মাহমুদ দারবীশ: গানের প্রশংসা অতিক্রমী এক পরিযায়ী পাখি

তাপস গায়েন
Published : 26 May 2014, 03:37 PM
Updated : 26 May 2014, 03:37 PM

প্যালেস্টাইনের গ্যালিলীর সন্তান কবি মাহমুদ দারবীশ (১৯৪২-২০০৮) নির্বাসনকে জেনেছেন তাঁর ব্যক্তিগত এবং সাহিত্যিক জীবনের সত্য হিসাবে। নিজের মাতৃভূমি এবং তাঁর মানুষের জন্য এক অনিঃশেষ ক্রন্দন এই কবির কবিতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ । আরব-বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত এবং নিরন্তর সৃজনশীল এই কবি তাঁর সাহিত্যিক সৃজনশীলতা এবং অনুপ্রেরণা খুঁজে ফিরবেন নেটিভ আমেরিকান কবিদের মধ্যে ; এবং প্রাক-ইসলামিক আখ্যান, পুরাণ, আর তার দেব-দেবীদের মধ্যে । সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যতম প্রধান কবি, যার বিচিত্রগামী বিপুল সাহিত্য ভাণ্ডার (কবিতা এবং গদ্য মিলিয়ে প্রায় তিরিশটি বই, যা প্রায় তিরিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে) থেকে মাত্র তিনটি কবিতা অনুবাদ করতে চেষ্টা করেছি মাত্র, যা এখানে সন্নিবেশিত হয়েছে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম-এর পাঠকদের জন্য ।

দ্বীপান্তরে তোমাকে আমি অধিক ভালোবাসি

দীর্ঘ দীপান্তরে আমি তোমাকে অধিক ভালোবাসি
অল্পক্ষণের ভিতরে তুমি বন্ধ করে দিবে নগরীর তোরণ
আমার হৃদয় তোমার হস্তগত নয়; আমার কোনো পথ
নেই যা আমাকে অভিমুখী করে ।

এই দীর্ঘ নির্বাসনে আমি তোমাকে অধিক ভালোবাসি
আমার বারান্দা-সংলগ্ন ডালিম দুগ্ধহীন, রসহীন
পামট্রি হয়ে উঠে ওজনশূন্য, পর্বত ভরহীন
শেষ বিকালে আমাদের রাস্তাগুলো হয়ে ওঠে পথচারীশূন্য,
এই ভূমি হয়ে ওঠে ভরহীন, কারণ সে পৃথিবীকে
জানিয়েছে তার বিদায় সম্ভাষণ।

রাতের সর্পিল বিনুনিতে
শব্দগুলো হয়ে ওঠে হালকা, গল্পগুলো ভরহীন
কিন্তু আমার হৃদয় ভারী ।

জেগে উঠুক নেকড়ের চিৎকার তোমার বাড়ির চৌদিকে
সময়ের আর্তনাদের এইতো প্রকৃষ্ট সময়, বিগত হয়েছে
সোনালি অতীত ; আমার নেই কোনো মাতৃভূমি, …

কিন্তু পরিযায়ীবৃত্তে আমি তোমাকে অধিক ভালোবাসি ।

শেষ বক্তব্যের আগে আমি আমার আত্মাকে করি শূন্য
অশেষ পরিভ্রমণে আমি তোমাকে অধিক ভালোবাসি
প্রজাপতি আমাদের আত্মাকে করে উড্ডীন
দীপান্তরে শার্টের যে বোতাম হারিয়েছি তা আমরা মনে রাখি
যদিও বিস্মৃত হয়েছি শিরস্ত্রাণময় উজ্জ্বল দিন
মনে রাখি এপ্রিকটের স্বেদাক্ত বিন্দুর সুঘ্রাণ, এবং ভুলে যাই
আমাদের বিবাহের রাতে নৃত্যরত অশ্বদের কথা ।

পরিভ্রমণে আমরা হয়ে উঠি পরিযায়ী পাখিদের মতো
আমাদের দিনগুলোর প্রতি করুণা হোক, এইতো সহজ চলে যাওয়া
আমার নিহত হৃৎপিন্ডে নৃত্যরত সোনালি ছোরা
আমি বেঁচে আছি ।

হত্যা করো আমাকে, ধীরে, যেন দীর্ঘ পরিভ্রমনের আগে
সহজ স্বাভাবিকতার থেকে অনেক বেশী বলতে পারি
আমি তোমাকে ভালোবাসি ।

তোমাকে আমি ভালোবাসি,
আছি আমি আমার কষ্টাতীত বেদনায় ।
এই দীপান্তরের পরে
না তোমার সুবাতাস, না তোমার জল,
না তোমার ভোরের তুলসী,
কিংবা না তোমার সান্ধ্যকালীন পদ্ম
কিছুই করবে না আমাকে বেদনায় বিদ্ধ ।

প্যাঁচার রাত

ঠিক এইখানে, বর্তমান আলিঙ্গন করছে না তার অতীতকে, আর যখন
আমরা শেষ বৃক্ষের কাছে এসে পৌঁছেছি, জানতাম যে আমরা মনোযোগী
হতে পারছিলাম না ।
আমরা যখন জাহাজে প্রত্যাবর্তন করেছি, দেখেছি অনুপস্থিতি জড়ো করছে
তার প্রিয় বস্তুসামগ্রীকে এবং আমাদের চারপাশে টেনে দিচ্ছে শাশ্বতের তাবু ।

আছে, ঠিক এইখানে, যখন অতীত আলিঙ্গন করছে না তার বর্তমানকে
মালবেরী ট্রি থেকে জাত এই সিল্কের রশি
রাতের অবয়বে এঁকে দিচ্ছে বর্ণমালা
অদ্ভুত শব্দসমূহের মধ্যে যে গহ্বর সেইখানে আমাদের নিমজ্জমান সাহসিকতায়
কেবলমাত্র প্রজাপতি-নিঃসৃত আলো ছড়িয়ে পড়ছে ।
অভিযুক্ত মানুষটি কি ছিলেন আমার পিতা ?
আমি, বোধকরি, এইখানে মানিয়ে নিতে পারি আমার জীবন
বোধকরি, আমি আমাকেই দিতে পারি জন্মদান এবং নিতে
পারি ভিন্ন এক নাম ।

আছে এক বর্তমান, এইখানে, শূন্য এক কিচেন থেকে তাকিয়ে রয়েছে
সাহায্যনদী অতিক্রমী ট্রাকগুলোর দিকে ।
এই সেই বর্তমান, বাতাসে মসৃন করে তুলছে বাঁশি ।
বোধকরি, কথা হতে পারে স্বচ্ছ, ফলে শব্দরাজির ভিতরে
দেখতে পারি আমরা উন্মুক্ত জানালা, এবং বোধকরি, সময়ও আমাদের মতো
দ্রুততায় সময়ের থলিতে পৌঁছে দিতে পারে আমাদের ভবিষ্যত ।

আছে, সময়হীন এক বর্তমান, এবং এইখানে কেউ পায় না খুঁজে
অন্যকে ।
কেউ রাখে নি মনে কীভাবে আমরা বাহির হয়েছি দরোজা দিয়ে
ঝড়ো হাওয়ার মতো,
এবং সময়ের কোন্‌ সন্ধিক্ষণে আমরা পতিত হয়েছি অতীত থেকে, এবং তখন
টাইলসে বিভাজিত 'গতকাল' ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরায় অন্যের জন্য রূপান্তরিত
আয়নায়, তাদের প্রতিফলিত প্রতিবিম্ব মেলে ধরছে আমাদের ওপর ।

এইখানে আছে ভূগোলহীন এক বর্তমান ।
বোধকরি, এইখানে জীবন সম্ভব এবং প্যাঁচার রাতে আমি কেঁদে উঠতে পারি
অভিযুক্ত মানুষটি কি ছিলেন আমার পিতা, যিনি তাঁর ইতিহাসের বোঝা
চাপিয়ে দিচ্ছেন আমার ওপর ?
বোধকরি, আমি আমার নামের ভিতরে রূপান্তরিত হয়ে উঠব, এবং আমি
আমার মায়ের শব্দ এবং জীবন-প্রণালীর অনুগত হব, ঠিক যেমন হওয়া উচিত
তিনি আমাকে অনুনয় করবেন, যখন লবণ আমার রক্ত স্পর্শ করবে
এবং আমাকে খাবার দিবেন প্রতিবার, যখন নাইটিংগেল আমার ঠোঁটে আঁচড় কাটবে ।

আছে, এইখানে এক ক্ষণস্থায়ী বর্তমান ।
আগন্তুকরা জলপাই শাখায় ঝুলিয়ে রাখে তাদের রাইফেল
টিনের ক্যান থেকে প্রস্তুত ডিনার খেয়ে
দ্রুততায় ফিরে যায় তাদের ট্রাঙ্কে ।

স্পীচ অফ দি রেড ইন্ডিয়ান (তৃতীয় সর্গ)

আমাদের নামঃ অপৌরুষেয় উচ্চারণে বিভাজিত বৃক্ষের পাতা,
এবং পাখি যা উড্ডীন বন্দুকের সীমানার বাহিরে ।

এসেছো যে তুমি, যুদ্ধমত্ত সমূদ্র-অতিক্রমী,
আমাদের নামে উৎকীর্ণ এইসব বৃক্ষ কেটো না
এই সমতল ভূমিতে
কোরো না চালনা তোমার অতিক্ষিপ্র ঘোড়া ।
তোমাদের আছে তোমাদের দেবতা, আমাদের আছে আমাদের
তোমাদের আছে তোমাদের ধর্ম, আমাদের আছে আমাদের ।
তোমার ঈশ্বরকে অধিষ্ঠান দিও না বইয়ের ভিতরে,
যা সাক্ষ্য দেয়
আমার ভূমির উপরে তোমাদের দাবী,
রাজপ্রাসাদের সভাসদ হিসাবে
নিযুক্ত কোরো না তোমাদের ঈশ্বরকে ।

এই নাও আমাদের স্বপ্নের গোলাপ
এবং জেনে নাও আনন্দ যেভাবে জেনেছি আমরা
ঘুমিয়ে যাও আমাদের উইলো বৃক্ষের ছায়ায়
এবং উড়তে থাকো পায়রার মতো
আর যাই হোক, এইতো আমাদের পূর্বপুরুষেরা করেছে,
তাঁরা উড়ে গেছেন শান্তিতে
এবং ফিরে এসেছেন শান্তিতে ।

ভূমধ্যসাগর ছেড়ে চলে গিয়ে তুমি তো রাখবে না মনে,
অরণ্যের গভীরে শাশ্বতের নীরবতা
হয়তো থাকবে মনে পাহাড়ের তীক্ষ্ণ প্রান্তধার
যা তোমার নেই, তা হোল পরাজয়-জাত-বিজ্ঞতা,
পরাজিত যুদ্ধ, একটি পাথর যা
খরস্রোতা সময়নদীর বিপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে,
এক ঘন্টার দিবাস্বপ্নে উত্থিত আকাশের ধূলিঝড় যা
নিজের গভীরে দানা বাঁধে, কিংবা দুইটি পথ থেকে
একটিকে বেছে নেবার নিমিত্তে এক ঘন্টার দ্বিধাযাতনা ।

একদিন হারিয়ে যাবে কিনান এবং ব্যাবিলনের স্তবগান
শুলামিথের জন্য লুপ্ত হয়ে যাবে শুলায়মানের সঙ্গীত,
যেভাবে ইউরিপিডিস হয়ে যাবেন বিস্মৃত
এবং বিলুপ্ত হবে উপত্যকার উদ্গ্রীব জলপদ্ম ।
শাদা মানুষ, তোমাদের যা প্রয়োজনীয় তা হোল
উম্মাদ ঘোড়াকে বশ্যতায় নিয়ে আসার স্মৃতি,
ভায়োলিনের মৃর্চ্ছনায় হৃদয় মসৃন করার পদ্ধতি
এসবই তোমাদের প্রয়োজন, এবং
আরও প্রয়োজন দ্বিধান্বিত একটি বন্ধুক ।

(শাদা মানুষ, সত্যি যদি তোমাদের প্রয়োজন হত্যা করার
তবে হত্যা কোরো না সেইসব প্রাণি,
যারা আমাদের হয়েছে বন্ধু।)

সেইসব বন্ধ্যা শীতের রাতে
আমাদের প্রেতাত্মাদের সাথে তোমাদের দরকার হবে
একটি চুক্তির, যা নিশ্চিত করবে একটি অনতিউজ্জ্বল সূর্য, ম্লান চাঁদ
যা অপরাধকে স্ক্রীণে করবে খানিকটা ধূসর ।

সুতরাং আরও কিছু সময় নিন,
যখন আপনি ব্যবচ্ছেদ করে চলেছেন ঈশ্বর ।
[অসমাপ্ত]