মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হবে কবে?

Published : 10 Dec 2019, 10:38 AM
Updated : 10 Dec 2019, 10:38 AM

"মুক্তিযোদ্ধা" শব্দটির মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালি জাতির গর্বের ইতিহাস, বাঙালি জাতির অহংকারের বীরগাথা। এই মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন বলেই আমরা পেয়েছি বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আমরা পেয়েছে আমাদের ঠিকানা, আমাদের স্বদেশভূমি। মুক্তিযোদ্ধারা হচ্ছেন বাঙালি জাতির সূর্যসন্তান। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি আমাদের লাল-সবুজের পতাকা আর বিশ্বের বুকে এক গর্বিত মানচিত্র। 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটি আমাদের কাছে অনেক বড় মাহাত্ম্যময়। মুক্তিযোদ্ধা শব্দটি শুনলেই শ্রদ্ধায় নত হয়ে ওঠে হৃদয়।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আজ পর্যন্ত সেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা আমরা তৈরি করতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধীকরণের বা অন্তর্ভুক্তিকরণের যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়া পরিবর্তন এবং 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটির সংজ্ঞায়ন মোট বারো বার করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে কিন্তু একটি অর্ডারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞায়ন করেছেন।

কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হবেন সেটি ১৯৭২ সালের অর্ডারে স্পষ্ট রয়েছে। এটি নিয়ে বারবার বিতর্ক করে মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণের কিছু নেই। ১৯৭২ সালের অর্ডারের যে ব্যাখ্যা তাতে বলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।

কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত কোনো সংগঠিত দলের সদস্য না হন এবং হয়েও যদি সক্রিয় ভূমিকা না রাখেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পড়বেন না। উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের অর্ডারের ইংরেজি ভাষায় যা বলা আছে তা হচ্ছে: 'ফ্রিডম ফাইটারস (এফএফ) মিনস অ্যানি পারসন হু হ্যাড সারভড অ্যাজ মেম্বার অব অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়ার অব লিবারেশন।'

অন্যদিকে ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান একটি পরিপত্র জারি করেন। এতে কারা মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হবেন তার সংজ্ঞা বা চারটি শর্ত দেয়া হয়।

এসব শর্ত হচ্ছে: যারা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশ হয়েছিল অথবা যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষর করা সনদ রয়েছে। এ চারটির যেকোনো একটি শর্তে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ পান মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীরা। যদিও এখন আবার বলা হচ্ছে চাকরিতে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধার কোটা সুবিধা না নিলে এখন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা পাবেন না।

১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণে ভিন্নতা রয়েছে। কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণেই '৭২-এর নির্দেশ পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। আর এটি না করায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার।

অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। সেক্টর থেকে পাওয়া (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর এসব দলিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তর করা হয়েছে) দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জনের খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

এদিকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা লাল বইয়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইবিআরসিতে সংরক্ষিত ৭০ হাজার ৮৯৬ জনের মধ্যে অনেকের নাম এ তালিকায় নেই। অর্থাৎ এ তালিকাটিও অসম্পূর্ণ বলা যায়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সুপারিশকৃতদের নিয়ে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার। জোট সরকারের সময় সংখ্যা বাড়ে ৪৪ হাজার। যা ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিযোগ করে আসছে।

একটি বিষয় দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে মুক্তিযোদ্ধা ইস্যুতে জল কম ঘোলা হয়নি কিন্তু এত জল ঘোলা করেও একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তালিকা প্রণয়নের সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি তারাও সনদ নিয়ে নিয়েছেন। গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা দেখেছি সাবেক এক এমপির মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় এক ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তিকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে  মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সেই ঘটনায় দেখা যায় মো. মীজানুর রহমানের জন্ম মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার ৯ বছর পর ১৯৮০ সালে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার। শুধু তা-ই নয়, তার মা-বাবার বিয়েও হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর। বাবার নাম আবদুল মজিদ, মা দিলরুবা খানম। তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৮ সালে। এর দুই বছর পর ১৯৮০ সালের ৩ জুলাই জন্ম হয় মো. মীজানুর রহমানের।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও মর্যাদা নিয়ে এই ধরনের ছিনিমিনি খেলা ব্যথিত করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের, তাদের হৃদয়ে পুঞ্জিভূত হয়েছে ক্ষোভ ও অভিমান। সেই অভিমানের জের ধরে সাম্প্রতিক কালে আমরা অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান নিতে। তারা রাষ্ট্রের প্রতি তুলে ধরেছেন তাদের ক্ষোভ ও অভিমানের কথা।মুক্তিযোদ্ধাদের এই ক্ষোভ ও অভিমান জাতি হিসেবে আমারদের লজ্জিত করে তোলে।

ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশ হয়তো ভবিষ্যতে আরো অনেক নামকরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী বা অন্য যেকোনো পেশার মানুষকে তৈরি করতে পারবে কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি চাইলেও আর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তৈরি করতে পারবে না। আজকে থেকে ১৫-২০ বছর পর যে কয়জন মুক্তিযোদ্ধা এখনও জীবিত আছেন তারাও হয়ত থাকবেন না। মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষণজন্মা পুরুষ। তারা জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে নিজের জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে জাতিকে এনে দিয়েছিলেন মুক্তির স্বাদ। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জীবদ্দশায় তাদের সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথা সম্মানের ব্যবস্থা করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিন্দুমাত্র অসম্মান জাতি হিসেবে ইতিহাসের বিচারে আমাদের অকৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত করবে।