নবীজির বিবির নাম হতো যদি আমার রক্ষাকবচ!

Published : 3 Jan 2012, 02:13 AM
Updated : 7 Dec 2019, 04:34 AM

কবে কোনও নবী-রসুল, দেব-দেবী বা তাদের আত্মীয় স্বজনের নাম কোন নারী বা পুরুষকে নিপীড়ণের হাত থেকে রেহাই দিয়েছে? কবে থেকে তাদের নামের কোন নারী-পুরুষকে নির্যাতন করলে, তাদের সাথে অন্যায় হলে, সেই ধর্মের অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে? কই, আমরাতো দেখিনি কখনো কাঁদলে ও কোঁকালে! তবে আজ হঠাৎ কী হলো বঙ্গদেশে? একটি কাল্পনিক চরিত্র, যে চরিত্রটি প্রতিবাদী, যে চরিত্রটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তার নাম নবীজির বিবির নামের সাথে মিলে গেল বলে কেমন করে আহত হয়ে গেল কিছু মানুষের অনুভূতি? উল্টো এই নামের মেয়েটির দৃঢ়তার জন্য তাদের আনন্দিত হওয়াটা স্বাভাবিক হতো।

এ বড় আজব দেশ, সত্যি! ঘরে ঘরে কতো আয়েশা মারা পড়ে প্রতিদিন, কেউ তার খবর রাখে না। নবীজির বিবির নামে নাম বলে কেউ তাদের ছাড় দেয় না। কোনদিন কোন ধর্ষক বলে না, "আপনার নাম আমার প্রাণপ্রিয় নবীজির বিবির নামে, আপনাকে আমি ধর্ষণ করতে পারি না। এটা আমার ধর্ম বিরুদ্ধ।" কোন অত্যাচারী স্বামী বলে না, "ওগো, তোমার নাম যে নবীজির বিবির নামে, তোমার গায়ে কি আমি হাত তুলতে পারি?" ধর্ষণের খবর পড়ে কোন পাঠক বলে না, "নবীজির বিবির নামের মেয়েটাকেও ছাড়লো না পিশাচটা?" কোন আইনজীবী এই মর্মে নোটিশ জারি করেন না যে, "এই ধর্ষণের কারণে আমার ধর্মীয় অনুভূতি আহত হইয়াছে। অতএব অবিলম্বে এই ধর্ষণ বন্ধ করা হোক।" তবে? আজ একি শুনি মন্থরার মুখে! হঠাৎ এতো অনুভূতির উৎস কী?

শোনেন 'মুমিন' তকমাধারী ভায়েরা, নবীজির বিবি বা কন্যা কারো নামই কোনদিন কোনো মুসলমান পুরুষের হাত থেকে বাঁচাইতে পারে নাই কোন মুসলমান নারীকে। যেমন বাঁচাইতে পারে নাই কোনো দেবীর নাম কোন হিন্দু পুরুষের হাত থেকে কোন হিন্দু নারীকে বা মাতা মেরীর নাম কোন খ্রিস্টান পুরুষের হাত থেকে কোন খ্রিস্টান নারীকে। তারপরও সিনেমার একটি চরিত্রের নাম নিয়া এতো আহাজারি কিসের!

আসেন, আপনাদের এক আয়েশার গল্প শোনাই। কাল্পনিক না, সিনেমাও না, সত্যি ঘটনা। এইতো ২০১৯ সালেরই ৫ জানুয়ারিতে ঘটে গেল পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। আপনাদের মনে আছে আশা করি। না থাকলেও অসুবিধা নাই। আমি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি।

গেণ্ডারিয়া দ্বীননাথ সেন রোডের টিন শেড বস্তিতে থাকতো এক আয়শার পরিবার। ছোট্ট আয়েশা, মাত্র দুই বছর বয়স। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাঁটতে শিখেছে কেবল। মুখে আধো আধো বুলি। গরীব মা-বাবা কাজে চলে গেলে বস্তির পাশেই গলিতে খেলে সে। যেমন খেলছিল ৫ জানুয়ারিতেও।

খেলা থেকে আয়েশাকে টুক করে কোলে তুলে নেয় প্রতিবেশী নাহিদ। সোজা উঠে যায় তার তিন তলার বাসায় নিজের ঘরে। সেটা দেখে ফেলে নাহিদের ১৪ বছরের মেয়ে বুশরা৷ কিছু সময় পর ছোট্ট আয়শা "মা যাবো মা যাবো" বলে কান্নাকাটি শুরু করলে বুশরা তার বাবার ঘরে ছুটে যায়। বাবার ধমক খেয়ে ফিরে আসে আবার। বুশরাকে সরিয়ে দিয়ে ছোট্ট আয়েশার উপর হামলে পড়ে ধর্ষক নাহিদ।

ধর্ষণ বোঝে না আয়েশা, বোঝে না যৌনতা কাকে বলে। জানে না পুরুষ নামের দুইপেয়ে জানোয়ারের লালসার ইতিহাস। তবুও মাত্র দুইবছর বয়সে পেয়ে যায় পুরুষ সম্পর্কে প্রথম পাঠ। এবং শেষ পাঠও। বেঁচে থাকলে ধীরে ধীরে জেনে যেতে পারতো সবটাই। কিন্তু অতোটা সময় তার জন্য মঞ্জুর করেন নাই সৃষ্টিকর্তা।

ছোট্ট আয়েশা কেঁদেছিল। ব্যথায় চিৎকার করেছিলো। সেই কান্না পৌঁছায় নাই কোথাও৷ ধর্ষকের একাগ্রতা নষ্ট হয় নাই সেই কান্নার আওয়াজে। শুধু শুনতে পেয়েছিলো ধর্ষকের মেয়ে বুশরা। কিন্তু বাবার ভয়ে আয়শার কাছে যাওয়ার আর সাহস পায় নাই। একসময় আয়েশার কান্না থামে, সাথে থামে আয়শার হৃৎস্পন্দনের শব্দও। অতোটা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মরে যায় ছোট্ট আয়েশা। নবীর বিবির নামে নাম বাঁচাতে পারে নাই তাকে।

কিছু সময় পর মৃত আয়েশাকে কোলে করে ঘর থেকে বের হয় ধর্ষক নাহিদ। চলে যায় বারান্দার দিকে। নির্বিকার ছু্ড়ে ফেলে দেয় নীচে। ঘরে বসে কিছু একটা নিচে পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায় বুশরা। প্রতিবেশীরা চিৎকার দিয়ে ওঠে, "কার বাচ্চা নিচে পড়ে গেছে!"

আয়েশা ধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবীর মানববন্ধনে দেখা যায় নাই কোনও "অনুভূতির আঘাতপ্রাপ্ত"-দের। ধর্মীয় অনুভূতির আওয়াজ তোলে নাই কেউ। আয়েশার মা প্রেসক্লাবের সামনে বসে মেয়ের ছবি বুকে চেপে আর্তনাদ করেছেন, "গরিব বলে কি আমার মেয়ের হত্যার বিচার পামু না? আমার দুধের শিশুরে মাইরা ফেলসে নাহিদ। আমার মাইয়াটা হাঁটতেও পারতো না, তারে মাইরা ফেলসে। আমি এই হত্যার বিচার চাই।" আয়শার মতো আয়েশার মায়ের আর্তনাদও পৌঁছায় নাই তাদের কর্ণগুহরে। আয়শাকে ধর্ষণে ও হত্যায় নবীর বিবির অসম্মান হয় নাই কারো কাছে৷ আয়শাদের ধর্ষণ ও হত্যায় ধর্মীয় অনুভূতিরা ঘুমিয়ে থাকে।

মাননীয় "বিশেষ অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত" গণ, আপনারা নোটিশ দিন, নবীর স্ত্রীর নামের, নবীর কন্যাদের নামের কোন মেয়েকে কোনদিন ধর্ষণ করা হবে না, উত্যক্ত করা হবে না, নির্যাতন করা হবে না, মেরে ফেলা হবে না, তাহলে বুঝবো আপনাদের সত্যিই অনুভূতি আছে। কথা দিন, নবীর বিবি-কন্যাদের নাম হবে আমাদের কন্যাদের রক্ষাকবচ। তবে আমরাও আমাদের কন্যাদের নাম রাখবো আয়েশা, খাদিজা, হাফসা, জয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলসুম কিংবা ফাতেমা। আর যদি না পারেন, তবে সিনেমার সামান্য একটি কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে অনুভূতির খেলাটা না হয় নাই খেললেন।