অলিম্পিকের সোনার হরিণ

Published : 15 May 2014, 06:57 PM
Updated : 14 August 2012, 05:21 PM

গত দু'সপ্তাহ ধরে অলিম্পিক উন্মাদনায় মেতে ছিল গোটা পৃথিবীর মানুষ। লন্ডন অলিম্পিকের বিস্ময়কর, চোখ-ধাঁধানো ও শিল্পসৌন্দর্যে অতুলনীয় উদ্বোধনের পরে এ নিয়ে কোন সন্দেহই নেই যে, গ্রহটির সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী হচ্ছে এই অলিম্পিক। তার সোনার পেছনে ছুটেছে পৃথিবীর সেরা ক্রীড়াবিদরা। পৃথিবীর ভাণ্ডারে ঐ মূল্যবান ধাতুটির পরিমান যাই থাকুক না কেন, দুবাই বা নিউইয়র্কের স্বর্ণের দোকানগুলো যতই গরবিণী হোক, অলিম্পিকের সোনাই যে সবচেয়ে আরাধ্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপও এত টানেনা দুনিয়াকে। এমনকি পৃথিবীর প্রায় নব্বইভাগ স্বর্ণখনি যে দক্ষিন আফ্রিকায়, তাদের ক্রীড়াবিদরাও লন্ডনে অলিম্পিক স্বর্ণের জন্য দৌঁড়েছে।

অনেকের মতো আমিও প্রতিরাতে ঘুম বিসর্জন দিয়ে টেলিভিশনে অলিম্পিক গেমস দেখেছি। একবার দেখি তলোয়ার দিয়ে একজন প্রতিযোগী আরেকজনকে খোঁচাবার চেষ্টা করছে। তলোয়ারে অবশ্য তেমন ধার নেই, যে আগে অন্যের বর্মআচ্ছাদিত গায়ে ছোঁয়া লাগাতে পারবে, পয়েন্ট তারই। খেলাটির নাম ফেনসিং। ভাবলাম সেই ইখতিয়ারউদ্দিন-বিন-বখতিয়ার খিলজির আমল থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষ তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করে আসছে। কৈশোরে রাজা-রাজরাদের নিয়ে নির্মিত যত সিনেমা দেখেছি, তার সবগুলোতেই তলোয়ার-যুদ্ধ ছিল। সিনেমার প্রভাবে, মনে আছে, কৈশোরে আমরা কিশোর ও নবীন যুবারা কাঠের তলোয়ার বানিয়ে তা নিয়ে 'যুদ্ধ যুদ্ধ' খেলেছি। আমাদের জিনের ভিতর, রক্তের ভিতর তলোয়ার-যুদ্ধ থাকার কথা, অথচ এমনকি তলোয়ার-যুদ্ধেও আমরা অলিম্পিক থেকে আজতক একটা সোনার মেডেল আনতে পারলাম না! ভাবলে আশ্চর্য লাগে, হতাশার গভীরে ডুবে যেতে হয়। অথবা ধরা যাক ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলার কথা। এটাও তো আমাদের পূর্বপুরুষগণ বেশ ভালই রপ্ত করেছিলেন! কুস্তিরও অনেকগুলো ক্যাটাগরীতে প্রতিযোগিতা হয়। এ খেলাটিও বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা; আমাদের জাতীয় খেলা হা-ডু-ডুর সাথে কুস্তির একটা সাদৃশ্য আছে। রাজনৈতিক কুস্তিতে পটু হলেও মূল জায়গায় আমরা একেবারেই অপটু!

নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষেরা শৈশব-কৈশোর থেকেই সাঁতারে পটু। বেঁচে থাকার স্বার্থেই চারিদিকে জলাশয়ঘেরা বাংলার জনপদে শিশুদের সাঁতার শিখতে হয়। অমন দেশের সাতারু ছেলেরা কোনদিন অলিম্পিক থেকে একটা ব্রোঞ্জের পদকও আনতে পারল না, এটা ভাবলে কষ্ট লাগে। মনে হয় আমাদের কয়েকশত নদী, আমাদের সংখ্যাতীত হাওর-বাওড়, খাল, দীঘি আর পুকুর ব্যর্থ। যে দেশের সারাটা শরীর জুড়েই জলের প্রবাহ, যে দেশে প্রাকৃতিকভাবেই শিশুরা সাঁতার শেখে, সে দেশের কেউ সাঁতারে একটা অলিম্পিক পদক জয় করতে পারবে না– এটা মেনে নেয়া যায় না। কেবল সাঁতার নয়, অলিম্পিকে আছে নৌকা বাইচের অনেকগুলো প্রতিযোগিতা। নদীমাতৃক বলেই আজো নদীই আমাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম আর নৌকা হচ্ছে সবচেয়ে দৃশ্যমান বাহন। আমাদের মাঝিরা উত্তাল সব নদী পাড়ি দিয়ে ইতিহাসে ও উপন্যাসে স্থান করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের মতো এত বিভিন্ন প্রকারের ও নকশার নৌকা সারা পৃথিবীতেই নেই। এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকাবাইচের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় – এটি আমাদের উৎসব ও ঐতিহ্যের অংশ। অথচ অমন একটি দেশের কেউই নৌকা বাইচে কোনদিন অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করল না- এটা অবিশ্বাস্য!

মনে আছে বহুবছর আগে চীনের একদল সাঁতারু এসেছিল আমাদের দেশে। বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের আমন্ত্রণেই তারা এসেছিলেন। চীন তখনো খেলাধুলার জগতে অখ্যাত নাম। সবাই খুব আশায় বুক বেঁধেছিল, আমাদের ছেলে-মেয়েরা কিছু স্বর্ণপদক জিতবে। কেননা প্রতিযোগিতা নিজেদের সুইমিং পুলে, আর আমরাতো শৈশব থেকেই সাঁতারাচ্ছি। বাংলাদেশ সে প্রতিযোগিতায় একটিও সোনা জিততে পারেনি, সবগুলো স্বর্ণপদক নিয়ে যায় চীন। চীন তখনো অলিম্পিকে শক্তি হয়ে ওঠেনি, কিন্ত শক্তির আগাম ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিল। তখন বিচিত্রায় 'দুর্জন উবাচ' বলে একটি কলাম লিখতেন খোন্দকার আলী আশরাফ। তাঁর কৌতুকময় কলমে তিনি এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তবে তীর্যকভাবেই। তিনি লিখেছিলেন, যে দেশ সোনার বাংলা, যে দেশের মাটি সোনার, মানুষ সোনার, এমনকি গাছপালাও সোনায় মোড়ানো, সে দেশের সাঁতারুদের সোনার প্রতি সত্যি কোন লোভ নেই। আর চীনের সাঁতারুরা হল আমদের অতিথি। অতিথির সন্তুষ্টি বিধানে আমাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। তাই আমরা সব সোনাই অতিথিদের হাতে তুলে দিয়েছি, নিজেরা স্বার্থপরের মতো একটিও নিইনি। লেখকের অসাধারণ ব্যঙ্গের ভিতর আসলে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস লুকানো ছিল।

সত্যি বলতে দাবা আর ক্রিকেট ছাড়া আর একটি খেলাও আমরা ভাল করে খেলতে শিখিনি। সম্ভবতঃ দাবাতেই আমাদের সাফল্য সবচেয়ে বেশী। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম গ্রাণ্ডমাস্টার হয়েছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। আমাদের রয়েছে পাঁচজন গ্রাণ্ডমাস্টার যা পৃথিবীতে কম দেশেরই রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশী পরিচিতি এনে দিয়েছে ক্রিকেট। ক্রিকেটে আমরা বিশ্বপর্যায়ে খেলি সত্যি, তবে এও সত্যি গোটা দুনিয়ায় সাকুল্যে ১৫টি দেশ ক্রিকেট খেলে। আগে অলিম্পিকে ভারত পাকিস্তানের প্রচণ্ড দাপট ছিল। আর কিছু না হোক হকির স্বর্ণ এই দুটো দেশেই আসত। কারণ তখনো ইউরোপীয়রা খেলাটি ভাল করে শেখেনি। যখন শিখল, ভারত বা পাকিস্তানকে আর শীর্ষে খুঁজে পাওয়া গেল না। পৃথিবীর আরো দশটি দেশ যদি ক্রিকেট খেলতে শুরু করে তখন আমাদের কী হবে, কে জানে। ক্রিকেট নিয়ে আমাদের উন্মাদনার অন্যতম কারণ, আর কোন খেলা নিয়ে আমরা কোনদিন উল্লাস করতে পারিনি। আমাদের জমে থাকা আবেগ ঐ একটি খেলাকে ঘিরে বিস্ফোরিত হয়।

অনেকেই শারিরীক শক্তি আর সামর্থের কথা বলেন। পুষ্টিশূন্যতায় ভুগতে থাকা একটি দেশের নাগরিকদের পক্ষে বলবান সব প্রতিদ্বন্ধীর সাথে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়– এমন যুক্তি দেখান। দাবার মতো একটি বুদ্ধিমত্তার খেলা না হয় বাদ দিলাম, পৃথিবীতে অনেক খেলাধূলা আছে যাতে শারীরিক শক্তি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এথলেটিক্সে সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ব ভেঙ্গে দিয়েছে ক্ষুধাপীড়িত আফ্রিকার কালো মানুষেরা। ক্ষীণ কাঠামোর মানুষগুলোর শক্তি আর দম দেখলে অভিভূত হতে হয়। অলিম্পিক এলেই বোঝা যায় পৃথিবীতে কত দেশ আছে আর আছে কত প্রকার খেলাধুলা। এবার মোট ২৬টি খেলায় অংশ নিয়েছে ২০৪টি দেশ, গ্রহটির প্রতিটি ভূখন্ডই শরিক ছিল ঐ মহামিলনের উৎসবে। শক্তির প্রয়োজন আছে, তবে এর বেশীর ভাগটাই কৌশলের। নিবিড় প্রশিক্ষণ আর চর্চ্চা ছাড়া বিশ্বমানে ওঠা যায় না। দীর্ঘকাল ধরেই দীর্ঘদেহী, শক্তিমান ইউরোপয়ীদেরই প্রাধান্য অলিম্পিকে। কিন্তু বেইজিং অলিম্পিক থেকেই এশীয়দের উত্থান দেখা যাচ্ছে। অভ্যুদয় ঘটেছে নতুন শক্তি চীনের। অলিম্পিকে বরাবরের সুপারপাওয়ার আমেরিকার সাথে সমানে পাল্লা দিয়েছে চীন। অর্থনৈতিক শক্তির বিচারেও দেশ দুটি শীর্ষে। খেলাধুলার মতো বিনোদনের বিষয় যে অর্থনীতির সাথে ওতোপ্রোতভবে জড়িত, কোন সন্দেহ নেই। এশিয়ার অন্য দুটি দেশ- কোরিয়া এবং জাপানও অলিম্পিকে ভাল ফলাফল করেছে।

ধনী দেশগুলোর কথা আলাদা। কেউ কোন খেলায় ভাল হলে এত বেশী স্পন্সরশীপ পায় যে আর্থিক অনটন তার ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক চীনে বা কিউবায় অবশ্য সবকিছু করা হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। একেবারে ছোট বয়স থেকে জিমন্যাস্টিকস, সাঁতার আর বিভিন্ন খেলাধূলায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কঠিন সে প্রশিক্ষণ, শিশুদের উপর প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক চাপ পড়ে। কিন্ত গোটা জাতির স্বার্থেই এটা করা হয়, সেসব শিশুরা বড় হয়ে যখন ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, জিমনাস্টিকস আর সাঁতারে সোনা জিতে আসে, তখন তাদের ঐ শিশুকালের বেদনা ভুলে যাওয়ারই কথা। ক্রীড়াবিদ তৈরিতে চীন হতে পারে আমাদের জন্য অনুকরণীয়, কেননা ব্যক্তি উদ্যোগে এদেশে বিশ্বমানের ক্রীড়াবিদ তৈরি হবে না, চাই একশভাগ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা।

কলেজ জীবনে প্রথম যেবার টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম, সেবার বিতর্ক-বিষয় ছিল 'খেলাধুলাই বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনের একমাত্র উপায়'। আমরা অর্থাৎ ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ দল ছিলাম বিতর্ক-বিষয়ের পক্ষে। শক্তিশালী ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ ছিল আমাদের প্রতিদ্বন্ধী। একে শক্ত প্রতিদ্বন্ধী, তার উপরে আমাদের বিপক্ষে ছিল 'একমাত্র উপায়' বাক্যবন্ধটি। কেননা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনের জন্য আরো অনেক উপায় বা পথ আছে । তবে একথাও সত্যি যে খেলাধুলার মত এত দ্রুত এবং এত বেশী খ্যাতি আর কোন ক্ষেত্রে নেই। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের ছোট্ট দেশ জ্যামাইকার প্রেসিডেন্টকে ক'জন চেনেন? কিন্তু একজন উসাইন বোল্টকে সারা পৃথিবী চেনে। বিদেশীদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, ভারতের প্রেসিডেন্ট, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে পারবে কিনা, কিন্তু শচীন টেন্ডুলকারকে তারা ঠিকই চেনে। আসলে রাষ্ট্রপ্রধানদের বিভিন্ন দেশের সরকারী দপ্তর, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়গুলো ছাড়া, আর কেউ তেমন চেনে না। মৃত্যুর পরে তো আরো বেশী বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান তারা। পেলে যেমন ব্রাজিলকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছে, তেমনি আর্জেন্টিনার জন্য একই কাজ করেছেন ম্যারাডোনা। ক'জন অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রীর নাম আমাদের স্মরণে কিংবা স্মৃতিতে আছে? কিন্ত স্যার ডন ব্রাডম্যানকে কি আমরা ভুলতে পারব? রুমানিয়া বলে যে একটি দেশ আছে পৃথিবীতে আমার অনেকে জানলেও সবাই কি জানতাম? অথচ অলিম্পিকে জিমনাস্টিকসে প্রথম পারফেক্ট টেন স্কোর করে অনেকগুলো সোনার পদক জিতে নাদিয়া কোমিনিচি নামের এক ললিতলোভন কিশোরী রুমানিয়াকে পৃথিবীখ্যাত করে তুলেছিল। একই কাণ্ড ঘটিয়েছিল সম্রাট হাইলে সেলাসির রাজপ্রাসাদের রক্ষী আবিবে বিকিলা। ম্যারাথন জিতে দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত দেশটিকে মানুষের আলোচনায় তুলে এনেছিলেন। একই কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন কেনিয়া, জাম্বিয়ার দুরপাল্লার দৌড়বিদরা। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি এসব দেশের কোন রাষ্ট্রপ্রধানের নাম আমরা জানি না (কেবল বিসিএস পরীক্ষার সময় কষ্ট করে এসব নাম প্রার্থীদের মুখস্ত করতে হয়) অথচ এইসব সাধারণ মানুষদের চেনে গোটা বিশ্ব। সম্রাটের চেয়ে বেশী জনপ্রিয় তার প্রাসাদরক্ষী! এটাই খেলাধুলার জাদু। এই জাদু দিয়েই পৃথিবীকে জানাতে পারতাম আমাদের অস্তিত্ব। 'বাংলাদেশ ব্রান্ডিং'য়ের সবচেয়ে কার্যকর দূত হতে পারেন ক্রীড়াবিদরা। আমাদের রাজনীতিবিদরা যতই লাফালাফি করুক না কেন, বিশ্ব তাদের খুব কম জনকেই চেনে, তারা চেনে ক্রিকেটের সাকিব আল হাসান বা নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।

আসলে খেলাধুলায় না আছে পারিবারিক উৎসাহ, না আছে পরিবেশ, না আছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা। কোন মা-বাবাই চান না তাদের ছেলেমেয়ে খেলোয়াড় হোক। খেলার মাঠও ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে; শহর তো নেই-ই, গ্রামাঞ্চলেও কৃষিজমির চাহিদা আর বসতি বিস্তৃতির কারণে খেলার মাঠ কমে আসছে। খেলাধুলায় সরকারী উদ্দ্যোগ মিডিয়ায় প্রচারসর্বস্ব এবং হতাশাব্যঞ্জক। দরিদ্র দেশটির ছেলে-মেয়েরা উচ্চমূল্যে খেলার সামগ্রী কিনে ব্যক্তিউদ্যোগে খেলাধুলা চালিয়ে যেতে পারে না। স্কুল-কলেজে ক্রীড়াসামগ্রী নেই, নেই নিবিড় প্রশিক্ষণ। ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে যান, তিনি বলবেন খেলাধুলা ছাড়া একটি জাতি এগুতে পারে না, আমরা তাই খেলাধূলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছি। ঐ 'সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার' প্রদানের ফলাফল হল, অলিম্পিক দূরে থাক, এশীয়ান গেমসেও আমাদের পারফরমেন্স তলানির দিকের। বাংলাদেশে জনপ্রিয় খেলার বাইরে কোন খেলোয়ার আর্থিকভাবে সাবলম্বী হতে পারেন না, তাই কেউ এটাকে পেশা হিসেবেও ভাবেন না।

'জয়লাভ নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা' – এই সান্তনাবাক্য নিয়ে আমরা আর কতকাল অলিম্পিকে অংশ নেব আর অংশগ্রহণের নাম করে অকর্মণ্য কর্মকর্তাদের বিদেশভ্রমণের সুযোগ করে দিব? জনসংখ্যার বিচারে আমরা পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশের একটি, অলিম্পিকে পদক তালিকায় প্রথম দশ না হোক প্রথম বিশেও কি আমাদের থাকার কথা নয়? বিশ কেন, আমরা তালিকাতেই নেই। অলিম্পিক ইতিহাসে আমরা কখনোই একটি পদকও জিততে পারিনি। স্বাধীনতার পরে চল্লিশ বছরে এগারটি অলিম্পিকের আসর বসেছে। প্রতি অলিম্পিকে একটি করে পদক জিতলেও এতদিনে এগারটি পদক থাকতো জাতীয় সংগ্রহশালায়। যে ক্রীড়াবিদ বাংলাদেশের হয়ে প্রথম অলিম্পিক মেডেল জিতবেন, তিনি হয়ে যাবেন ইতিহাসের অংশ, ঐ এভারেস্টজয়ী মুসা ইব্রাহীমের মতোই। অলিম্পিকের সোনা আর কতকাল আমাদের জন্য সোনার হরিণ হয়ে থাকবে?

২৮ জুলাই শুরু হয়ে ১২ আগস্ট আরেকটি জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে এল ১৪০০ কোটি ডলার খরচ করে আয়োজিত দু'সপ্তাহের দুনিয়া-মাতানো অলিম্পিক। পরবর্তী গন্তব্য ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরো। আমরা কি এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারি না? আগামী অলিম্পিককে সামনে রেখে যেসব খেলায় আমাদের সম্ভাবনা বেশী সেসব খেলায়, প্রয়োজন হলে বিদেশী কোচ এনে, নিবিড় প্রশিক্ষণ দিতে পারি না? তাতে অবস্থার পরিবর্তন হলেও হতে পারে। কেবল অংশগ্রহণ নয়, আমাদের প্রয়োজন জয়। পনের কোটি মানুষ অন্ততঃ একবার অলিম্পিক গৌরবে মাথা তুলুক আকাশে, পদক-বিতরণ মঞ্চে উত্তোলিত হোক আমাদের জাতীয় পতাকা, বাজুক আমাদের জাতীয় সঙ্গীত – আমার সোনার বাংলা……!

কামরুল হাসান: কবি, প্রাবন্ধিক ও বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।