জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে সরকারি টাকায় এর কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ছল-ছুতোয় বিদেশ ভ্রমণের উপদ্রব জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেছে। ছল-ছুতো বলতে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, যন্ত্র ও কলাকৌশল দর্শন ইত্যাদি অজুহাতে সরকার মহাশয় তার কর্মকর্তাদের নিয়ে নিয়মিত প্রমোদ ভ্রমণের তরী ভিড়িয়ে বেড়াচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে। যারা এদের মধ্যে দুর্বল প্রকৃতির, তাদের আনন্দ ভ্রমণের তরী উগান্ডার মতো দেশে গিয়েও ভিড়ছে! তবে এই হরিলুটের বাতাসা কিন্তু সবাই পাচ্ছেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিসিএস এর গুটিকতক প্রভাবশালী ক্যাডারের কর্মকর্তা, আইন বিভাগ ও সেনাবাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা সাধারণত এই দুর্লভ সুযোগের (!) আওতাভুক্ত।
একটা বেরসিক কৌতুক বলি। মাসখানেক আগে, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে অস্ট্রেলিয়ার পার্থে বাউয়া (BAAWA- Bangladesh Australia Association of Western Australia) কর্তৃক আয়োজিত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান চলাকালীন বাংলাদেশের আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত এক কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হয়। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বললেন যে, উনি সিডনির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে স্মরণ করার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে অগত্যা মোবাইলের ক্যামেরায় তোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ভদ্রলোকের একখানা ছবি আমাকে দেখালেন, যেখানে লেখা আছে– UNSW. মজার ব্যাপার হচ্ছে এরপরেও উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ নাম বলতে পারলেন না (UNSW- University of New South Wales)। বলুন কি অবস্থা! যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন, সেটার নাম পর্যন্ত বেমালুম ভুলে বসে আছেন। তাহলে কী ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন বা নিয়েছেন সেটা প্রশ্ন করা অবান্তর।
যাক, আমরা আবার প্রশিক্ষণ কাম ভ্রমণ কাহিনীতে ফিরে আসি। ক্যামেরা ক্রয়, পুকুর খনন পরিদর্শন– এরকম হাস্যকর কিছু ভ্রমণ বাদেও অতি প্রয়োজনীয় কিছু প্রশিক্ষণের কথাও যদি ধরি, সেখানেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের জুডিশিয়ারি সার্ভিসের নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিচারিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকারের আইন ও বিচার বিভাগ, অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অংশীদারিত্বমুলক স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এই প্রকল্পের অধীনে ধাপে ধাপে প্রায় ৫৪০ জন বিচারককে প্রশিক্ষণের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। আর এই বিপুল পরিমাণ ব্যয় মেটাচ্ছে বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই উন্নতমানের (এখানেও আমার গুরুতর প্রশ্ন আছে, পরবর্তীতে কোনো একসময় আলোচনা করার ইচ্ছা রইল) প্রশিক্ষণ আবশ্যকীয় হলেও সেটা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই কি হতে হবে? পাঠ্যসূচিতে শুধু তত্ত্বীয় বিষয় থাকলে একই প্রকল্পের অধীনে তুলনামুলকভাবে অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় বা আরও উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশিক্ষক/শিক্ষক বাংলাদেশে এনে আরও অধিক সংখ্যক বিচারককে আরও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেত। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপও একই দোষে দুষ্ট, যেটা আমার পূর্ববর্তী একটা লেখায় উল্লেখ করেছি।
প্রসঙ্গক্রমে, নিজের একটা অভিজ্ঞতা পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করতে চাই। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের (Deakin University) পক্ষ থেকে চীনের উহান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (WUST- Wuhan University of Science and Technology) গিয়েছিলাম যন্ত্রকৌশল বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের সম্পূর্ণ একটা কোর্সের ক্লাস নিতে। উপরোক্ত অলোচনার মত এটিও ছিল Deakin-WUST এর মধ্যকার একটি যৌথ প্রকল্প। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ক্লাস নেওয়ার সময় উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিষয়ের একজন চীনা শিক্ষকও ক্লাসে উপস্থিত থাকতেন। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার, অভিজ্ঞতা অর্জন করে একটা নির্দিষ্ট সময় পর তারা নিজেরাই এই কোর্সটি পরিচালনা করবে। চীন এরকম শত শত (এমনকি সংখ্যাটি হাজারের কোটাও হতে পারে) যৌথ প্রকল্পের অধীনে তাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়/প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিদেশি শিক্ষক/প্রশিক্ষক নিয়ে এসে থাকে। এটা একদিকে যেমন সাশ্রয়ী, অন্যদিকে তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময় পর নিজেরাই প্রশিক্ষণ প্রকল্প পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছে। স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশের সরকারও কোনো একদিন এরকম দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে (সদিচ্ছা থাকলেই এটাসম্ভব)।
তবে আমি এটাও মনে করি, কিছু কিছু প্রশিক্ষণ আছে যার জন্য বিদেশে আসতেই হবে। যেমন, আমার এক বাল্য বন্ধু, সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল পদমর্যাদার ডাক্তার, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হিসেবে ঢাকার সিএমএইচে কর্মরত আছেন। ক্যান্সার চিকিৎসার আধুনিকায়নের লক্ষ্যে তারা একটি অত্যাধুনিক রেডিও থেরাপি মেশিন (Linear Accelerator Machine) কিনতে চাচ্ছেন। উচ্চমূল্যের এই যন্ত্র কেনার আগে এর কার্যকারিতা ভালোভাবে যাচাই করতে তাই গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে তিনিসহ পাঁচ জনের একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (সান ডিয়াগো) বিখ্যাত মুরস ক্যান্সার সেন্টারসহ আরও কয়েকটি ক্যান্সার সেন্টার পরিদর্শন করেন যারা রেডিও থেরাপির ক্ষেত্রে এই যন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। চিকিৎসক দলটি সেখানকার রেডিও থেরাপির রেডিয়েশন প্রটোকল নিয়েও আলোচনা করেন, যেটা রেডিও থেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ।
এরকম হয়তো অনেক কারণ আছে যার জন্য কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ অত্যাবশ্যক। তাছাড়া অনেক সময় সংশ্লিষ্ট বিদেশি পার্টনারের আর্থিক সহযোগিতায় কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন। স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest) না থাকলে এক্ষেত্রে কারও কোনও অভিযোগ থাকার কথা নয়। তাই ঢালাওভাবে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণকে আমরা নেতিবাচকভাবে এক কাতারে বিচার করতে পারি না।
তাহলে কি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা ও অপ্রয়োজনীয়তার মাঝে ছেদ রেখা টানা সম্ভব হবে না? নিশ্চয় সম্ভব। আর এই কাজে এগিয়ে আসতে পারে প্রবাসী সাংবাদিক সমাজ। আমরা জানি, ইউরোপ, আমেরিকা ও ওসেনিয়া অঞ্চলের প্রায় সকল দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে একটা গণনাযোগ্য অংশ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। বড় বড় শহরে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। যেমন, এক সিডনি শহরে যে পরিমাণ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক আছে, অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরেও সে পরিমাণ বাংলাদেশি আছে বলে আমার মনে হয় না!
যখন বাংলাদেশের কোন কর্মকর্তারা একক বা দলগতভাবে এসব দেশে আসেন, অনেক সময় আমরা অসাংবাদিক-সাংবাদিকরা তাদের সাথে সেলফি তুলে নিজেদেরকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করি। জাহির করার এই সুযোগটাই কিন্তু প্রবাসী সাংবাদিকেরা অন্যভাবে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা আগত কর্মকর্তাদেরকে এয়ারপোর্টেই কিংবা তাদের থাকার জন্য নির্ধারিত হোটেল লবিতে বসে বিদেশ ভ্রমণের কারণ নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে পারেন। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার মত স্পর্শকাতর কোনো বিষয় না হলে পরবর্তিতে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করে সফরের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যকীয় কাজে আসলে সম্মানিত হবেন, অন্যথায় লজ্জিত হবেন। আর এই তথ্য প্রকাশের ফলে জনগণের টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণের কারণে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা জনরোষ যেমন লাঘব হবে, তেমনি অসাধু কর্মকর্তাদের অযাচিত মধুচন্দ্রিমাও ঠেকানো যাবে। তাছাড়া এমনও হতে পারে, কর্মকর্তারা যে প্রশিক্ষণের কাজে বিদেশে এসেছেন, অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি সেই বিষয়ে দক্ষ। কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের কারণ প্রচারিত হলে এমনও হতে পারে এই দক্ষ প্রবাসীরা নিজ উদ্যোগে বাংলাদেশ সরকারকে দেশে গিয়ে বিনামূল্যে (অথবা নামমাত্র সম্মানিতে) একই সেবা দিতে আগ্রহী হচ্ছেন। আমার প্রায় এক দশকের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা বলে, দেশের প্রতি ভালোবাসা দেশে থাকলে যতটা না উপলব্ধি হয়, দেশের বাইরে আসলে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অনুভূত হয়। সুতরাং, প্রবাসের এই দক্ষ জনগোষ্ঠিকে সরকার খুব সহজেই কাজে লাগাতে পারে বিভন্ন আঙ্গিকে।
তাই আমি মনে করি, দেশ থেকে আগত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের (সরকারি কর্মকর্তা) সাথে সেলফি তুলে নিজেকে জাহির করার চেয়ে সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিদেশ সফরের কারণ সচিত্র প্রতিবেদন সহকারে জনগণের সামনে উপস্থাপন করলে, কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, অর্থাৎ, সরকারি টাকার অপচয় নিয়ে জনমনে যে অস্বস্তি, তা কিছুটা হলেও দূর হবে। একই সাথে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে সেবা ফেরত পাওয়ার একটা উজ্বল সম্ভাবনাও তৈরি হবে। খুব বেশি ভুল কিছু বললাম কি?