নির্বাচন কমিশন উস্কে দেয়া সম্প্রদায়বোধ ও পাওয়া না পাওয়া

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 18 Jan 2020, 07:08 AM
Updated : 18 Jan 2020, 07:08 AM

নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া সীমা আর প্রার্থীদের খরচের বাস্তবতা নিয়ে জনমনে সংশয় থাকলেও কেতাবি রেওয়াজ মেনে ভোটের ব্যয়ের সম্ভাব্য একটি ফর্দ নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র প্রার্থীরা।তাতে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থী ভোট করবেন পুরোপুরি নিজের টাকায়। তবে বিএনপির দুই প্রার্থীকে নির্বাচনী প্রচারের খরচ মেটাতে ধার করতে হবে। ভোটার সংখ্যা অনুপাতে দুই সিটির মেয়র পদপ্রার্থীরা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা করে ব্যয় করতে পারবেন। পোস্টার ছাপানোর পাশাপাশি প্রচার, পরিবহন, পথসভা-ঘরোয়া সভা, নির্বাচনী ক্যাম্প, এজেন্ট ও কর্মীদের খরচ, আবাসন ও প্রশাসনিক ব্যয় বাবদ এই খরচ করা যাবে।দুই বড় দলের চার প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া অংক ধরেই ভোটের ব্যয়ের পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তবে বাকি নয়জনের মধ্যে এমন প্রার্থীও আছেন, যিনি মাত্র চার লাখ টাকায় ভোট সেরে ফেলার পরিকল্পনা ইসিকে জানিয়েছেন।

জনগণের কতটা সায় বা কি তাদের মনোভাব? রাজনীতি এখন তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। একটা সময় ছিলো যখন জনগণই ছিলো মূখ্য। সে সময়টা দুনিয়াব্যাপী বদলেছে। তা বলে আমাদের মতো না। আমাদের সবকিছু দ্রুত বদলায়। যে জাতি হরতাল, দাঙ্গা, ধর্মঘট, রাস্তাঘাটে মিছিল-মিটিং অন্তপ্রাণ ছিলো তার সমাজে এখন মিছিল-মিটিং নাই। এটা সদার্থক। আরো ভালো যে, কথায় কথায় বন্ধ-হরতাল নাই দেশে। কিন্তু যেটা উধাও সেটা হলো ভোটাধিকার। এটা কিন্তু কোনো দেশে তেমন বদলায়নি। সে কারণে মেয়র নির্বাচন নিয়ে যতটা কৌতুহল, প্রার্থী নিয়ে যতটা আলোচনা, তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে যতটা আবেগ তার ঢের বেশি তাদের অস্বাভাবিক আচরণ আর তারিখ নিয়ে।

অস্বাভাবিক আচরণগুলো কী কী? এই যেমন ধরুন বলা নাই কওয়া নাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেমে গেলেন চা বানাতে। আমরা মাঝে মাঝে বিদেশী নেতাদের এমন আচরণ দেখে তাদের সারল্য সহজ জীবনযাপন নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাই। কারণ কী? কারণ এটা তাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার অংশ। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ জন মেজর সম্ভবত বাস চালাতেন। সাধারণ কফি শপের সাধারণ গ্রাহক ওবামাকে দেখি মাঝেমাঝে। একসময় পিজ্জা ডেলিভারি দিতেন সোভিয়েত ভাঙার নায়ক গর্বাচেভ। দূরে যাবার দরকার নাই। গান্ধী কেমন পোশাক পরতেন? সুভাষ বোস, শ্রী অরবিন্দ এরাও ছিলেন সাধারণ। দেশবন্ধু সি আর দাশের কাপড় ধোলাই হয়ে আসতো প্যারিস থেকে। স্বদেশী হবার পর শুধু খাদি। অথচ মমতা ব্যানার্জীর কথিত সারল্য মানুষ সন্দেহের চোখে দেখে। এই যে তিনি পায়ে চপ্পল পরেন আর সাজগোজ করেন না এমনকি চুলও আঁচড়ান না এ নিয়ে প্রচুর কানাঘুষা। কারণ অবিশ্বাস। তার ভাইপোসহ নানা আত্মীয়ের বিলাস আর চাকচিক্যে ঢাকা পড়ে গেছে মমতার সারল্য। বঙ্গবন্ধু বা তাজউদ্দীন আহমদ কিংবা চার নেতার কাউকে মানুষ সন্দেহ করে? কেন করে না? এর জবাব পেলেই বোঝা সম্ভব আতিক বা তাবিথ দুজনই আসলে এক ধরনের নাটক করছেন। যেমন তাবিথ আউয়াল যে বাসের হাতল ধরে হেলপার হলেন এটা কি লোক দেখানো না? যারা লাখ লাখ টাকা দামের গাড়ি ছাড়া বাজারে যান না যাদের বিলাস আর সুখ সাধারণের কল্পনা তারা টি স্টলে চা বানালে নাটক ছাড়া আর কি বলা সম্ভব? তাই দাখিলকৃত হিসাব নিকাশ নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। সবাই জানে কোনটা সত্য আর কোনটা হলফনামা।

আর একটা বিষয়ে আগ্রহ হলো নির্বাচনের দিন-তারিখ। এখানে দুটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত থাকলেও আরো নানা বিষয়ের মতো কেউ তা আমলে নেয়নি। যেটি সবচেয়ে স্পর্শকাতর তা হলো সরস্বতী পূজা। বাংলাদেশ এখনো একটি সেক্যুলার সমাজ বাঁচিয়ে রাখার আশায় বুকে সাহস নিয়ে থাকা সমাজ। নানাভাবে আক্রান্ত হবার পরও সে আশা মিথ্যে হয়ে যায়নি। এখনো গণতন্ত্র বা সমাজ সংহতির আশা আছে বুকে। সে কারণে এই সরকারের আমলে সরস্বতী পূজার দিনে ঢাকা শহরে মেয়র নির্বাচন মানতে পারেনি সাধারণ ছাত্র জনগণ। ছাত্ররা এখনো আমাদের ভরসার স্থল। তারাই এসে দাঁড়িয়েছে পথে। তাদের কপাল খারাপ। এখন কেউ আর তাদের কথা শোনে না। এর চেয়ে জরুরি বিষয়েও শোনেনি। নিরাপদ সড়ক, কোটা আন্দোলন, ধর্ষণ কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ টেকেনি। যেভাবেই হোক থামিয়ে দেয়া হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু সমস্যার আগুন কি তাতে নিভে যাবে? পূজা বা নির্বাচন কোনোটাকেই ব্যহত করবে কি করবে না তা কিন্তু বিষয় না, বিষয় সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনোভাব। সাধারণ মানুষ যে প্রশ্নগুলো তুলছে তা হলো এমন করে কি আমাদের সমাজে ধর্ম বিষয়ে সাম্য আর সমান মর্যাদা বহাল রাখা সম্ভব? আরো সংখ্যাল্প জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরাতো প্রমাদ গুণতেই পারেন এখন থেকে। মূলত এতে পিছিয়ে পড়ছে সরকারি দল। বিএনপি প্রার্থী ইতোমধ্যে বলে দিয়েছেন এমন ঘটনায় তারা মর্মাহত। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন তাদের আমলে কখনো এমন কিছু হয়নি। তাই কোথায় যেন ষড়যন্ত্র আর বিপদের আভাস আছে আসলে। ইতোমধ্যে পূজা বর্জনের হুমকিও এসেছে। বলা হয়েছে তফসিল অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারিই যদি ভোটের আয়োজন হয়, তাহলে সেদিন সকাল ৮টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সরস্বতী পূজা করে রাজপথে অঞ্জলি নিয়ে কালো পতাকা মিছিল করবে তারা।

এর মধ্যে একটিই আশার খবর। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছে তারিখ পিছালে তাদের আপত্তি নাই। দেরিতে হলেও এই বোধোদয় হয়তো কাজে আসবে। কারণ সরকারি বোধোদয়ের ভেতর থাকে পরিবর্তনের ঈঙ্গিত। তারপরও লোকে এখন মনে করবে ঠেলার নাম বাবাজী। মূলত ভোটের চাইতে এসব ঘটনা এখন বড় হয়ে উঠেছে। যে কারণে ভোট হয়ে পড়েছে গৌণ। গতবারের মেয়র সাঈদ খোকন বা আতিক কেউই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সাফল্য দেখাতে পারেননি। বরং একসময় নিয়ন্ত্রণজনিত ব্যর্থতা আর মৃত্যুর হারে মানুষ আস্থা হারিয়ে ছটফট করতে শুরু করেছিল। আগুন ঢাকার একটা বড় সমস্যা। সেখানেও তাদের সফলতা খুব একটা নাই, নাই যানজট নিরসনে। ঢাকার পরিবেশ বা সামাজিক অস্থিরতা দুনিয়াব্যাপী বাংলাদেশের অর্জন অগ্রগগতিকে চ্যালেঞ্জ জানালেও মেয়রেরা কিছু করতে পারেননি। তাই মানুষের ধারণা যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপান্ন। তারপরও ভোট হয়।

এখন আসলে কেউই জানে না কেন হয়? মুখ বদলে যাবার জন্য না সত্যিকারের কোনো পরিবর্তনের জন্য?