রাষ্ট্র, সংবিধান, সংখ্যালঘু, সরস্বতী পূজা ও প্রহসন

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 15 Jan 2020, 08:47 AM
Updated : 15 Jan 2020, 08:47 AM

হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা। এই পূজা এখন একটি সার্বজনীন রূপ গ্রহণ করেছে। যুগ যুগ ধরে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিদ্যাদেবী সরস্বতীর আরাধনা করে আসছেন। আগামী ৩০ জানুয়ারি এই সর্বজনীন সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ওই দিন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। ঘোষণার পর থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা নির্বাচনের এই তারিখ পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বিষয়টি আমলে নেয়নি। পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংক্ষুব্ধ কয়েকজন ব্যক্তি নির্বাচনের তারিখ পুনঃনির্ধারণ করতে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। কিন্তু হাইকোর্টও রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ আর হতাশা। কারণ একই দিন পূজা এবং নির্বাচন হলে পূজার অনুষ্ঠান বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া সরস্বতী পূজা মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রীক। আমাদের দেশে ভোটগ্রহণও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রীক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচনের বুথ তৈরি করা হয়। সেখানে নানা ধরনের বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। পূজা এবং নির্বাচন এক সঙ্গে করতে গেলে সেখানে কিছু বিরোধ সৃষ্টি হবেই। কারণ সরস্বতী পূজা একটি ধর্মীয় উৎসব। কোনো ধরনের বিধি-নিষেধ বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে এই উৎসব অবাধ হতে পারে না। আবার পূজানুষ্ঠান যদি অবাধে করতে দেওয়া হয়, সেখানে নির্বাচনী পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন দলীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা একে-অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর জন্য মুখিয়ে থাকে। কে কার নামে কলঙ্ক আরোপ করে ফায়দা হাসিল করতে পারে, তার একটি গোপন প্রতিযোগিতা সব সময়ই লক্ষ করা যায়। এই বাস্তবতায় সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করে প্রতিপক্ষের নামে দায় চাপানোর যে প্রয়াস গ্রহণ করা হবে না, সে গ্যারান্টি কে দিতে পারে?

নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এমন একটি ধর্মীয় উৎসবের দিনে কেন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করল? এই কি তাদের দায়িত্বশীলতা? অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ? ৩০ জানুয়ারি যে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হবে-সেটা পূর্বনির্ধারিত। পঞ্জিকা মতে, সরস্বতী পূজার তিথি ২৯ জানুয়ারি ৯টা ১০ মিনিট থেকে ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টা পর্যন্ত। তাহলে এই দিনটিকেই কেন নির্বাচনের দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হলো? নাকি তারা সরস্বতী পূজাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি? একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উৎসব তাদের কাছে কোনো তাৎপর্যই বহন করে না?

অথচ বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি৷ এই নীতি রক্ষা ও বাস্তবায়নে সংবিধানে কিছু রক্ষা কবচও আছে৷ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নৃগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণের কথা আছে সংবিধান ও আইনে৷ কিন্তু এই কি তার প্রতিফলন?

সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমূক্ত রাখার বিধান করা হয়েছে৷ একইভাবে সাম্প্রদায়িক আচরণকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷

২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না৷

২৮(৩)-এ বলা হয়েছে, কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোনো বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোনো নাগরিককে কোনোরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না৷

সুতরাং এটা পরিস্কার যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রপরিচলানার নীতি, সংবিধান এবং আইন ধর্মনিরপেক্ষতা বা অসাম্প্রদয়িকতাকে ঊর্ধে তুলে ধরেছে৷ অথচ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষের অধিকার ও ধর্মীয় আবেগের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করেছে।

সরকারই বা এ ব্যাপারে নীরব কেন? তারাই বা কেন এই তারিখটি পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগী হচ্ছে না? অথচ গত বছর জন্মাষ্টমী উদযাপন উপলক্ষে দেশের সনাতম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবনে বলেছিলেন, "এই বাংলার মাটিতে যেহেতু আমরা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এক হয়ে বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কাজেই এখানে সকল ধর্মের সম্মান ও অধিকার থাকবে।…

মুক্তিযুদ্ধকালে যখন সকলে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে এক ভাইয়ের সঙ্গে অপর ভাইয়ের রক্ত মাটিতে মিশে গেছে সে রক্ততো কেউ ভাগ করতে যায়নি, এটা ভাগ হতে পারে না। এ সময় ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে আশ্রিতদের কে হিন্দু বা কে মুসলমান সেটা দেখা হয়নি। আমরা সেটা ভুলবো কিভাবে?''

শেখ হাসিনা আরও বলেছিলেন, ''এখানে আমার একটা অনুরোধ থাকবে আপনারা নিজেরা নিজেদেরকে বার বার করে কেন সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু বলেন, আমি জানি না। তিনি প্রশ্ন করেন, আপনারা কি এই রাষ্ট্রের নাগরিক না? আপনারা কি এদেশের মানুষ না? এটা আপনার জন্মভূমি না?'' তিনি নিজেই এর উত্তরে বলেছিলেন, এটাতো আপনাদের জন্মভূমি। তাহলে নিজেরা নিজেদেরকে ছোট করে সংখ্যালঘু করে দেখবেন কেন? 'এখানে সকলের সমান অধিকার রয়েছে' বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন!

বাংলাদেশে সকল মানুষের অধিকার যদি সমানই হবে, তাহলে সরস্বতী পূজার দিন কেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? আর এই নির্বাচনের তারিখ পুনঃনির্ধারণের দাবিই বা কেন অগ্রাহ্য করা হবে? যদি সত্যি সত্যি ৩০ জানুয়ারি নির্বাচন হয়, তাহলে কি হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা নির্বিঘ্নে সরস্বতী পুজা করতে পারবেন? নির্বাচনের সময় যে যান চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ, সেটা কি পূজানুষ্ঠানকে প্রভাবিত করবে না? সখ্যালঘু বলেই কি আজ নির্বাচন কমিশনের এই অন্যয্য সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে? এই কি 'সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল সরকারের' আচরণের নমুনা?

আরেকটি কথা, উচ্চতর আদালতে এসেও যদি এদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আইনানুগ সঠিক বিচারটি না পায়, তখন এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ কোথায়? তারা কার কাছে যাবে?

বাংলাদেশে যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী তাদেরও তো ধর্মীয় অনুভূতি আছে। তাদেরও পূজা-অর্চনা করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাদের সেই অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে, খর্ব করা হচ্ছে। সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক হলো, পূজার যে পবিত্রতা, ভাবাবেগ, ব্যাপকতা এবং উৎসবের আঙ্গিক, এটাকে কেউই বিবেচনায় আনার প্রয়োজন মনে করেননি!

ওদিকে 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' হানার অভিযোগে শরিয়ত সরকার নামে এক সঙ্গীতসাধক বয়াতিকে গ্রেফতার করা হয়েছে, অন্যদিকে সরস্বতী পূজার দিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, আসলে এই রাষ্ট্র কার? এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, ভিন্ন ধর্ম ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের অধিকার কোথায়?

তবে কি এই রাষ্ট্রে সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা ভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা-এসব কেবলই প্রহসন?