মেডিকেল কলেজে যে কারণে ভর্তি পরীক্ষা থাকা জরুরি

ফিরোজ আহমেদ
Published : 5 June 2014, 04:01 PM
Updated : 16 August 2012, 08:13 AM

রাশেদা কে চৌধুরীর বাংলাদেশে গণশিক্ষার বিস্তারে নীতিনির্ধারকদের একজন হিসেবে বেশ পরিচিত একটি নাম। সম্প্রতি বিডিনিউজের মতামত বিশ্লেষণ পাতায় মেডিকেল কলেজে ভর্তিপরীক্ষা বাতিলের সরকারী সিদ্ধান্ত বাতিলের পক্ষে রচিত তার নিবন্ধটি আমাদের না ভাবিয়ে পারেনি। ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে তিনি বেশ কিছু যুক্তি হাজির করেছেন। আসুন, তার যুক্তিগুলো একে একে দেখা যাক।

প্রথমত, কোচিং সেন্টারের বাণিজ্য নিয়ে তার যথেষ্ট আপত্তি দেখা গেল। এই আপত্তি যৌক্তিক,তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আপত্তি কিভাবে আস্ত ভর্তি পরীক্ষাটাই বন্ধের কারণ হতে পারে, তা তিনি ব্যাখ্যা করলেন না। কোচিং সেন্টারগুলো প্রকাশ্য প্রতিষ্ঠান, তাদের অফিস আছে, সাইনবোর্ড আছে, তারা বিজ্ঞাপন দেয়। কোচিং ব্যবসার রমরমা গোপনে-অপ্রকাশ্যে চলে না। হাইকোর্টের রায়ও আছে কোচিং ব্যাবসার বিরুদ্ধে। রাশেদা কে চৌধুরীর পয়লা যুক্তি অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ নাকি এই কোচিং-বাণিজ্য বন্ধেরই পদক্ষেপ! অর্থাৎ, ভর্তিপরীক্ষার উপকারিতা-অপকারিতা, লাভ-ক্ষতির তুলনায় তার কাছে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই ধরনটিকে বোঝাবার জন্যই 'মাথাব্যাথা সারাতে মাথাকাটা'র উপমাটি ব্যবহার করা হয়। সিদ্ধান্তটি যাদের জন্য স্বস্তির কারণ হবে বলে তিনি ভাবছেন, সেই শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নেমে প্রমাণ করেছে রাশেদা কে চৌধুরীর সাথে তারা একমত নন।

দ্বিতীয়ত, ৭৯ ঘন্টার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলকে কেন এক ঘন্টার ফলাফলের চেয়ে কম মূল্যায়ন করা হবে কেন, তার প্রশ্ন। উত্তরটা বহু রকম, প্রথমটা আপাতত দিয়ে রাখি। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা বলা চলে ছাত্রদের একেবারেই গঠনকালীন দশা, শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই খেয়াল করেছেন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মনোযোগ, আগ্রহ এবং যোগ্যতার ব্যাপক পরিমানে উত্থান-পতন এই সময়টাতে হয়ে থাকে। অন্যদিক দিয়ে এই দুই পরীক্ষার ফলাফল অনেকগুলো বিষয়ে শিক্ষার্থীর সক্ষমতার একটি গড় ফল মাত্র, তার সুনির্দিষ্ট আগ্রহ ও দক্ষতার প্রতিফলন তাতে হয় না।

তুলনামূলকভাবে ভর্তি পরীক্ষার সময়ে তার বয়েস এবং অভিজ্ঞতা, সামনের জীবনের মুখোমুখি হওয়া প্রভৃতি বহু কারণেই দ্রুত, অতি দ্রুত পরিপক্ক হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যে এক ঘন্টার ভর্তি পরীক্ষায় সে অংশ নেয়, সেটি দীর্ঘপ্রস্তুতি এবং পেশা হিসেবে একটি সুনির্দিষ্ট বিদ্যাকে বেছে নেবার আগ্রহের ফল। কৈশোর থেকে তারুণ্যে প্রবেশ করছে সে। শিক্ষার্থীর এই প্রস্তুতির গুরুত্ব আছে। ভর্তি পরীক্ষায় আসলে এই ক্ষমতারই মূল্যায়ন করা হয়। এক ঘন্টাকে কম মনে হচ্ছে? আমারও তাই মনে হয়। হয়তো প্রয়োজন আরও কঠিনতর এবং বিস্তৃততর পরীক্ষা। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় আগ্রহ ও নিষ্ঠার প্রমাণ দেয়াটা বাধ্যতামূলক থাকাটাই দরকার।

রাশেদা কে চৌধুরীর তৃতীয় যুক্তি মতে আমাদের ছেলেমেয়েরা নাকি 'এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্টের ভিত্তিতে উন্নত দেশেও পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, তাহলে নিজ দেশে আমাদের পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে না কেন?' প্রথমত, এটাও খুবই ঢালাওভাবে বলা একটা বক্তব্য। শিক্ষার্থীরা বিপুল হারে যায়, এমন কটি দেশে জিআরই, সাবজেক্ট জিআরই, ভাষা পরীক্ষাসমেত নানান পরীক্ষায় তাকে অংশ নিতে হয়; যেসব দেশে হয় না সেক্ষেত্রও কারণটাও খুবই সোজা, তাদের আসন-সঙ্কট নেই, আমাদের প্রবল ভাবে আছে। ফলে নিজ খরচে আমাদের শিক্ষার্থী সেখানে পড়লে এবং কৃতকার্য বা অকৃতকার্য হলে তাদের কিছু যায় আসে না। অন্যদিকে তাদের বিদ্যালয়ের পার্থক্য গ্রাম-শহর ভেদে এত বিপুল না, আমাদের পর্বতপ্রমাণ। বহু যোগ্য এবং আগ্রহী শিক্ষার্থী সে কারণেই এসএসসি-এইচএসসি তে অনেক কম নাম্বার পেয়েও পরিশ্রমের ক্ষমতা, আগ্রহ আর যোগ্যতার বলে এদেশে ভর্তি পরীক্ষায় অন্যদের টপকে যায়। কানাডা প্রবাসী এক শিক্ষার্থী জানালেন, আর সব বিষয়ে হাইস্কুল পরীক্ষার ফলাফলকে গোনা হলেও এবং আসনের তেমন সঙ্কট না থাকলেও চিকিৎসাশাস্ত্র পড়তে আগ্রহী মার্কিন ছাত্রদের mcat নামের একটা পরীক্ষায় অবশ্যই অংশগ্রহণ করতে হয়। আর সেই চিকিৎসা পেশাতেই ভর্তি পরীক্ষার বালাইটা তুলে দিচ্ছেন সরকার, এবং সেটা ভুরি ভুরি গোল্ডেন এ পাওয়া এই শিক্ষাব্যবস্থায়!

পরের অনুচ্ছেদটি কিভাবে লেখা সম্ভব হলো, সেটা এক আশ্চর্য। আমি পুরোটাই উদ্ধৃত করছি 'চতুর্থত, গত বছর মেডিকেল ভর্তিপরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ৫১ হাজার শিক্ষার্থী। এরা সবাই কিন্তু মেডিকেলে পড়ছে। কেউ তাদের স্বপ্ন থেকে দূরে নয়। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে? পাবলিক মেডিকেল কলেজগুলোতে যারা সুযোগ পায়নি তারা বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে। লাখ লাখ টাকা দিয়ে ওই কলেজগুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। এখন কথা হল, ডাক্তার হতে ইচ্ছুকদের সবাই যদি মেডিকেলে পড়তে পারে তাহলে ভর্তিপরীক্ষার যৌক্তিকতা কোথায়? প্রয়োজনীয়তা কী?'

আমি নিশ্চিত না ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া ৫১ হাজার শিক্ষার্থীর সকলে, কিংবা বড় অংশ কিংবা অন্তত অর্ধেকাংশ কি করে বর্তমানে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যয়ন করছেন, এই রকম একটি ভুতুড়ে পরিসংখ্যান তিনি হাজির করতে পারলেন। বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিত্বগণ এভাবে কাল্পনিক সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে স্বস্তিতে থাকলে জাতির অস্বস্তি প্রবল হবে। রাশেদা কে চৌধুরী খুবই ভুল একটি তথ্য উপস্থাপন করেছেন এখানে।

কোচিং এ টাকা-পয়সা খর্চা করে, অনেক কষ্ট করে মফস্বলের যারা মেডিকেলে চান্স পেল না তাদের বেদনার সাথী হয়েছেন রাশেদা চৌধুরী, আমরা আবারও শুধু এইটুকুই বলতে চাই, কোচিংব্যাবসা বন্ধ করে দিলেই এই বাড়তি ব্যয় ও ভোগান্তি নির্মূল হবে। আশা করি তিনিও সরকারকে সেই পরামর্শই দেবেন, কিন্তু মফস্বলের শিক্ষার্থীদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনার চেয়ে আরও বহুগুন দুঃসহ বেদনা তো যোগ্যতা তো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এসএসসি ও এইচএসসিতে কম নাম্বার পাবার কারণে উচ্চশিক্ষাগ্রহণের স্বপ্ন দেখার সুযোগটাই থেকে বঞ্চিত হওয়াতেই হবার কথা। সেটা কেন তিনি অনুভব করছেন না?

রাশেদা কে চৌধুরী নিবন্ধটিতে আরও জানিয়েছেন সিদ্ধান্তটি খুব তাড়াহুড়ো করে নেয়া হয়নি। গত বছরই নাকি 'আলোচনা' হয়েছিল, এবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটিকে তার সমর্থন করাটিও নাগরিকদের যথেষ্টই আশ্চর্যান্বিত করেছে। যেদিন তার এই লেখাটা বিডি নিউজে প্রকাশিত হলো, সেই দিন সকালের দৈনিক প্রথম আলোতেই এই বিষয়ক বিপরীত একটি মন্তব্য তারই নামে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে তিনি সরকারের পূর্বঘোষণা না দিয়ে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিপক্ষে বলেছেন। আমরা বলতে চাই, সিদ্ধান্তটি শুধু ভুল নয়, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াটি স্বৈরতান্ত্রিক, একগুয়ে এবং অবিবেচনাপ্রসূত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা-পেশার ভর্তিপরীক্ষা স্বরুপ mcat র ওয়েব সাইটে আগামী কত বছরে এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে কি কি পরিবর্তন আসবে, সে বিষয়ে আগাম ধারণা হবু শিক্ষার্থীদের আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা অতটুকু চাইবার সাহস করি না বটে, কিন্তু ভর্তির ঠিক আগে আগে এই ধরনের হঠকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে গণতান্ত্রিক বলাটাকে মানতে পারি না। এমন গুরুতর একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে শুধু মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষগণের নয়, প্রকাশ্য আলোচনায় মতামত গঠন এবং যুক্তি-পাল্টা যুক্তির অবতারণার গুরুতর প্রয়োজন ছিল।

নারী শিক্ষার্থীদের জন্যও রাশেদা চৌধুরীর ভাবনা আছে 'আবার মেডিকেলে ভর্তির জন্য কোচিং করাতে অনেকেই ছেলেমেয়েদের পেছনে এত টাকা খরচ করতে পারেন না। বিশেষ করে মেয়েদের অভিভাবকরা। মেয়েদের মা-বাবারা তো মেয়েদের পেছনে টাকা খরচ করতে অনেক হিসাব করেন। জিপিএ'র ভিত্তিতে ভর্তি হলে মেয়েরা বরং অনেক বেশি সুযোগ পাবে।'

আমাদের নারী শিক্ষার উন্নয়নে রাশেদা কে চৌধুরী হয়তো খুবই তৎপর, কিন্তু দুঃখজনক ভাবে হয়তো কখনো কখনো কাল্পনিক হিসেবের কারণে ভুল পথেও পরিচালিত। কিংবা সরকারের যে কোন সিদ্ধান্তের ন্যায্যতাকরণের এনজিওসুলভ 'নারীবান্ধব' তকমা ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকেও এটা আসতে পারে। কথা হলো এই, জিপিএ'র ভিত্তিতে ভর্তি হলে মেয়েরা বরং অনেক কম সুযোগ পাবে, কারণ সাধারণভাবে বাংলাদেশে পাসের হারে মেয়েরা সামান্য এগিয়ে থাকলেও জিপিএর হিসেবে ছেলেরা বেশ অনেকটাই সুবিধাজনক জায়গায় আছে। কারণটাও খুব সঙ্গত, রাশেদা চৌধুরীই তা কোচিং এর জন্য বুঝতে পারলেও কেন যেন জিপিএর বেলায় বুঝতে পারছেন না– ছেলেদের জিপিএ নাম্বার বৃদ্ধির জন্য পরিবার যতটা খরচ করে, মেয়েটার জিপিএ নাম্বার বৃদ্ধির জন্য পরিবার ততটা খরচ করে না। এছাড়া আরও বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধক তো রয়েছেই। কিন্তু রাশেদা চৌধুরীর নারী শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি চিকিৎসাবিদ্যায় সুযোগ পাবার ধারণাটা যে একান্তই কাল্পনিক, তা তো কৃতকার্য ছাত্রদের জিপিএ নাম্বারের পরিসংখ্যান থেকেই পরিস্কার। ভর্তি পরীক্ষার বদলে এসএসসি-এইচএসসির ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল হলে তার যুক্তি অনুযায়ীই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েই নারী-শিক্ষার্থীটির জন্য আসন কমে যাবে, পুরুষ শিক্ষার্থীটির জন্য আরও বহুগুন বাড়বে। এভাবে জিপিএর ভিত্তিতে ভর্তি করা হলে নারীরা বেশি সুযোগ পাবে, এটি রাশেদা কে চৌধুরীর দেয়া দ্বিতীয় ভুল তথ্য।

রাশেদা কে চৌধুরীর ভাবছেন চিকিৎসাপেশায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে, পরিসংখ্যান বলছে তা কমবে। শুধু তাই না, পরিসংখ্যান আরও বলছে গ্রামের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমবে। শহরের নারী শিক্ষার্থীর তুলনায় গ্রামের নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমবে বিদুৎগতিতে। কারণ ঢাকা শহরের একই যোগ্যতার শিক্ষার্থীরা নানান অবকাঠামোর সুবিধার কারণে নম্বর তোলার ক্ষেত্রে যে বাড়তি দক্ষতা ও সুবিধা অর্জন করে, মফস্বল-গ্রামের শিক্ষার্থী তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য আমাদের পুরোটা মনোযোগ দিতে হবে, রাশেদা চৌধুরীর এই মতের সাথে ভিন্নমতের সুযোগ সামান্যই। কিন্তু এরপরপরই তার বাক্যটিতে আবারও হোঁচট খেতে হলো : 'একসময় মেডিকেল কলেজগুলোতে সিট-সংকটের কারণে ভর্তিপরীক্ষার ব্যবস্থাটা চালু করা হয়েছিল। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই। তাহলে আমরা কেন করব?'

মেডিকেল কলেজগুলোতে আসন-সংকট বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলো পূরণ করে ফেলেছে, রাশেদা চৌধুরীর এই ধারণাটি একদমই অমূলক। কিন্তু উন্নত বিশ্বে এ ধরনের পরীক্ষার কোনও ব্যবস্থা নেই, এই বক্তব্যটি আবারো চমকে দেয় পাঠককে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে আসন-সংকট নাই, সেখানেও যে শিক্ষার্থীদের বিশেষায়িত পরীক্ষা দিতে হয় চিকিৎসা বিদ্যায় পড়তে গেলে, তা আমরা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছি। এই হলো তার উপস্থাপিত তৃতীয় ভুল তথ্য।

মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের ভাল ফলাফল বিষয়ে নিন্দামন্দ করার কিছু নাই, শিক্ষার্থীরা ঠিক তাই জাতিকে উপহার দিচ্ছে, পূর্বপ্রজন্ম তাদেরকে যেমন পরিস্থিতিতে রেখেছেন। কিন্তু এই দুটো সাধারণীকৃত পরীক্ষা দিয়ে উচ্চশিক্ষার স্তরের শিক্ষার্থীদের বাছাই করতে যাওয়াটা একদমই বেওয়াকুফ কাজ হবে, বিশেষ করে তীব্র আসন সঙ্কটের আর অথর্ খরচ করে নাম্বার তোলার এই পরীক্ষা ব্যবস্থায়। বরং আমাদের বর্তমান সমস্যার মুখে আরও বাছাই করা, আরও বিশেষায়িত ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থাই করা উচিত। পদার্থবিদ্যায় দুর্ধর্ষ মনোযোগের ছেলেটা বা মেয়েটা ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগই পায় না আমাদের দেশে। আইনস্টাইন নিজে রসায়ন, জীববিজ্ঞান আর বিদেশী ভাষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন ভর্তি পরীক্ষায়, গণিত আর পদার্থবিদ্যায় অসাধারণ ফল তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। গণিতের বিশেষ পারদর্শীতার সাথে কেন হবু সকল চিকিৎসককে যুযতে হবে? ইংরেজিতে জিপিএতে বেশি এগিয়ে থাকলেই কি সে পদাথর্বিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা বা জীববিদ্যায় বেশি দক্ষ হবে?

সে কারণেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আর চিকিৎসা পেশায় ভর্তি পরীক্ষাটি দর্শনগতভাবেই আলাদা, একটিতে প্রধানত শিক্ষার্থীর গাণিতিক হিসাব করার ক্ষমতাকে যাচাই করা হয়, অন্যটিতে তার স্মরণ রাখার ক্ষমতাকে। বোঝার ক্ষমতা এবং উদ্ভাবনী যোগ্যতা উভয়টির জন্যই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে জরুরি। রাশেদা চৌধুরীর নিবন্ধটিতে নয়ন নামের একজন মন্তব্যকারী প্রসঙ্গটা কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ভর্তি পরীক্ষা বাতিল নয় তাই, একে আরও চোখা, বিষয়ভিত্তিক এবং বিশেষায়িত করাটাই আমাদের মত আসন সঙ্কটের মত দেশে চিকিৎসাবিদ্যা সমেত সকল উচ্চশিক্ষার সকল ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করার আপাতত একমাত্র উপায় হতে পারে। এবং অতি অবশ্যই, গণিত, পদাথর্বিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়ন প্রভৃতিতে সহজাত দক্ষতা দেখানো শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বাকি সবগুলো বিষয়ে চূড়ান্ত রকমের নমনীয়তা প্রদর্শন করাটাও অত্যাবশ্যক।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন এবং এটা হওয়াটা খুবই সম্ভব যে, কোচিং একটা অজুহাত মাত্র। অস্পষ্ট, কোটাভিত্তিক এবং জটিল একটা ভর্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়াকে দলীয়করণ এবং ভর্তিবাণিজ্যের বন্দোবস্তের নতুন প্রক্রিয়া এটা। এই ভীতিটা প্রবল হয়ে উঠেছে সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়া থেকেই।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কোচিংসেন্টার উস্কাচ্ছে? মাননীয় মন্ত্রী-উপদেষ্টা-নীতিনির্ধারক-কর্তাব্যক্তিগণ, এক্ষুনি সকল কোচিং সেন্টারের দরজায় তালা দিয়ে দিন। কোচিং সেন্টারগুলো এই মূহুর্তে এই মফস্বলী কিংবা কম জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীদের হয়তো ব্যবহার করতে পারছে, তার কারণ এই না যে এরা কোচিং ব্যবস্থার সেন্টারের পক্ষে। তার একমাত্র কারণ তারা ভর্তি পরীক্ষায় আর একটা তুলনামূলক ন্যায্য সুযোগ চায় তাদের যোগ্যতা প্রমাণের। কোচিং সেন্টারের সুবিধা যদি কিছু থেকে থাকে, সেটাও এই কম জিপিও পাওয়া শিক্ষার্থীরাই পায় সবচে কম। তাদের বড় অংশের ঢাকায় বাড়ি নেই, মেসে গাদাগাদি করে ভর্তিযুদ্ধের দমবদ্ধ করা প্রস্তুতির বদলে তারা তখন নিজের বাড়িতেই বসে তুলনামূলক আরামে ভবিষ্যতে চিকিৎসক কিংবা আর কিছু হবার জন্য খাটতে পারবে। কিন্তু দয়া করে আপনাদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার ব্যর্থতা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না।


ফিরোজ আহমেদ
: রাজনৈতিক কর্মী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।