ব্যবসায়ী, রাজনীতি ও দু-মুখো দৈত্য

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 7 Dec 2019, 11:56 AM
Updated : 7 Dec 2019, 11:56 AM

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ নেতাদের ক্যাসিনো ব্যবসা, ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে থেকে চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলো আমাদের রাজনীতিতে এখনও বেশ আলোচিত হচ্ছে। ক্যাসিনো ব্যবসা, চাঁদাবাজি আসলে ভবিষ্যতে যারা রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসবেন, তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক মানসিকতা ঢুকে পড়ারই বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সব দলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা এখন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ফলে, ক্ষমতার রাজনীতিতে অর্থবিত্তের মালিক ব্যবসায়ীদের দাপটে প্রকৃত রাজনীতিবিদেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এ প্রসঙ্গে তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ একাধিকবার বলেছেন, 'আমাদের দেশের রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে, এটি দেশের জন্য কলঙ্কজনক!'

অথচ এক সময়ে আমাদের দেশে রাজনীতি করত সত্যিকারের রাজনীতিবিদরা। অতীতে রাজনীতিতে যারা ভূমিকা রেখেছে তারা ছিল সুশিক্ষিত এবং সুশীল। তারা দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করত। তাই তখনকার রাজনীতি ছিল চেতনার। আর এখনকার রাজনীতি চলে গেছে অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের হাতে। রাজনীতিতে যাদের কোনো ভূমিকা অতীতেও ছিল না বর্তমানেও নেই। দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কোনো ভূমিকাই তারা আজ পর্যন্ত রাখতে পারেনি। ব্যক্তি স্বার্থে তারা রাজনীতিকে কুক্ষিগত করে রেখেছে।

অথচ রাজনীতি হলো একটি দেশের চালিকাশক্তি। একটি দেশকে নির্মাণ করা এবং সেই দেশের মানুষকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। বর্তমান বিশ্বে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা বা তত্ত্ব রাজনীতিকে আরও বেশি সংবেদনশীল ও দায়িত্ববান করে তুলেছে। কল্যাণ রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার পূরণ করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। এই কর্তব্যকে কিছুতেই রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। তাই আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতি দুটোই এখন আমজনতার সেবা দিতে বাধ্য। কেননা জনতা যদি রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে অনাস্থা প্রকাশ করে, তাহলে ক্ষমতা বা গদি দখলে রাখা যায় না। আর গদি না থাকলে আব্বাস আর গাবগাছ একই রকম গুরুত্বহীন হয়ে যায়!

প্লেটো তার 'রিপাবলিক' গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেখানে ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার অধিকার রাখেননি। কারণ তিনি জানতেন, যার যে কাজ, তার সে কাজ করাই উচিত। ব্যবসায়ীরা যেখানে হাত দেন সেখান থেকেই তারা টাকা উপার্জন করার কথা ভাবেন। তারা হাসপাতাল তৈরি করেন টাকার জন্য, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করেন টাকার জন্য, পত্রিকার মালিকানা বলি আর টিভি চ্যানেলের মালিকানা বলি- সবখানেই আছে টাকা বানানোর মনোবৃত্তি। টাকা কামানোর এত এত পথ থাকতে রাজনীতিতে আসার উদ্দেশ্য কি ডিউটি ফ্রি গাড়ি, বিলাস বহুল বাড়ি, কম দামে প্লট, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিনা পুঁজিতে কাড়ি কাড়ি টাকা কামানো?

ব্যাপারটা আসলে তাই। আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে টাকা লগ্নি করতেন কিন্তু সরাসরি রাজনীতি করতেন না, আজকের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন দলের জন্য টাকা ব্যয় না করে নিজেই নেমে পড়ছেন রাজনীতিতে, এর ফলে বদলে যাচ্ছে রাজনীতির ব্যাকরণ। টাটা-বিড়লা-আম্বানী, বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েও রাজনীতিতে পা রাখেননি- ব্যবসা প্রসারেই মনোযোগী হয়েছেন। ব্যবসাতেই তারা সফলতা পেয়েছেন।

আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের কে বলবে; আপনারা রাজনীতিকে টাকা বানানোর যন্ত্র না বানিয়ে নিজের ব্যবসায় মন দিন। তাতে দেশের অর্থনীতি সবল হবে, মানুষ উপকৃত হবে। রাজনীতিটা প্রকৃত রাজনীতিবিদদেরই করতে দিন।

না, এমন কথা বলার মানুষ আমাদের দেশে কমে গেছে। গত চার দশকে বাংলাদেশের রাজনীতে এক মস্ত পরিবর্তন ঘটে গেছে। তৃণমূল পর্যায় থেকেই শুরু হয়েছে রাজনীতিতে টাকাওয়ালা বা ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ। যার টাকা আছে তার পিছেই লোক আছে, যেকোনো জায়গায় টাকাওয়ালার জন্য চেয়ার আছে। ফলে টাকা বিনিয়োগ করতে টাকাওয়ালারা মোটেই দ্বিধা করে না। আজকের দিনে সমাজে একজন সৎ মানুষের চেয়ে টাকাওয়ালা মানুষের দাম বেশি। যেহেতু টাকার দাম বেশি, তাই টাকা যাদের আছে তারাই তো সমাজপতি হবে। আগে জ্ঞানীরা সমাজপতি হতো এখন ধনীরা সমাজপতি হয়। এই চিন্তা চেতনা অত্যন্ত খারাপ মানসিকতার পরিচয় বহন করে।

ব্যবসায়ীদের কাজ হলো মুনাফা তৈরি করা, মানুষের দাবি-দাওয়া পূরণ করা নয়। তাদের কাছে মানুষের চেয়ে টাকার দাম বেশি। পক্ষান্তরে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টাকার চেয়ে মানুষের দাম বেশি। দুটি বিপরীত বিশ্বাস নিয়ে দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃত রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদগণ। আমরা যদি এখনি রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের পার্থক্য বুঝতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আসুন আজ থেকেই প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি তুলে দিই। বিদায় জানাই ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাদের। রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাঁচাতে হলে জনতার সচেতনতা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কেননা জনতাই পারে রাজনীতি না-জানা টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীদের রাজনীতির ব্যাকরণ শিক্ষা দিতে!

পুনশ্চ: এ প্রসঙ্গ একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। একবার এক রাজা ঘোষণা দিলেন, 'সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে প্রথম যে বিশাল পাহাড় আছে, তার গুহায় থাকে এক দৈত্য যার মুখ থেকে আগুনের গোলা বের হয়, এর মাথায় রয়েছে এক মুকুট। এর মাথা থেকে মুকুটটা নিয়ে এসে আমার মেয়েকে যে দিতে পারবে আমি তার সঙ্গেই আমার মেয়ের বিয়ে দিব।' তিনি এও বলে দিলেন, 'দৈত্যটা ছয় মাস ঘুমায়, ছয় মাস জেগে থাকে।'

এ ঘোষণা শুনে রাজ্যের বুড়ো-জোয়ান অনেকেই রাজকন্যা ও রাজসুখের আশায় সেই মুকুট উদ্ধারে রওনা দিল, কিন্তু তাদের কেউ আর ফিরে এলো না। এক রাজকুমার আবার সেই রাজকন্যাকে পছন্দ করতো, সে ভাবল, আমি তো রাজকুমার, আমি পারবই। আশায় বুক বেধে সে রওনা হলো, গুহা পর্যন্ত পৌঁছে সে দেখে দৈত্যটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে হাসিমুখে মুকুটটা নিয়ে উল্টো দিকে ফিরে হাঁটা শুরু করল। সব ঠিকই ছিল, শুধু সেই রাজা একটা জিনিস গোপন করেছিলেন। তিনি যেটা বলেননি তা হলো, দৈত্যটির দুটো মুখ, এক মুখ সামনে, আরেক মুখ পেছনে। যখন এক মুখ ঘুমায় তখন আরেক মুখ জেগে থাকে! ফলে অন্য সবার মতো সেই দ্বিতীয় মুখের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল সেই রাজকুমার!

স্বার্থপর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী পরিচালিত আমাদের বর্তমান রাজনীতিটা অনেকটাই সেই দু-মুখো দৈত্যের মতো। যার ঘুমন্ত মুখ দেখে আমরা আনন্দিত হই, কিন্তু দ্বিতীয় মুখটা আমরা দেখি না। এই অদেখা মুখটাই তার সব স্বার্থ সিদ্ধি করে। আমরা হলাম সেইসব বুড়ো-জোয়ানদের মত, যারা একটু আশ্বাস পেয়েই বর্তে যাই। অতি ধুরন্ধর ক্ষমতাপাগল রাজনীতিবিদরা 'রাজকন্যা' পাবার মতো লোভ দেখিয়ে আমাদের সামনে মুলা ঝুলিয়ে রাখেন! আর আমরা অবিরাম সেই মুলার পেছনে ছুটে চলি!

আমরা যদি এখনও সচেতন না হই, তবে আর কবে হব? সব কিছু দৈত্যের পেটে গেলে?