‘নিউ নরমাল’- ইংরেজির অধ্যাপক ক্লাসরুমের বাইরে রাজনীতির ময়দানে

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 9 Dec 2019, 08:13 AM
Updated : 9 Dec 2019, 08:13 AM

শেক্সপিয়র, সফোক্লিস পড়ানো পুরোদস্তুর ইংরেজির অধ্যাপক ক্লাসরুমের বাইরে রাজনীতির ময়দানে। ক্লাস লেকচারের বদলে আয়ত্ত্ব করতে হবে রাজনীতির চড়া সুর। আমাদের দেশীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কিছুটা নতুন। এমন নয় যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতিতে বিরল বরং ক্ষেত্রবিশেষে নীল-সাদায় বিভক্ত হয়ে গড়পড়তা পেশজীবী সংগঠনে মতো আচরণও করতে দেখি। তবে সক্রিয় রাজনীতিতে সরব না থাকলেও রাজনৈতিক উত্তারাধিকার বয়ে বেড়ানো একজন যুবলীগের মতো হার্ডকোর সংগঠনের দায়িত্ব নিয়েছেন এটিকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

'নিউ নরমাল' পশ্চিমা দুনিয়ায় একটি চালু বিজনেস টার্ম। বাণিজ্যিক এই ধারণা রাজনীতিতেও আমদানি করেছেন তাত্ত্বিকেরা। একে বাংলায় 'নতুন স্বাভাবিকতা' বলা যায়। আওয়ামী রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই শেষ কথা এবং অনেক সময় নেতা নির্বাচনে তার আউট অফ বক্স ধরনের প্রয়োগ ফলপ্রসুও হয়েছে। ঢাকা উত্তরের মেয়র হিসেবে ব্যবসায়ী আনিসুল হক এর উজ্জ্বল উদাহরণ। রাজনীতি ভিন্ন অন্য ক্ষেত্রে সফল পেশাজীবীদের রাজনীতিতে নিয়ে এসে প্রায়ই চমক দেখান শেখ হাসিনা। এও এক 'নতুন স্বাভাবিকতা'।

যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন শেখ ফজলে শামস। আর সাধারণ সম্পাদক পদে এসেছেন মাঈনুল হোসেন খান। ২৩ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে যুবলীগের ৭ম কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন শেষে বাংলাদেশের সমান বয়সী সংগঠনটির নেতৃত্বের পরিবর্তন এসেছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হলেও সবসময় নিজেকে রাজনৈতিক দৃশ্যপটের আড়ালেই রেখেছিলেন। প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষক ও দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্ততা তার সুরুচির পরিচায়ক (এক শিক্ষক তার উপর উপাচার্য স্বেচ্ছায় উপাচার্য পদ ছেড়ে যুবলীগের দায়িত্ব নিতে চেয়ে বিরক্তি উৎপাদন করেছেন অনেকের)। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে শেখ ফজলে শামস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশে যান। দেশে ফিরে গত এক দশক ধরে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।

পিতা শেখ ফজলুল হক মনি সল্পায়ু হলেও রাজনীতিতে ভিন্নতর সিগনেচার মার্ক রেখে গেছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। একই সাথে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি একজন মেধাবী সাংবাদিকও ছিলেন। তিনি দৈনিক বাংলার বাণী, বাংলাদেশ টাইমস ও সাপ্তাহিক সিনেমার সম্পাদক ছিলেন। শেখ ফজলুল হক মনি বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছিলেন। তার একটি উপন্যাস থেকে 'অবাঞ্ছিতা' ছবিও তৈরি হয়েছিল।

জনমিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ এক অভূতপূর্ব ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট প্রাপ্তির সামনে। তবে সরকারি নীতি সহায় না হলে উলটো ফল হতে পারে। দেখা যাচ্ছে দেশের তরুণ সমাজ ক্রমশ হতাশ হয়ে মাদকাসক্তি ও অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। যথাযথ কর্মসংস্থান ও কর্মপরিবেশ না থাকায় তারা সক্রিয়ভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলতি বাস্তবতায় ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতেও অনিচ্ছুক তরুণেরা। সমাজ ও রাষ্ট্রের চলার মূল শক্তি দেশের যুব সমাজ। শিক্ষিত তরুণ সমাজ সমাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখালেই জাতির অগ্রগতির পথ সুগম হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তীতার সুষ্ঠু পরিবেশ থাকতে হবে। কার্যত জাতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এমন পরিবেশ নেই। ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের তরুণ সমাজ ক্রমেই রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। রীতিমতো "পলিটিক্স হেটার" হয়ে গড়ে উঠছে দেশের যুব সমাজ।

"আমার চেষ্টা থাকবে, যুব সমাজ যেন 'আই হেইট পলিটিক্স কালচার' থেকে বেরিয়ে এসে 'জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু' বলে নিজেকে দেশের কাজে নিয়োজিত রাখে।" ছাত্র ও তরুণ সমাজের রাজনীতিবিমুখতার বিষয়টি যে ভালোই জানেন যুবলীগের নতুন চেয়ারম্যান তা এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই ছাত্র ও যুব রাজনীতিকে ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ার জ্ঞান করে আসছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা শাসকরা। নানা অনাচারে লিপ্ত মূল দলের লেজুড় হয়ে থাকে এই সব সংগঠনগুলো। "জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, কিন্তু ষড়যন্ত্রের কারণেই সেই বিপ্লব সম্পন্ন হয় নাই। আজকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্সের' যে কর্মসূচি দিয়েছেন, সেই কর্মসূচিকে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের একটি কর্মসূচি হিসেবে আমি দেখি। দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান শুরু হয়েছে তার সমর্থনে যুবলীগের প্রধান শুরুতেই অবস্থান নিজ জানিয়েছেন।

তবে সহযোগী সংগঠনগুলোতে মূল দলের উপর থেকে নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে, নভেম্বর জুড়ে সব কাউন্সিলেই এমন দেখা গেছে। কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ আর যুবলীগের কাউন্সিলেও নেতৃত্ব ঠিক করে দেয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের হস্তক্ষেপ ছিল খোলখুলিভাবেই। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংশোধনী আনা হয়েছিল, তখন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ব্যবস্থার নিয়ম চালু হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী কোনো অঙ্গসংগঠন রাখার বিধান নেই। শব্দের হেরফের করে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ এবং পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে দেখিয়ে থাকে। আরপিওতে সংগঠনের স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা বলা আছে। আদতে মূল দল আওয়ামী লীগের ইচ্ছামাফিকই চলে। এবং আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেও বলা রয়েছে, সহযোগী সংগঠনগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে। সেইসাথে সহযোগী সংগঠনগুলোরও আলাদা আলাদা গঠনতন্ত্র থাকবে। তবে কর্তার ইচ্ছায় না চলে গঠনতন্ত্র মেনে চললে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হয় না আর প্র্যাক্টিসিং রাজনীতিবিদদের ছেড়ে অন্য কারো সেবাও নিতে হয় না।