জলবায়ু পরিবর্তন: কার্বন-কারবারিরা শুনতে কি পাও?

হাসান ইমাম
Published : 9 Dec 2019, 12:15 PM
Updated : 9 Dec 2019, 12:15 PM

এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে একটি গাড়ি যে পরিমাণ অক্সিজেন পোড়ায়, একজন মানুষের এক বছরের শ্বাসক্রিয়া সচল রাখার পক্ষে তা যথেষ্ট। অর্থাৎ গতিনির্ভর প্রাযুক্তিক সভ্যতার মূলে কার্বন নিঃসরণ, যার অপর নাম উষ্ণায়ন। এই পটভূমিতে জাতিসংঘের ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি)-এর বিশেষ প্রতিবেদন বলছে, সামনের দিনগুলোতে বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি নয়, বরং ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে না পারলে ঘোর বিপদে পড়বে মানুষ। বিজ্ঞানীদের সাফ কথা, এই অবশ্যম্ভাবী বিপদ এড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ২০১০ সালের অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। আর এই বিকল্পহীন পদক্ষেপের দ্বিতীয় ধাপে, অর্থাৎ ২০৫০ সালে তা নিয়ে আসতে হবে একেবারে শূন্যের ঘরে। এ জন্য বনাঞ্চল সৃষ্টিসহ শস্যবৈচিত্র, বৃষ্টিনির্ভর কৃষি ইত্যাদির মাধ্যমে এবং প্রযুক্তির সাহায্যে গ্রিনহাউস গ্যাসের উৎপাদন ও অপসারণে সমতা আনার কথা বলা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি আকাশকুসুমের চেয়ে কম কিছু মনে হয় না। আইপিসিসিও তেমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছে, যেভাবে চলছে, তা চলতে থাকলে এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ৩ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে যাবে।

গত কপ-২৪ সম্মেলনে ব্যাপক বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছে আইপিসিসির এই বিশেষ প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে। তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার সুপারিশের তীব্র বিরোধিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ সৌদি আরব ও কুয়েতের মতো তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর উন্নয়নের পথ থেকে সরে না আসার 'যুক্তি' তুলে ধরতে তারা প্রতিবেদনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নস্যাৎ করতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হয়নি। গ্রিনহাউস গ্যাসে লাগাম টানতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সমতা ও পৃথক দায়িত্বের বিষয়ে তুমুল তর্ক হয়েছে। বলাই বাহুল্য, উন্নত দেশগুলোর বাড়তি দায়িত্বের প্রশ্নটি অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে গেছে।

তাই দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন এড়িয়ে ২৫তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বা কপ-২৫ আয়োজন নিয়মরক্ষার বৈঠকে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে। ২ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এই সম্মেলনের প্রথম দিনই অক্সফাম এক প্রতিবেদনে বলল, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগে গত এক দশকে বসতবাড়ি হারিয়ে পথে নামতে বাধ্য হয়েছে দুই কোটি মানুষ। অতি বন্যা, তীব্র খরা, বিধ্বংসী ঝড়ঝঞ্ঝা ও মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল গিলে খাওয়া দাবানলের শিকার এসব মানুষের বেশিরভাগই গরিব দেশের অধিবাসী। আর সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানাল, চলতি দশক ইতিহাসের উষ্ণতম দশক, আর চলতি বছরটি ইতিহাসে এযাবৎ নথিবদ্ধ উষ্ণতম তিনটি বছরের একটি। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির ২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বিগত বছরগুলোর তুলনায় গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ফের ঊর্ধ্বমুখী নয়, রেকর্ডও গড়েছে।

তাই জাতিসংঘ মহাসচিবের জবানিতে 'জলবায়ু সংকটে মানবসভ্যতা চরম হুমকিতে' উচ্চারণ বাস্তব পরিস্থিতির যথাযথ সারাংশ হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন-সতর্কবার্তা কার্বন-কারবারিদের কতটা 'সতর্ক' করতে পারছে?

শিল্পবিপ্লবের পর ১৮৫০ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিঃসরণ হওয়া বিষাক্ত গ্যাসের দুই-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও জাপানসহ কয়েকটি দেশ। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো চুক্তি অনুসারে এসব দেশের বাড়তি দায়িত্ব আছে ২০২০ সালের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার। আরও কথা ছিল, নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনবে তারা। কিন্তু বিশ্ব জনমত, বিজ্ঞানীদের সতর্কতা উপেক্ষা করে কিয়োটো চুক্তি মানেনি যুক্তরাষ্ট্র। অন্য অনেক শিল্পোন্নত দেশও কার্বন কমানোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে হাঁটেনি জোরকদমে। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিগত বছরগুলোর তুলনায় চীন ও ভারতের মতো দেশগুলোর নিঃসরণ বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।

বোঝাই যাচ্ছে, ঐতিহাসিকভাবে কার্বন-কারবারের ৭৫ শতাংশ রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর অধিকারে। তাদের প্রকৃতিবিনাশী উন্নয়নের এই লাগামছুট ধারা জারি থাকলে বৈষম্য আরও বাড়বে। উন্নয়নশীল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জ্বালানি সুরক্ষা, জীবনমান পড়বে তীব্র সংকটে। কাঁধে গরম নিঃশ্বাস ফেলা উদাহরণ হতে পারে সুন্দরবন। উষ্ণায়নের কারণে এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের ৮০ লাখ মানুষ চরম বিপদের মুখে। পূর্বাভাস বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় বাস্তুচ্যুত হতে পারে এই অঞ্চলের প্রায় ৩ লাখ পরিবার। অথচ বাস্তবতা হলো, ৭০ শতাংশের বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদন হয় শহরগুলোতে— পরিবহন, ভবন নির্মাণ, বিদ্যুতের ব্যবহার ইত্যাদি কারণে। অর্থাৎ শহুরে সভ্যতার খেসারত দেবে গ্রামীণ সমাজ-সংস্কৃতি!

তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সর্বজনীন দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার দেশগুলোকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। অথচ উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি মতো বার্ষিক ১ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা গত তিন বছরেও মেলেনি।

হিসাব কষে দেখা গেছে, তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখতে হলে বিশ্বের মোট আয়ের ২.৫ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হবে। বিশ্ববাসীর দাবি, বিজ্ঞানীদের সতর্কতা-সুপারিশ, হাজারেবিজারে দেনদরবার সত্ত্বেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অথচ ২০১৭ সালে বিশ্বে সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২.২ শতাংশ। এর মানে, প্রশ্নটা সদিচ্ছার, অগ্রাধিকারের এবং অবশ্যই দায়িত্ববোধের।