এমপির সকাল-বিকাল নাশতা এবং তেলাপোকা নেতা

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 10 Dec 2019, 01:41 PM
Updated : 10 Dec 2019, 01:41 PM

পাল্টাপাল্টি বক্তব্য রাজনীতিতে নতুন কোনো বিষয় নয়। আগে মনে করা হতো ঝগড়াঝাটি বুঝি বাংলাদেশের রাজনীতিতেই বেশি হয়। রুচির দুর্ভিক্ষের কারণে আমাদের খাবার টেবিলে বাছবিচার ছাড়াই খাদ্য উঠে যায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই রাজনীতিটা তামাশার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ক্রোধ সংবরণ করা নয়, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশই যেন নিজেকে বড় প্রমাণের উপযুক্ত পথ। কম কথা, বেশি কাজের দিন শেষ। এখন চলছে কম কাজ, বেশ কথার জামানা। কাজে না বড় হয়ে কথায় বড় হতে গিয়ে এখন অকথা-কুকথারই চর্চা বেশি করতে হয়।

উন্নত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো ছাড়া কথামালার রাজনীতি আজকাল অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। আমেরিকার মাথা গরম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো বেতালা কথা বলে ইতোমধ্যে রেকর্ড গড়ে ফেলেছেন। আগে মুখ ফসকে নেতারা দুএকটা ফাউল কথা বলে দু:খ প্রকাশ করতেন। এখন পরিকল্পনা করেই ফাউল কথা বলা হয়। কথার জাদুকর হলে রাজনীতিতে ভালো করার তথ্য আমাদের অজানা নয়। রাজনীতিতে বাগ্মিতার একটি আলাদা মূল্য আছে। বক্তৃতা দিয়ে মানুষের মন জয় করার মতো অনেক বিশ্ব নেতার নাম আমরা জানি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা বক্তা হিসেবে তুখোড় ছিলেন। তিনি অনর্গল বলতে পারতেন। তবে তার কথা ছিল মার্জিত এবং যুক্তিপূর্ণ। মানুষকে আলোকিত, আলোড়িত করার মতো শব্দ চয়ন করা ওবামার বৈশিষ্ট্য। তিনি বক্তৃতা করে মানুষের মন জয় করতেন, পক্ষে টানতে পারতেন। সাবেক সোভিয়েত নেতা গরবাচেভও বক্তা হিসেবে নাম করাই ছিলেন। তিনি বক্তৃতা করে ভালো আয়-রোজগারও করেছেন। ওবামাও 'লেকচার' দিয়ে মোটা টাকা রোজগার করেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও বক্তৃতা করে মানুষকে এক করতে পারতেন, মানুষের মধ্যে 'আগুন' জ্বালাতে পারতেন। তার একাত্তরের সাত মার্চের ভাষণ পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতারও প্রশংসা না করে পারা যায় না। মোদি তো নাকি স্রেফ বক্তৃতা দিয়েই বাজিমাত করছেন। তার ব্যাপক জনপ্রিয়তার গোপন রহস্য নিহিত আছে তার গলায়। গলাবাজিতে তাকে হারাতে পারছেন না কেউ। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী যে নেতা হিসেবে 'ফ্লপ' মারলেন তার বড় কারণ বক্তা হিসেবে তিনি মেটেও ভালো না। তার গলাও তেমন মাধুর্যময় নয়।

তবে ইদানীং কিছু কিছু দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ঝগড়ুটে মনোভাব প্রবল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। অনেক নেতাই গরম গরম এবং অশালীন ও আক্রমণাত্মক কথা বলেন। তার কণ্ঠ নিসৃত বাক্য কার মনে কী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে তা না ভেবেই শব্দশাস্ত্র ছুড়ে দেন। আশা করেন, তার শব্দশেল কাউকে নিহত করতে না পারলেও হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করতে অন্তত ব্যর্থ হবে না।

অনেক দেশেই রাজনীতিবিদরা বিরোধী পক্ষকে কাবু করতে বাক্যবাণ নিক্ষেপে পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে বারবার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যাহত হওয়ায় এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা যথাযথভাবে না হওয়ায় সৌজন্য-শিষ্ঠাচার এবং পরিমিতিবোধের ঘাটতি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে ইদানীং গণতন্ত্রের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী প্রতিবেশী ভারতের রাজনীতিতেও যেভাবে 'ঝগড়া' প্রাধান্য বিস্তার করছে তা থেকে এটা মনে করা যায় যে, রাজনীতিতে এখন নেতিবাচক উপাদানই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকবে। নেতারা বলবেন একটা, করবেন আরেকটা। বলা হবে, দুর্নীতিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না কিন্তু বাস্তবে দুর্নীতির সঙ্গে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার নীরব প্রশিক্ষণ চলবে।

রাজনীতিবিদদের মুখের কথা শুনে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝা এখন কঠিন । কঠোর আন্দোলনের কথা বলে ঘরে বসে অলস সময় কাটানো হবে। মাত্রাজ্ঞান না থাকাটাই এখনকার রেওয়াজ। বক্তৃতা দিতে গিয়ে কোনো কোনো রাজনীতিবিদ হিতাহিত জ্ঞানও হয়তো হারিয়ে ফেলেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মার্জিত-নম্রভাবেও যে কড়া বার্তা দেওয়া যায় – এটা যেন এখন সবাই ভুলতে বসেছেন।

নেতাদের বক্তৃতা শুনে রাজনৈতিক পরিপক্কতা অর্জনের সুযোগ এখন আর পাওয়া যাবে না। একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য, সাবেক একজন মন্ত্রীকে হুমকি দিয়েছেন প্রকাশ্য জনসভায়। সাবেক মন্ত্রী এবং মাদারীপুর-২ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য, পরিবহন শ্রমিক নেতা শাহজাহান খানকে হুমকি দিয়ে ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবর রহমান চৌধুরী, যিনি নিক্সন চৌধুরী হিসেবেই বেশি পরিচিত, বলেছেন, 'আপনার মতো ( শা. খা.) কাগুজে বাঘ আমি সকাল-বিকাল নাশতা খাই। আমার এলাকার এক কোদাল মাটি যদি শাহজাহান খান কাটা পড়ে, তাহলে আপনার রাজনীতির বারোটা বাজাইয়া তেরোটা কইরা ছাইড়া দেবো'।

শাহজাহান খানকে জাসদের গণবাহিনীর ডাকাত ছিলেন দাবি করে নিক্সন চৌধুরী বলেছেন, 'তেলাপোকাও পাখি আর শাহজাহান খানও মানুষ। ওনারে আমি মানুষ মনে করি না, তেলাপোকার মতো পাখি। ওনার ওস্তাদরেই খাইয়া ফেলাইলাম, আর ইনি তো কোনো বিষয় না। আমার সাথে খেলতে আইসেন না। জন্মের পর থেকে আমার বাপে আমারে প্লেয়ার বানাইছে। তাই খেলা আমরাও জানি'। কেমন বুজলেন? এটা একজন সংসদ সদস্যের ভাষা! এটা শুনে কি মনে হচ্ছে? শাহজাহান খান ভয়ে লেজ গুটিয়ে নেবেন? মনে হয় না। এরপর খান সাহেব হয়তো পাল্টা হুংকার দিয়ে বলবেন, আরে রাখেন আপনের বাহাদুরি! আপনার মতো 'স্বতন্ত্র' প্লেয়ারের সঙ্গে কি খেলুম! আপনি তো আমার কাছে শরবত। এক চুমুকেই শেষ'। ঠিক এভাবেই জবাব দেওয়া হবে কি না, জানি না। তবে রাজনৈতিক বাহাসের স্ট্যান্ডার্ড এই পর্যায়েই পৌঁছেছে।

ফাঁকা কলসি বেশি বাজে বলে একটি কথা আমাদের দেশে চালু আছে । রাজনীতিতে এখন ফাঁকা কলসির সংখ্যাই সম্ভবত বেশি। তাই আমরা এখন শব্দ বেশি শুনি। যা করার নয়, যা হওয়ার নয়, তেমন বাগাড়ম্বর শুনে মনে স্বস্তির বদলে আতঙ্ক তৈরি হয়। রাজনীতি মানুষকে ভীত-সন্তস্ত্র করে রাখে।

নিক্সন চৌধুরী কিন্তু তার এলাকায় জনপ্রিয়। আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার প্রার্থীকে পরাজিত করে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এমন একজন জনপ্রিয় মানুষ যদি আর একজন রাজনৈতিক নেতাকে তেলাপোকা মনে করেন, তার সকাল-বিকাল নাশতার জন্য যদি একজন এমপিকেই লাগে তাহলে বিষয়টি কি খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়?

কেউ হয়তো বলবেন, এই সব ফালতু বিষয় নিয়ে আলোচনাটাই অর্থহীন। এই সব ফালতু মানুষদের হাতে যখন আইন প্রণয়নের ভার তখন দুশ্চিন্তা হয় বলেই ফালতু বিষয়ও আলোচনায় আসে। দেশের মানুষ এই ফালতুদের বর্জন যতদিন করতে না পারবে ততদিন আমাদের দুষ্টচক্রেই ঘুরপাক খেতে হবে।