যশোর গাওল ১৯৭১: গর্ডন স্ল্যাভেনের কারাবাস-১

অমি রহমান পিয়ালঅমি রহমান পিয়াল
Published : 16 Dec 2019, 07:28 AM
Updated : 16 Dec 2019, 07:28 AM

[Gaol অর্থ জেলখানা, কারাগার। ইংরেজিতে আগে তাই লেখা হতো। গর্ডন স্ল্যাভেন ও অ্যালেন কনেটকে যখন যশোর কারাগারে নেওয়া হয় তখন ফটকে বড় বড় কালো অক্ষরে Jessore Gaol লেখা দেখেন তারা। ৪১ বছর পর নিজের ব্লগে স্মৃতিচারণে আর Jail কথাটা ব্যবহার করেননি গর্ডন। গাওল লিখেছেন। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের পতনের পর কারাগার থেকে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করে গর্ডন ও অ্যালেনকে। যুদ্ধবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম 'অপারেশন ওমেগা'র সদস্য হিসেবে অক্টোবরে শিমুলিয়া মিশন থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছিল এই ব্রিটিশ তরুণ ও তার মার্কিন সঙ্গিনীকে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ত্রাণ নিয়ে এসেছিলেন তারা। পাকিস্তানি আদালত দুজনকেই অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে এবং সন্দেহজনক তৎপরতার অভিযোগে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়। যদিও দুই মাসের মাথায় মুক্তি পান তারা।

২০১১ সালের ৩১ অগাস্ট একাত্তরের সময়কাল নিয়ে গর্ডন তার স্মৃতিচারণামূলক ব্লগটি শুরু করেন। সেখানে একজন ব্রিটিশ কেরানীর মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে সাত সাগর পাড়ি দেয়ার অ্যাডভেঞ্চারটি লিপিবদ্ধ। গর্ডন লিখেছেন তার সেই সময়ের মনোভাব নিয়ে। কলকাতায় তার দিনগুলো, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তার অনুপ্রবেশ, আটক এবং কারাবাসের সময়কালের কথা। দেশে ফিরে নতুন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ার কথা। এর বাইরেও নানা দর্শন আছে। কিন্তু আমি সুনির্দিষ্টভাবে তার অনুপ্রবেশ, গ্রেপ্তার, কারাবাস ও মুক্তির অংশটুকুই তার ভাষ্য থেকে ভাবানুবাদ করেছি। এবং কিছুক্ষেত্রে সংক্ষেপে, কিছু জায়গা বাহুল্যের কারণে বাদ দিয়েছি। এত সংক্ষেপের পরও লেখাটির বিশাল আয়তনের কারণে এটি তিনটি পর্বে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথম পর্বে থাকছে তার অনুপ্রবেশ ও গ্রেপ্তার। দ্বিতীয় পর্বে বিচার ও কারাবাস। তৃতীয় পর্বে মুক্তির ঘটনা

সঙ্গত কারণেই লেখাটি শুধু গর্ডনকে নিয়েই, তার মেমোয়ার উদ্ধৃত করেই। অ্যালেন কনেট এ নিয়ে আলাদা স্মৃতিচারণ করেছেন 'অ্যাকসিডেন্টাল অ্যাকটিভিস্ট' বইয়ে। তার স্বামী পল কনেট একাত্তরের অগাস্টে লন্ডনে ট্রাফলগার স্কয়ারে বাংলাদেশের পক্ষে বিশাল সমাবেশের আয়োজক। কনেট দম্পতি তাদের অ্যাকটিভিজমের জন্য অনেক বিখ্যাত, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাদের অবদানের জন্য সম্মাননা পেয়েছেন। কিন্তু গর্ডন রয়ে গেছেন আড়ালে। তাকে প্রকাশ্যে আনতেই এই প্রয়াস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে একটি আমন্ত্রণ তার অধিকার। একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তার দীর্ঘদিনের পাওনা। ]

৩ অক্টোবর : রাতের অভিযাত্রা

এমনিতেই মৌসুমী বন্যা, সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়জনিত ভারী বৃষ্টির কারণে বাড়তি স্রোত। কলকাতা ছেড়ে মাঝদুপুরে যখন বের হয়েছি আমরা, রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয়। সীমান্তবর্তী পথঘাট একেক জায়গায় একেকরকম। কোথাও পানি থেকে উঁচুতে, কোথাও বেনোজলে খানিকটা ধোয়া, কোথাও একেবারে জলের অতলে। বৃষ্টি না হলেও আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে উঁচু জায়গাগুলোতে, ঢালাই রাস্তার কিনারে। এমনও প্রমাণ মিলেছে কিছু জায়গায় বসতবাটি ডুবিয়ে পানি দেয়ালের দুই মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভয়ংকর বিধ্বংসী এক সৌন্দর্য- সীমাহীন দরিয়ার মাঝে মাথা উচু করে থাকা তাল গাছ, প্রকৃতির শক্তির কাছে মানবিকতা যেখানে অসহায় নিরূপায়। প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম এসব এলাকায় হিন্দুদের কাছে কালী কেনো পছন্দের দেবী।

বিকেল যত গড়াতে লাগলো, আমরাও সীমান্তের কাছাকাছি হতে লাগলাম। সেইসঙ্গে বানের স্রোতও বেশ তেড়িয়া। বেশ কয়েকবার আমাদের বিশাল এক্স ব্রিটিশ আর্মি অ্যাম্বুলেন্সটি বন্যার কোমর পানি ভেঙ্গে চালাতে হলো। আমাদের দুজন রাস্তার দুই কিনার দিয়ে হাঁটতে থাকলাম যাতে চালক আমাদের মাঝ দিয়ে যেতে পারে। এই অ্যাম্বুলেন্সটি জুনে সাংবাদিকবান্ধব এক বিদায়ী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেন্ট মার্টিন-ইন দ্য ফিল্ডস থেকে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। ইরাকের বসরা পর্যন্ত এটা চালিয়ে নেয়া হয়েছিল, কিন্তু তারপর ভারতে ঢুকতে পাকিস্তানের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো যা ওই সময়কালে অসম্ভব ছিল। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মোলাকাতটা সেক্ষেত্রে অনেক আগেই হয়ে যেত এবং ভুল জায়গায়।

বসরা থেকে বোম্বে (মুম্বাই) জাহাজে করে এসেছে অ্যাম্বুলেন্স এবং চালকেরা। তারপর চালিয়ে আনা হয়েছে কলকাতায়। আমি ভারতে আসার আগে অগাস্টের দিকে একবার এটা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে এক ঘটনায় জড়িত ছিল। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অহিংস সেই চ্যালেঞ্জের ফলাফল হিসেবে আক্ষরিক অর্থেই ভারতের মাটিতে পুশব্যাক করা হয়েছিল এটিকে। কিন্তু আজ অ্যাম্বুলেন্স এবং এর চার যাত্রীর উদ্দেশ্য ভিন্ন। কলকাতার এক কম্বল কারখানা থেকে চার গাঁট কম্বল কিনে আমরা বনগাঁয়ের সীমান্তবর্তী এক গ্রামে যাচ্ছি। সেখানে আমাদের জন্য দুটো নৌকা রাখা আছে। তাতে চেপে আমি আর অ্যালেন সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে কম্বলগুলো বিতরণ করবো।

সূর্যাস্তের একটু আগে আমরা বনগাঁয়ে পৌছলাম। কলকাতা থেকে পুরো ১০০ কিলোমিটার দূরে। গোটা শহর বন্যায় ডোবা হলেও পাকা রাস্তায় কোনো পানি নেই। তাই সব কার্যক্রমের কেন্দ্র সেখানেই। এক চিলতে রাস্তা মানুষে গিজগিজ করছে। মুদি দোকান এবং তাবুর ভিড়, কোনো কোনোটায় হ্যাজাক তবে বেশিরভাগেই কুপি জ্বলছে। এটাই বনগাঁয়ের অস্থায়ী বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সাধারণ এবং বিশেষ পাইকাররা চাল এবং বিস্কুট থেকে শুরু করে কোমল পানীয় এমনকি মাছ ধরার সরঞ্জামও বিক্রি করছে। কেউ কেউ ভালো ব্যবসা করছে পানিরোধক তার্পুলিন বিক্রয়ে। আমাদের বাঙালি সহকর্মী গেল নৌকার খোঁজে, আর আমরা তিন পশ্চিমা এক খোলা রেস্তোরাঁর সামনে প্লাস্টিকের টুলে বসলাম। বন্যার পানিতে ভালো করে হাত ধুয়ে ডাল রুটি আর মিষ্টি চা দিয়ে পেট পূজো সারলাম। খাওয়ার মাঝেই আমাদের সহকর্মী ফিরে এলো, কাজ হয়ে গেছে। ওকে দ্রুত খাওয়ার তাগিদ দিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি। এরপর ওর নির্দেশনাতেই আমরা সেই বাণিজ্য কেন্দ্রের এক কিনারে চলে গেলাম। সেখানে আলো অনেক কম, অনেক নৌকা ভেড়ানো। দুটো নৌকায় কম্বলগুলো ভাগাভাগি করে উঠিয়ে বিদায় নিলাম। কাজ শেষ করে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরছি এই প্রত্যাশা জানিয়ে আমি একটা নৌকায় চড়ে বসলাম, অ্যালেন অন্যটায়।

আমাদের গন্তব্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের শিমুলিয়া ক্যাথলিক মিশন। আশা করছি ভোরের আগেই সেখানে পৌঁছে যাব, পরদিনটা সেখানে থাকবো, কম্বল বিতরণ দেখবো। এলাকা, লোকজন এবং বিতরণের ছবি তোলা হবে সংবাদমাধ্যমের জন্য (আমার সঙ্গিনীর কাজ)। মিশনের কার্যক্রম, এলাকার হালচাল জেনে নিয়ে পরের রাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ফিরবো। যাত্রাটা বানভাসি ফসলের খেতের মাঝ দিয়ে, বন্যা না থাকলে যা অসম্ভব হতো।

প্রায় ৯টার দিকে ঘুটঘুটে আঁধারে আমরা শুরু করলাম। যাত্রার শুরুতে বিশাল এক চাঁদ উঠলো। প্রায় গোল, হলুদ থেকে ফিকে হতে হতে রূপালী রং নিতে থাকলো আমাদের যাত্রার সমান্তরালে। জাদুকরী এক আলোতে উজ্জ্বল পানিতে চারধারের তটরাজির সুতীক্ষ্ণ ছায়া। পাঁচ ঘণ্টার ওই নৌযাত্রায় আমাদের খুব চুপচাপ থাকতে হয়েছে। পানিতে শব্দ অনেকদূর যায় এবং এলাকাটা সংঘাতপূর্ণ। মুক্তিবাহিনী এলাকা নিয়ন্ত্রণের দাবি করলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী উপস্থিতি এখানে রয়েছে। এবং দুইপক্ষের যে কেউ আমাদের প্রতিপক্ষ বলে ভাবতে পারে। মাঝে মাঝে নৌকা থেকে নেমে আমাদের ঠেলা ধাক্কা দিতে হয়েছে। বিশেষ করে খেতের প্রান্তগুলায় যেখানে মাটি উঁচু, পানি কম। সম্ভাব্য কম আওয়াজ করে শরীরের পুরো শক্তি খাঁটিয়ে সে কাজ সারতে হয়েছে। অপার্থিব সৌন্দর্য্যে ওই নীরব অভিযাত্রা নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।

রাত দুটোর খানিক পর নিঃশব্দে মিশনে এসে পৌঁছলাম আমরা। মাঝিরা আমাদের সাহায্য নিয়ে নৌকাদুটো ঘাটে ভেড়ালো। একজন মিশনের দিকে গেল আমাদের উপস্থিতির কথা জানাতে, অন্যজন সাহায্য করলো কম্বলের গাঁটগুলো ডাঙায় তুলতে। সে ফিরতেই তারা তাড়াহুড়ো করে নৌকা ছেড়ে দিল ভারতের দিকে, পরদিন মাঝরাতে ফিরবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে। স্থানীয় এক সহকর্মীকে নিয়ে একজন ইতালিয়ান যাজক আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তার জগতে আমাদের আচমকা উপস্থিতিতে ভীষণ হতভম্ব দেখালো তাকে। আমরা এসে তার, আমাদের এবং তার দায়িত্বে থাকা মানুষজনকে যে কি বিপদে ফেলে দিয়েছি সেই দুঃশ্চিন্তা তার অভিব্যক্তিতে একদমই লুকোলেন না। তবে তার আতিথ্যে তা বাদ সাধলো না। তিনি কম্বলগুলো সরানোর আয়োজন করলেন এবং বারকয়েক আমাদের জানান দিলেন এখানে এসে আমরা কি ভয়ংকর কাজ করেছি কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই এলাকায় খুবই তৎপর।

তারপর যখন বুঝলেন আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, নৌকাদুটো চলে গেছে, তিনি আমাদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। মিশনের ডাইনিং রুমে বসে আমরা চা বিস্কুট খেলাম। তিনি জানালেন মিশন কি ধরণের কার্যক্রম চালায় এবং গত ছয়মাসে কি সমস্যার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের আসার উদ্দেশ্যও শুনলেন (যা আমার কাছে রওনা দেয়ার সময় থেকে এখন অনেক বেশি অবাস্তব ঠেকলো)। অবশেষে তিনি আমাদের দুটো আলাদা শোবার ঘর দেখিয়ে দিলেন যাতে আমরা ঘুমাতে পারি, তারপর সকালে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

অনেক পরে জেনেছি যে একাত্তরের এপ্রিলে তার সঙ্গী একজন যাজক যশোরে এক গির্জায় আশ্রয় নেয়া মানুষদের রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হন। ফাদার মারিও ভেরোনেসি ছিলেন যুদ্ধের অসংখ্য হতাহতের একজন। ৪ এপ্রিল ছিল ইস্টারের আগের রোববার, পাম সানডে। যশোরের সেই মিশনে তিনি গরীব অসহায় মানুষগুলোকে সাধ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করছিলেন। সৈন্যরা যখন এলো তিনি তাদের সামনে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। দুপাশে দুহাত বাড়িয়ে দিলেন প্রতিরক্ষার ভঙ্গীতে, তার মানুষদের রক্ষায়। সৈন্যরা তার বুকে গুলি করলো। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মতো দুহাত মেলে ধরে সেই পবিত্র সপ্তাহের শুরুতে আত্মদান করলেন তিনি। ৫৮ বছর বয়সী ভেরোনেসি ২৮ বছর ধরে ধর্মীয় কার্যক্রমে যার ১৯ বছরই তিনি কাটিয়েছিলেন বাংলাদেশে। শুরুতে যশোরে দাফন করা হলেও পরে তার কফিন শিমুলিয়ায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে তিন বছর পর নিহত ফাদার ভ্যালেরিয়ান কোব্বের পাশে সমাহিত করা হয় তাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইসমাইল হোসেন নামে এক ছাত্র ফাদার কোব্বেকে পাঠানো একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, 'অবশেষে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, মুক্ত হয়েছি। আমরা আনন্দিত এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি আমাদের দেশের উন্নতির জন্য, শান্তিময় যাপনের জন্য। এতোগুলো শহীদের স্মৃতি আমাদের শোকার্ত করে, বেদনা দেয়। আমাদের সমাজের সেরা মানুষগুলো মারা গেছেন। ফাদার মারিও ভেরোনেসি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের একজন। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত। আমাদের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ মূল্য তিনি দিয়ে গেছেন।'

ফাদার ভেরোনেসির মৃত্যুর খবর ফাদার কোব্বেকে একা করে দেয়। তার সঙ্গী ফাদার সেসি সেই সময়টার বর্ণনায় বলেছেন, 'শিমুলিয়া ছিল সবচেয়ে ঝামেলার জায়গাগুলোর একটি। দেড় হাজার খ্রিস্টান দ্বিধা নিয়ে ভাবছিল ভারতে পালিয়ে যাবে কিনা। ফাদার কোব্বে তাদের থেকে যেতে বলেন। তারপর শুরু হয় আমার দেখা নিত্য এখান থেকে ওখানে সরে যাওয়ার এক ভয়াবহ বিপদকাল।  প্রায় প্রতিরাতে গেরিলারা আমাদের এখানে আসতো। প্রতিদিন আমাদের কোনো না কোনো পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাকে বোঝাতে হতো এই গ্রামে কোনো দুষ্কৃতিকারী নাই। স্কুল নিয়মিত চলতো (সম্ভবত গোটা দেশে এটাই একমাত্র), কুয়াতে পানি ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিয়মিত সৈন্যরা গ্রামে এক ঝামেলায় জড়ায় এবং এক মারামারিতে দুইজন সেনা মারা যায়। তারা এই ঘটনায় মিশনকে দায়ী করে এবং প্রতিশোধ নিতে মিশনের একজন সাহায্যকারীকে গুলি করে মারে। এই ঘটনা ফাদার কোব্বেকে আরো হতভম্ব এবং নার্ভাস করে দেয়। ওই ঘটনার জের ধরে অনেকগুলো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়, শত শত মানুষকে মেরে ফেলা হয়।  আমার ধারণা ফাদার কোব্বে অনেকবার নিজের অজান্তেই বিপদের মধ্যে পাড়ি দিয়েছেন। তার জিপ যে পথে যেত সেখানে বেশ কয়েকবার সৈন্যরা তার জন্য অপেক্ষা করেছে।' ফাদার কোব্বেকে অক্টোবরে আমরা সেখানে যাওয়ার কিছুদিন পরই রোমে ডেকে পাঠানো হয় এবং তিনি ৭২ সালের জুলাইয়ে ফেরেন। আমি নিশ্চিত নই আমরা যখন সেখানে গেছি তখন ফাদার কোব্বে ছিলেন কিনা। তিনিই আমাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন কিনা। তবে উপরের ঘটনাবলীতে এটা স্পষ্ট আমাদের দেখে তারা কেন অমন আচরণ করছিলেন। কয়েকবছর পর ফাদার কোব্বেকে শিমুলিয়াতে গুলি করে মারে এক গুপ্তঘাতক।

৪ অক্টোবর: সকাল, গ্রেপ্তার

ভোর ছয়টায় একই যাজক হন্তদন্ত হয়ে আমাকে জেগে ওঠালেন। খুবই উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। জানালেন বিপদ ঘটে গেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মিশন ঘেরাও করে ফেলেছে এবং এগিয়ে আসছে। সুপারিশ করলেন যেখানে আছি সেখানেই যেন থাকি। ঠিক তাই করলাম, পাশাপাশি পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিলাম, একটা ছোট ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঢোকালাম যাতে প্রয়োজনে দ্রুত সরে পড়তে পারি। অদ্ভুত এক অবস্থা। যাজক যাওয়ার পরপরই নিচতলায় একটু হৈ চৈ শোনা গেল। তারপর সুনশান নীরবতা। একবার ভাবলাম হয়তো তার ভুল হয়েছে, কিন্তু সেটা উবে গেল একটু পর ঘটনার গভীরতায়। প্রবোধ দিয়ে ভাবছিলাম সেনাবাহিনী আসতেই পারে, কিন্তু আমাদের জন্য নয়, কিন্তু সেটাও মিলিয়ে গেল হিমশীতল বাস্তবতার ছোঁয়ায়। মিনিট বিশেক নিরবতার পর একটু দূরে চেচামেচি আর গুলির আওয়াজ শুনলাম। বাস্তব উপলব্ধি ফিরে এল। এটা সেনাবাহিনী। তারা আসছে। নির্দিষ্টভাবে আমাদের জন্য না আসলেও, পেলে ঠিকই বর্তে যাবে ওরা।

গুলির আওয়াজ থামলো, আর চেচামেচির আওয়াজ এগিয়ে আসছে, সম্ভবত মিশনের ভেতরেই। আর তারপর আবার সব চুপচাপ। জানালা থেকে এতক্ষণ সরে থাকলেও এবার উকি দিলাম। দৃষ্টিসীমায় দেখলাম উঠানে জনাদশেক সশস্ত্র সেনাসদস্য। হ্যা, ঘটনা সত্যিই ঘটছে। প্রায় দশ মিনিট পর এফএন রাইফেল (বেলজিয়ামের তৈরি) হাতে একজন সৈন্য আমার রুমে ঢুকে পড়লো এবং বন্দুক তাক করলো। ইংরেজিতে বললো, 'আমার সঙ্গে আসো।'

কোনো তর্কে গেলাম না। আমাকে নিচে সেই রুমটায় নিয়ে গেল যেখানে ঘণ্টাকয়েক আগে চা বিস্কুট খেয়েছি। আমার মার্কিন সহকর্মী সেখানে আগেই বসা। তিনজন ইতালিয়ান যাজকও সেখানে আছেন যাদের খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। দুজন সেনা কর্মকর্তা, একজন মেজর ও একজন লেফটেনেন্টও সেখানে বসে আছেন। দরজায় দুজন সৈন্য, একজন আমাকে নিচে নিয়ে এসেছে, অন্যজন সম্ভবত অ্যালেনকে। লেফটেনেন্ট পদমর্যাদার অফিসার আমাদের জেরা করা শুরু করলেন, আমরা কেনো সেখানে এসেছি। আমরা যথাযথ উত্তর দিচ্ছি না। মেজর চুপ করে শুনছেন আমাদের কথা। দুজনই জোর দিয়ে বললাম যে আমরা নিজে থেকেই এখানে এসেছি এবং যাজকরা কিংবা মিশনের কেউ আমাদের আসার ব্যাপারে কিছু জানতো না। আমাদের কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কও নেই। আমরা মিশনে কম্বল নিয়ে এসেছি যাতে তারা সেগুলা বিলি করতে পারে।

লেফটেনেন্ট বললেন, আমরা অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছি, তার মানে নিশ্চিতভাবেই আমাদের কোনো ভালো উদ্দেশ্য নেই। জবাবে আমরা বললাম যে নিরুপায় মানুষ এবং তাদের সাহায্যে সক্ষমদের মধ্যে কোনো সীমান্তের অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করি না। সে জানতে চাইলো কিভাবে আমরা জানলাম যে মানুষের সাহায্য দরকার এবং তার দেশে বিনা অনুমতিতে এসে ঝামেলা পাকানোর অধিকার আমরা কোথায় পেয়েছি। সন্দেহ নেই উত্তর দেয়ার সময় আমরা উদ্ধত এবং দুর্বিনীত ছিলাম। তার চেয়ে কম না বরং আমাদের কথাবার্তায় উস্কানির উপকরণ ছিল।

এরপর আমরা চুপ হয়ে গেলাম, কারণ হঠাৎ পরিষ্কার হয়ে গেলো অন্তত আমার কাছে যে তার অভিযোগ ন্যায়সঙ্গত। যদিও এর আগে ব্যাপারটা এভাবে মাথায় আসেনি আমার। গত কয় মাসে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর আচরণ মানবাধিকারের সে কোনো প্রেক্ষিতেই সীমা ছাড়িয়েছে সত্যি। কিন্তু উদ্ধতের মতো যে উচ্চ আদর্শকে আমরা প্রবোধ মানছি এবং আমাদের অহিংস নীতির এই যে কার্যক্রম তা এই প্রেক্ষাপটে কতখানি দাগ ফেলতে সক্ষম, সেটা যে আদতে হঠকারিতা তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল।

ভয়ার্ত মিশনারিদের দিকে তাকালাম। আমাদের প্রত্যাশার চাইতে তারা ভালো করছিল এবং এই ভঙ্গুর রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় তাদের কার্যক্রম এবং তাদের শরণে থাকা মানুষগুলোর জীবনকে আমাদের এই হঠকারি উপস্থিতি ভয়াবহ বিপদে ফেলে দিয়েছে। হয়তো মিশন কিংবা এখানকার মানুষদের সরাসরি কোনো শাস্তি পেতে হবে না, কিন্তু তাদের নিত্যকার জীবন আমাদের কারণেই বদলে গেল এবং সেটা ভালো কিছু নয়। লেফটেনেন্ট তার সকল গরল উগড়ে দেয়ার পর আমাদের বাইরে নিয়ে আসা হলো। তার আগে যাজকরা আমাদের আলিঙ্গন করলেন, প্রার্থনা করে শুভকামনা জানালেন। মেজর কামরায় রয়ে গেলেন, সন্দেহ নেই যাজকদের একটু কড়কে দিতে।

আমার খুব খারাপ লাগছিল। নিজের এবং সঙ্গীর জন্য তো বটেই, কারণ আমাদের ভাগ্যে কি আছে আমাদের জানা নেই। কিন্তু তার চেয়ে বেশি খারাপ লাগছিল এভাবে না ভেবেচিন্তে ভালো কাজ করা ভালো মানুষগুলোকে বিপদে ফেলার জন্য। আমাদের তিনটনি একটা আর্মি ট্রাকের পিছনে বসানো হলো। আমাদের সঙ্গে ভয়ার্ত চেহারার তিন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ স্থানীয় তরুণ এবং ৬জন সশস্ত্র সৈনিক।  তরুণদের ভবিতব্য ভেবে আমার অনুতাপ আরো বেড়ে গেল। মিশন থেকে বেরিয়ে আমরা সেই বানে ভাসা মাঠ ঘেরা ডোবা রাস্তা দিয়ে এগোলাম যা গত রাতেই বেশ রোমান্টিক লেগেছিল। এখন মনে হচ্ছিল তা এই দুর্দশাগ্রস্ত দেশ ও দীর্ঘদিন তা সয়ে যাওয়া নাগরিকদের জন্য স্রেফ আরেকটা দুর্বিপাক মাত্র।

মূল রাস্তার কাছাকাছি পৌঁছতেই ট্রাক থেমে গেল। লেফটেন্যান্ট নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়ালেন, তারপর পানির দিকে রাইফেল তাক করে পুরো ম্যাগাজিন খালি করে ফেললেন। আমাদের সঙ্গী তরুণরা ভয়ে কাঁপছিল, প্রতিটি ব্রাশফায়ারের সঙ্গে আমাদের পরিস্থিতি চরম বাস্তব রূপ নিয়ে প্রকাশ পাচ্ছিল। এটাই এখানকার আইন, আমাদের জীবন এই লোকটার হাতেই। তার সামরিক প্রশিক্ষণ ও শৃংখলা কি অটুট থাকবে নাকি আমাদের পালাতে দেয়ার অজুহাতে গুলি করে মেরে ফেলবে? সে গুলি করছিল কেন? যেন আমার ভাবনা পড়তে পেরেছে এই ভঙ্গী নিয়ে সে ট্রাকের পেছনে এলো এবং মুচকি হাসি দিলো, কিন্তু আমার কাছে তা ভয়ংকর মনে হলো। উর্দুতে সৈন্যদের কিছু নির্দেশ দেয়ার আগে আমাদের বললো, 'লোকজনকে একটু জানান দিলাম যে এইখানে ক্ষমতায় কে।' (চলবে)