আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে

Published : 11 Dec 2019, 09:57 AM
Updated : 11 Dec 2019, 09:57 AM

সকালে ঘুমের ঘোর কাটছে যখন, বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আকাশ কালো করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মেঘ। চোখ মেলে দেখি তিনি চলে গেছেন। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এই ভরা বৃষ্টি মাথায় করে চলে গেছেন! বেঁচে গেছেন। এই যাবার অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি। এই মুক্তির আশাতেই ছিলেন। সকাল থেকে বোবা হয়ে আছি। আমাদের বোবা থাকতে বলা হয়েছে, জুজুর ভয় দেখিয়ে বোবা করে রাখা হয়েছে। বুকের ভেতরে বইছে ঝড় কিন্তু সে ঝড় দেখাবার ক্ষমতা নেই আমাদের।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ ড. অজয় রায় গতকাল চিরবিদায় নিলেন।

আসলে তো গতকাল নয়, ওনার মৃত্যু হয়েছে যেদিন নিজের আদর্শের জন্যে, মুক্তভাষ্যের জন্য, মুক্তচিন্তার জন্য হত্যা করা হয়েছিল ওনার ছেলে অভিজিতকে। কিম্বা হয়ত ওনার সত্যিকারের মৃত্যু হয়েছে নিজের অভাগা দেশে প্রিয়তম সন্তানের হত্যার বিচারহীনতায়।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা থেকে বেরিয়ে যাবার পথে বাংলাদেশের মৌলবাদীদের হাতে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছিল অভিজিতকে। তিনি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. অজয় রায়ের ছেলে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, বিজ্ঞান লেখক ও স্কলার ড. অভিজিৎ রায়।

অভিজিৎ আমেরিকা থেকে দেশে এসেছিলেন দুদিন আগেই। সেদিন স্ত্রী বন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন একুশে বইমেলায়। যে বইমেলা বাঙালির সত্যিকারের অভয়ারণ্য হবার কথা ছিল সেখানে যেভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল তা লোমহর্ষক। তার মাথায় সজোরে ধারালো চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কোপ বসিয়েছিল ওরা। রাস্তায় পড়েছিল ড. অজয় রায়ের প্রিয়তম সন্তান অভিজিতের রক্ত, মগজ, চশমা, হাতের আঙুল। সবাই তা জানে। তার চোখের সামনে চির পরিচিত ওই হাসপাতালের মর্গে লাশ হয়ে শুয়েছিল অভিজিৎ। আর মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন পুত্রবধূ বন্যা আহমেদ।

কী বীভৎস, কী অসহ্য, কী নির্মম সেই যন্ত্রণা বুকে বয়েছেন তিনি ও তার পরিবার, অভিজিতের স্ত্রী আর আত্মজা। অথচ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে স্বাধীন হওয়া এই দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন তার জীবনের সোনালী দিনগুলো। মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্যে। যার মূলমন্ত্র ছিল ভীরুতা, কাপুরুষতা, হীনমন্যতা, কুসংস্কার আর অন্ধত্ব থেকে মুক্তি। আলোকিত মানুষের আকাশ ছোঁয়া শিক্ষা, মানবিকতা, বিজ্ঞান মনষ্কতা, মুক্তচিন্তা ও গভীর জ্ঞান। সততা, প্রজ্ঞা ও সভ্যতা।

তিনি তার অর্জিত বিদ্যা অকৃপণ হাতে বিলিয়েছেন তার শিক্ষার্থীদের মাঝে, দেশের তরুণ সমাজকে শেখাতে চেয়েছেন তার হৃদয় নিংড়ে দেয়া অসাম্প্রদায়িক চিন্তা ও চেতনা। কত অগণিত ছাত্রের প্রাণে জ্বেলেছেন প্রজ্ঞার মশাল।

নিজের স্বাধীন করা দেশে সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে পাননি তিনি। সন্তানের হন্তারককে দেখেছেন বহাল তবিয়তে রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়। তাদেরকে দেশ ছেড়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে এই রাষ্ট্র, অভিজিতের মত সৎ সাহসী, মুক্তচিন্তক মানুষটির হত্যাকাণ্ডকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে এই দেশ। কী দুঃসহ সেই অপমান! কী লজ্জা! কী পরাজয়! ড. অজয় রায় যেন গ্যালিলিওর মতো, যীশুর মতো নিজেই বয়েছেন নিজের ক্রুশ!

কিন্তু না! মাথা তিনি নত করেননি। তিনি অভিজিতের আত্মত্যাগকে সম্মান করেছেন। সমাজ থেকে অন্যায়, অসত্য, মানুষের মন থেকে কুসংস্কার, দৃষ্টি থেকে অন্ধত্ব দূর করে সত্য ও জ্ঞানের আলোটুকু জ্বালতে চেয়েছিলেন অভিজিৎ। সে তার আদর্শের জন্যে প্রাণ দিয়েছে। তার স্বচ্ছ দৃষ্টি ও মুক্ত চেতনার জন্যে গৌরবান্বিত থেকেছেন কেবল পিতা হিসেবে নয় একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবেও।

আজ যখন তার আদর্শের সরকার ক্ষমতায় তখন সন্তান হত্যার বিচার পেলেন না তিনি। কত অসহায় মর্মপীড়া নিয়েও সত্যের জন্যে, আলোকিত স্বপ্নের জন্যে অভিজিতের আত্মদানের গৌরব নিয়ে ফিরে গেলেন সেই অনন্তধামে।

সন্তান হারানোর পাথর চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে ধুকে ধুকে নুয়ে নুয়ে চলছেন আরো এক বাবা! ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা প্রফেসর আবুল কাশেম ফজলুল হকও আছেন সেই হৃৎপিণ্ড ছেঁড়া বেদনা নিয়ে। ড. অজয় রায়ের মতো বজ্রাহত পিতা হিসেবে তিনিও হয়ত এভাবেই সন্তান হত্যার বিচার না পেয়ে বিদায় নেবেন একদিন। যেমন অনন্ত বিজয়, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর বাবু, রাজীব হায়দারের পরিবারের মতো আরো অগণিত পরিবার।

এ বছরেই চলে গেছেন অভিজিতের মা। এবার চলে গেলেন বাবা ড. অজয় রায়। এই মৃত্যুর কাছে আমরা কেবল অসাড় দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের ভাষা থাকে না আর। আমাদের নয়নের দৃষ্টি হতে ঘোচে না অন্ধকার। আমরা কেবল ডুবে যেতে থাকি কিন্তু কফিন থেকেও আমাদের প্রাণে প্রাণে বারতা দিয়ে যান ড. অজয় রায়। বলে যান 'নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো যেখানে পড়বে সেথায় দেখবে আলো…'

বিদায় পিতা! আপনার চিরশান্তি হোক সেখানে, সেই অনন্তধামে 'যায় যেথা দানব্রত, সত্যব্রত, পুণ্যবান যাও বৎস যাও সেই দেবসদনে- দুঃখ আঁধার যেথা কিছুই নাহি।– যাও রে অনন্তধামে…'