত বন্ধু পাকিস্তানের গোয়েন্দা বাহিনীর আইএসআই এর অর্থ এবং যে অর্থ মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমদের একটি গোষ্ঠিকে জঙ্গি  বানাচ্ছে যারা তাদের। রোহিঙ্গাদের এ জঙ্গি বানানোর প্রাথমিক দুটি উদ্দেশ্য স্পষ্টই দেখা যায়। এক, তাদেরকে জঙ্গি বানাতে পারলে সাউথ এশিয়ার ভারতসহ অনেক দেশকে অস্থিতিশীল করার কাজে এদেরকে ব্যবহার করা যেতে পারে- তাতে অর্থনৈতিক প্রতিযোগী দুর্বল হবে। দুই, রোহিঙ্গারা জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত হলে তাদেরকে আর আরাকানে ফেরত নেবার কোন জোর দাবি কেউ তুলতে পারবে না। মায়ানমার বিশ্ববাসীর কাছে বলবে ওরা বাস্তবে একটি মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠি; যার ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি তখন জঙ্গি আলখেল্লায় ঢাকা পড়ে যাবে। আর সে সময়ের ভেতর আরাকানে চীনের বিনিয়োগের সঙ্গে চীনের নাগরিকও 'ইন' করে যাবে। এ কারণেই গাজালক্সমীর শিরোনামটি নকল করেই সত্যটি প্রকাশ করতে হয়, বাস্তবে ঘটবে 'রোহিঙ্গাস আউট চায়না ইন'।